-শোন আমরা , তখন ছোট । ক্লাস ফাইভ কত আর বড় । গাছের আগায় আগায় ঘুরে বেড়াই । কাঠবিড়ালি
আর পাখির আগেই আমরা জানি কোন গাছের আম পাকনা । কোন গাছের জলপাই , কোন গাছের আতাফল সবচেয়ে মজা ।
-আম্মু , ক্ষুধা লাগছে ।
-ঐ গাধা সারাদিন খালি খাই খাই । গল্প শোন । তো আমরা কি করতাম জানস । এক হাতে শুকনা মরিচ আর লবন নিয়া , আরেক হাতে গাছে উঠতাম । আম খাইতাম , জাম খাইতাম ।আর রাস্তা দিয়ে যে লোকজন যাইত তাদের ঢিল মারতাম । ঐ বেদ্দব তুই মোবাইলে গেম খেলস কেন ? কি কই শোন ।
-আম্মু , শুন্তেছি ।
-কই শুনতেছস । সারাদিন মুবাইলের ভিত্রে শয়তান লাফালাফি করাস ( :O আচ্ছা king of fighter শয়তান লাফালাফি ) তোর না ক্ষুধা লাগছে , আজকে তরে মোবাইলের হালুয়া খাওায়ে দিব । (গাজরের হালুয়া ভালো , তাই বইলা মোবাইলের হালুয়া )
-আম্মু বল । এত কিছু করলে স্কুলে যাইতা কখন ।
-তর মত ডাল ব্রেন নাকি , যে সারাদিন বইসা থাইকাও একটা পড়া কমপ্লিট করতে পারস না ।
-আর কি করতা ? (এবার আম্মুর মুখে দেখি একটা পাজি মার্কা হাসি ) ।
- হা হা এখানেই তো মজা । আমাদের স্কুলের সাথে ছিল পোস্টঅফিস । আর পোস্ট মাস্টার ছিল এক সম্পর্কে
র নানা । তো নানা মাঝে মাঝে বলত , অমুকের বাড়িতে এই চিঠিটা পাঠায়ে দিস । গ্রামের সবাই সবাইরে চিনে । তো আমরাও দিয়ে আসতাম । তো আমার বান্ধবী ছিল , লাভলি । এটা ছিল শয়তানের হাড্ডি ।
আমারে একদিন আইসা বলতেছে , "জানস ভাই না ভাবীরে চিঠি লিখছে । আমি জিজ্ঞেস করলাম , "তুই পড়ছস" ? লাভলি বলল , "হ পড়ছি , ভাই যে ভাবীরে কি লিখে " , ঐদিন থেকে শুরু , আমরা লোকজনের প্রেমের চিঠি পড়তাম । এমনকি গ্রামে কার চিঠিতে এমন লেখা থাকতে পারে , সেইভাবে আমরা একশন নিতাম ।
অ্যাকশনের গল্প আরেক দিন করা যাবে । আজকে অন্য কথা বলি ।
চিঠি জিনিসটা আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগে । আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান না দুর্ভাগ্যবান বলব জানি না । আমি আমার ছোটবেলায় , নিজ হাতে কিছু চিঠি পোস্টও করেছি । চিঠি আবার ওজন করে দেখা হত । । সব চিঠিই বড় খালামনিকে লেখা । বড় খালামনি তখন নতুন চাকরিতে সিলেট বিয়ানীবাজারে জয়েন করেছে । আমি তখন সবে লেখা শিখেছি , পড়া শিখেছি । আম্মুর লিখে দেয়া কথাগুলো আমি লিখতাম । আমি থ্রি-ফোরে পড়ার সময় থেকেই বাংলাদেশে মোবাইলের হাতেখড়ি ।
চিঠির , জন্য জলছাপ দেয়া প্যাড দেখতাম । জলছাপগুলো হত ফুলের বা লেখা থাকত i love you
বিদেশে পাঠানোর জন্য যে খাম ছিল , সেটা ছিল সাদা , লাল নিল বর্ডার দেয়া ।
হলুদ রঙের খাম ছিল , ছোট করে সবুজ একটা জায়গায় স্মৃতিসৌধের ছবি থাকত ।নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে ডাক পিয়ন, রানার, পোস্টমাস্টার ও অন্যান্য কর্মচারী কর্মকর্তা মিলে ডাক বিভাগের লোকবল ছিল ৪০ হাজার। আসলেই সংখ্যাটা বেশ বড় ।
আমার মনে হয় , চিঠিতে রোম্যান্টিসিজম বেশি থাকে । মানুষের ভালোবাসা চিঠি খুল্লেই কেমন জানি বুকে ধক করে এসে লাগত । পরিবারের অনেককে একসাথে চিঠি দেয়া হত । সবার আলাদা আলাদা ভাগ থাকত । আবার এক চিঠিই হয়তবা পরিবারের কেউ একজন পড়ত , সবাই শুনত । আহারে কি দিন ছিল । চিঠিতে লিখত এভাবে , "তোমাk দেখার জন্য খুবই ইচ্ছা করতেছে " অথবা "Eতি তোমার সাবরিনা"
যারা সুন্দর প্রেমপত্র লিখতে পারত , তাদের বন্ধু সমাজে ছিল অন্যরকম ডিমান্ড । চিঠিতেই প্রেম হত তখন । হয়ত , বইটা পড়ার জন্য নিয়ে ফেরত দেয়ার সময় দিয়ে দিলাম একটা চিঠি
পত্র মিতালী একটা সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল । চিঠি লিখেই তখুন রেডিও তিভিতে গানের অনুরোধ করা হত ।
আমিও চিঠি পড়েছি মানুষের । কার ? আছে , এক আত্মীয়ার । বেশ বয়স । সেনাবাহিনী তে ছিলেন সেই আত্মীয়ার স্বামী । বেশ অনেকদিন পড় পড় বাড়িতে আসতেন । চিঠিই ছিল একমাত্র যোগাযোগ করার পথ ।চিঠির সম্ভাষণ ছিল এরকম , "প্রিয়তমা ভালবাসা নিও । নিও অজস্র ভালবাসার সৌরভ । আর তোমার কালো ঠোটে নিও চুম্বন ( ফিলিং মাইরালা) , তখন ছোট ছিলাম , অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় করে ফেলেছি । এখন এগুলার প্রশ্নই আসে না ।
ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চিঠি
১. হযরত মুহাম্মদ (স) এর লেখা রোমান সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে চিঠি ।
২.Martin Luther King, Jr এর লেখা LETTER FROM BIRMINGHAM JAIL
৩.ভিক্টর হিউগোর লেখা তার "লা মিজারেবল" এর কাছে লেখা চিঠি । হিউগো "লা মিজারেবল" এর কাটতি কেমন জানতে লিখে পাঠান "?" আর উত্তরে অসাধারন বুঝাতেউত্তর এসেছিল "!"
মজার ব্যাপার হচ্ছে , হিউগো কোন উপন্যাসে লেখা সবচেয়ে দীর্ঘ বাক্যটি তার লেখা । যাতে ৮২৩ টি শব্দ , ৯৩ টা কমা , ৫১টা সেমিকোলন ও ৪টা ড্যাশ ছিল । যা প্রায় তিন পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল ।
বাংলা চলচ্চিত্রে চিঠি নিয়ে কত গান আছে সেটা আমার ঠিক জানা নাই । তবে কিছু গানের কথা বলতেই হয় ।
১."উজান ভাটি" চলচ্চিত্রের
"বিদেশ গিয়া বন্ধু , তুমি আমায় ভুইল না
চিঠি দিও , পত্র দিও , জানাইও ঠিকানা "
২."অপরাধ" চলচ্চিত্রের সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া
"চিঠি দিও প্রতিদিন "
৩.“সত্যের মৃত্যু নেই” ছবিতে সাল্মান শাহের অভিনয় সেই বিখ্যাত গান
"চিঠি এল জেলখানাতে "
এত্ত আবেগ দিয়ে গানটি গেয়েছেন
৪."চিঠি লিখলাম ও লিখলাম তোমাকে"-এখানেও সালমান শাহ
৫ বাংলা চলচ্চিত্রে চিঠি নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় গান
"আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিও" -"তোমাকে চাই" চলচ্চিত্র এখানে শাবনুর ও সালমান শাহ ছিলেন ।
সিনেমার বাইরে চিঠি নিয়ে বা চিঠি শিরোনামের কিছু গান
১. "পত্র দিও" - জেমস
২. "চিঠি" -শিরোনামহীন
৩."শেষ চিঠি" - বাপ্পা মজুমদার
৪."লিখলাম চিঠি " -জেমস
এবার আসি চিঠি নিয়ে কিছু মুভির কথায়
১. The Notebook
২.Dear John
৩.Letters to Juliet
৪.The Letter Writer
৫.Mary and Max
বাংলা সাহিত্যে চিঠি তো রমরমা অবস্থানে । রবীন্দ্রনাথ তার ৮০ বছরের জীবনে প্রায় ৫ হাজারের বেশি চিঠি লিখেছেন । যা ছাপলে ১০ হাজার পৃষ্ঠা হবে । শুধু চিঠি নিয়েই তার বই আমার জানামতে " ইউরোপ প্রবাসীর পত্র " , "জাভা যাত্রীর পত্র" , "রাশিয়ার চিঠি" , "ছিন্নপত্র" ও শেষমেস "চিঠিপত্র" । রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও বৈষয়িক জিনিসপত্র ভালই বুঝতেন । সব কিছুর কপি রাখতেন । এমনকি চিঠিরও । আর তাই আমরা বিশাল এক পত্র সাহিত্যের ভাণ্ডার পেয়েছি।
সরাসরি , চিঠি হিসাবে কয়েকটা উপন্যাসের নাম না বললেই না । এগুলোকে পত্রোপন্যাস বলে । কাজী নজরুল ইসলামের "বাধনহারা" বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস । নিমাই ভট্টাচার্যের "মেম
সাহেব" আমার হৃদয় ছুয়ে যাওয়া ।সরাসরি চিঠি না লিখলেও , কিছু জায়গায় চিঠি সম্পর্কিত চরিত্র এসেছে । যেমন আমাদের পড়া "ডাক হরকরা বা "রানার" কবিতা ।
তসলিমার রুদ্রকে লেখা চিঠির কথা একটু বলতে হয় । চিঠির আবৃত্তি শুনতে
https://www.youtube.com/watch?v=al3Jg2ydAd8 এই লিঙ্কে জান ।
তবে রোম্যান্টিক চিঠির জন্য কাজী নজরুল ইসলামকে "বস" মানা ছাড়া উপায় নাই । এত সুন্দর করে চিঠি লিখেছেন , তা বলার অপেক্ষা রাখে না ।
ফজিলাতুন্নেসাকে না পেয়ে বেদনা বিধুর হৃদয়ের কবি নজরুল , কাজী মোতাহার হোসেন কে চিঠি লিখেছিলেন । এত সুন্দর করে লাইনগুলো লিখেছেন । কি যে লেগেছে তা বলার মত নয় । কি সুন্দর করে কাজী মোতাহারের সাথে তার বন্ধুত্বের গভীরতা বুঝিয়েছিলেন । আবার ফজিলাতিন্নেসার উদ্দেশ্যে লিখলেন ।
ফুলের কাটা ভুলে গিয়ে , তার উর্দ্ধে সে যেন ফুলের কথাই মনে রাখে frown emoticon
চিঠির আবৃত্তি শুনতে
https://www.youtube.com/watch?v=z6jNg2GKZWA
তার জীবনের প্রথম বিরহ এসেছিল নার্গিস কে বিয়ে করার মাধ্যমে । নার্গিসকে বিয়ে করার রাতেই তিনি চলে আসেন নার্গিস কে রেখে । কি অজানা কারনে । প্রায় ১৬ বছর কবির সাথে নার্গিসের কোন যোগাযোগ ছিল না । অনেক দিন পর নার্গিস কবিকে চিঠি লিখেন । চিঠির উত্তর দেন কবি একটি গান লিখে ।
“যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে্।।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে্।।”
তবে যে কথাটা বরাবরই আমাকে ছুয়ে যায় সেটা হল
"তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি—আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি "
এটাই হল ব্যাথা , কবি বলে কথা