মায়ের একমাত্র সন্তান মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (আজাদ)। সবার কাছে আজাদ নামেই পরিচিত ছিলেন। মায়ের একমাত্র আদরের সন্তার। জন্ম ১১ জুলাই, ১৯৪৬। বাবা তৎকালীন সময়কার ধনাঢ্য ব্যাক্তি ইউনুস আহমেদ। বাবা ২য় বিয়ে করায় মা ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান।
এইচএসসি'র পর করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক থেকে এম এ সম্পন্ন করেন।
মুক্তিযোদ্ধ শুরু হলে দেশকে স্বাধীন করতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজেকে উৎসর্গ করে দিতে মোটেও কুন্ঠাবোধ করেন নি এই সাহসী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে বেশ বড় বড় কয়েকটা অপারেশনে তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন।
বন্ধুদের সাথে সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অভিজান যার মধ্যে ছিল অন্যতম একটি কঠিন মিশন। যা তিনি সহ উনার বন্ধুরা সাফল্যের সাথে জয়লাভ করেন।
৩০ শে আগস্ট রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় বাড়ি ঘেরাও করে তাকে , জুয়েল , সাংবাদিক আবুল বাশার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী।
মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য বের করার জন্য এমন কোন প্রকার টর্চার নেই যা তার উপর প্রয়োগ করা হয়নি। শত কষ্টের মধ্যেও তিনি মুখ খুলেন নি। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে দেশের জন্যে নির্মম অত্যাচার সব সহ্য করে গেছেন।
মা ছেলের সাথে দেখা করতে আসলে ছেলে মাকে দেখে বলে উঠেঃ
"মা দুদিন ভাত খাইনি , ভাত নিয়ে এসো"
পরের দিন গিয়ে মা আর ছেলেকে পান নি। পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর নির্মম অত্যাচারও টলাতে পারেনি আজাদকে। আর তাঁর মুল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল জীবন দিয়ে। যার বিনিময়ে বাঙ্গালী ছিনিয়ে আনে স্বাধীন এক দেশ "বাংলাদেশ"
জীবনে কোনোদিন মা আর ভাত মুখে নিতে পারেন নি। ছেলেকে ভাত খাওয়াতে না পারার কষ্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সেই দুঃখে কোনদিন আর ভাত মুখে দিতে পারেন নি শহীদ আজাদের মা। ১৯৮৫ সালে শহীদ আজাদের মা মারা যান।
ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে পড়ার সময় দেশের স্বাধীনচেতা মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য প্রচন্ড উত্তপ্ত তখন মায়ের কাছে লেখা আজাদের চিঠি হুবুহু তুলে ধরলাম।
মা,
কেমন আছ?আমি ভালো ভাবেই পৌছিয়াছি। এবং এখন ভালোই আছি।হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে।রীতিমত ক্লাস হচ্ছে। পরীক্ষা শীঘ্রই হইবে। দোয়া করো। তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। আমি নিজে বা কি ধরণের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না। আচ্ছা মা তুমি বল তো আমি সব দিক থেকে কি ধরণের মানুষ। আমি তোমাক আঘাত না দেয়ার চেষ্টা করি। তুমি আমার মা দেখে বলছি এবং তোমার মত মা পাওয়া দুর্লভ। এই বিংশ শতাব্দিতে তোমার মত মা যে আছে কেহ বিশ্বাস করবেনা। আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি। তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজার জন্য নয়। যদি কোনদিন পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় নাম করবো। যদি হতে পারি পৃথিবীর সবাইকে জানাবো তোমার জীবনি, তোমার কথা। আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি।
ইতি
তোমার ছেলে আজাদ
শেষ কয়েকটা লাইনের দিকে একটু খেয়াল করতে অনুরোধ করছি। আজাদ তাঁর মাকে বলে গিয়েছিলেন কোনদিন বড় হতে পারলে তাঁর মায়ের জীবনি সবার কাছে বলে যাবেন। আজাদ বড় হয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় মানুষদের একজন। যার রক্তের বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ। আজাদকে কাউকে বলে যেতে হয় নি তাঁর মায়ের কথা। তাঁর জীবন দিয়েই তিনি সবার মাঝে তিনি তাঁর মায়ের কথা বলে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর মায়ের স্বাধীনতার জন্য , তাঁর মাকে শত্রুসেনা থেকে রক্ষার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের ভালোবাসায় অটল। যার মুল্য তাঁকে দিতে হয়েছিল তাঁর জীবন দিয়ে। আর তাঁর বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ।
এরকম লাখো আজাদের রক্তের বিনিময়ে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা শ্বাস নিতে পারছি। আজাদদের কথা , গল্প লিখে শেষ করা যাবে না।
বেশ কয়েকদিন আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এরকম কয়েকজনের জীবনি পেয়েছিলাম। তাঁর মধ্যে আমি আজাদেরটা লিখে আনার চেষ্টা করেছিলাম। জাদুঘরে এরকম আরো অসংখ্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জীবনি লিখা আছে। লেখক হিসেবে ভালো নয় বিধায় খুব ভালো করে আবেগ দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারি নি। কিন্তু আমি আপনাকে হলফ করে বলতে পারি ঠিক ওই জায়গাটাতে গিয়ে যদি একবার আজাদ সহ আরো কয়েকজনের জীবনি পড়েন আপনার চোখ টলটল করবে। হয়তো বা কেঁদে দিবেন।
আমরা স্বাধীনতার কথা বলি । মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি। বলি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা। আমাদের অনেকের মাঝেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো রয়ে গেছে সেই স্কুল লেভেলে পড়ে আসা কিছু লেখার মাঝেই। হয়তো বা এই তরুণদের আমাদের অগ্রজরা সম্পূর্ণ ইতিহাস জানার সুযোগ করে দিতে পারে নি কিংবা সেইভাবে স্পৃহা জাগিয়ে দিতে পারে নি। হয়তো সুযোগ ও স্পৃহা জাগানোর প্রচেস্টা এখনো বিদ্যমান। আমরা তরুণরাই হয়তো মুক্তযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে এতটা আগ্রহ বোধ করি না