মুমিনদের জন্য আখিরাতে দিবসে জাহান্নাম থেকে বাঁচার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হবে তাকওয়া। আল্লাহ পাকের মুমিন বান্দাগণ সবসময় অন্তরে তাকওয়া ধারন করে থাকেন। যে জিনিসটা মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রে এত বড় ভুমিকা পালন করবে, সেই জিনিসটা শিখবার জন্যও মানুষকে কিছু সময় দেয়া অবশ্যই দরকার। রমজান মাস যে শুধু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকবার জন্যই দেয়া হয়েছে তা কিন্তু নয়। রমজান মুসলমানদেরকে দেয়া হয়েছে এই জন্য যে, তারা যেন মুত্তাকী হতে পারে, তাকওয়া শিখতে পারে।
আমরা একটু যদি চিন্তা করি তাহলে খুব স্পষ্ট হয়ে যাবে কিভাবে রমজানে নিভৃতে এই পুরো মাস জুড়ে তাকওয়ার ট্রেইনিং দিয়ে যাচ্ছে মুমিনদের। আর একমাত্র চিন্তাশীলরাই মহান আল্লাহ পাকের এই মহা পুরষ্কারকে সানন্দে গ্রহন করে থাকে রমজান মাস জুড়ে। যখন মুমিনের নিকট পরিষ্কার হয়ে যায় আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত কেন মুমিনদের এই রমজান দান করলেন, তখন এর ফল পাবার জন্য মুমিন আরও ব্যাকুল হয়ে পড়ে, নিজেকে বিলীন করে দেয় এই মহান শিক্ষা গ্রহনে যা কিনা পরবর্তী ১১ মাস তাঁকে দ্বীনের উপর অবিচল থাকতে সহায়তা করে।
রমজান মাস। ভর দুপুর। সারাটা সকাল বাহিরে কাজ করে এসে প্রচণ্ড ক্লান্ত শরীর। পিপাসায় গলাটা একদম শুকিয়ে এসেছে। সামনেই টেবিলের উপর ঠাণ্ডা পানির পাত্র। চোখে দেখাটুকুন ই সার। হাত বাড়িয়ে নেবার কথাটুকুন একবারের জন্য মনেও এলনা। ক্ষুধাও যে লাগেনি তা নয়। দশ কদম হাঁটাও দায় হয়ে পড়ছে। হাতের কাছেই দেখা যাচ্ছে তাজা খেজুর সাজানো, পাশেই আবার নানা পদের মিষ্টান্ন। ১০০ ভাগ হালাল। খাওয়া সম্পূর্ণ জায়েজ। হালাল পয়সার কামাই। তারপর ও শরীর, মন সব কিছুই যেন এর বিরুদ্ধে। অবাক ব্যাপার। অন্য কোনদিন দিন তো এরকম হয় নাই।
বুঝে দেখুন তো! হালাল রিজিককে ইসলাম কতটুকুন গুরুত্ব দিয়েছে! এমন যে যদি কারও পেটে হারাম খাবার যায় (সে হতে পারে হারাম খাবার অথবা হালাল খাবার যা হারাম উপার্জন দিয়ে কেনা) তার দুয়াই কবুল হবে না। কথা শুনতে অনেক সহজ মনে হলেও এর আভ্যন্তরীণ মর্মার্থ অনেক কঠিনই বটে। আপনি আল্লাহ্র দরবার থেকে নেবার একমাত্র উপায় হল দুয়া। এ ছাড়া নেবার অন্য কোন রাস্তা নেই। নেই নেই। সে রাস্তাটাই আপনার আমার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হালাল খাবারের অভাবে। বুঝুন তাহলে। এখন প্রশ্ন হল, যদি হালাল খাবারের এতটাই মর্যাদা তাহলে রমজান মাসে আল্লাহ্ আপনার জন্য এই খাবারটা বন্ধ করলেন কেন? আল্লাহ্ তো শুধু হারাম খাবার বন্ধ করলেই পারতেন। নাকি আল্লাহ্ আমাদের না খেয়ে থাকার ক্ষমতা দেখতে চান? এটা তো ঠিক যে মুমিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকে এক আল্লাহ্র হুকুম পালনের জন্যই। কিন্তু তাকওয়ার শিক্ষা এখানে নয়। একজন মুসলমান যদি রমজানের ভিতর কেবল আল্লাহ পাকের আদেশ পালনের জন্য যদি সম্পূর্ণ হালাল জিনিস থেকে বিরত থাকতে পারে, তাহলে রমজানের বাহিরে সে কিভাবে কোন হারাম জিনিসের দিকে হাত বাড়াতে পারে! শিক্ষাটা হল এই জায়গায়। রমজান মুসলমানকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে তার ক্ষমতা। দেখিয়ে দেয় যে তার সেই শক্তি আছে হারাম থেকে বাঁচবার। তাহলে রমজানের বাহিরে সে এই অজুহাত কখনই দেখাতে পারবে না যে আমি তো দুর্বল হারাম থেকে বাঁচবার ক্ষেত্রে। রমজানের এই সবক যদি কেউ দিল দিয়ে গ্রহন করে তবে তার তাকওয়া শেখার জন্য এক মাসই যথেষ্ট।
সাহরি রমজানের মাঝে আল্লাহ পাকের একটি হুকুম। এই সাহরি খাওয়ার মাঝেও মুমিন মুসলমানদের জন্য তাকওয়া শেখার বিরাট ইঙ্গিত রয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানগণ রাত্রির শেষ ভাগে সাহরি খাবার জন্য উঠে থাকেন। পুরো একটা মাস জুড়ে খুব কম মুসলমান ই রয়েছেন যাদের সাহরি ছুটে যায়। এক সাহরিতে উঠবার জন্যই মানুষ কত ব্যবস্থা করে রাখে। আমার নিজেরও দুই দিন সাহরি ছুটে যাওয়াতে বেশ কষ্ট হয়েছে। কষ্ট এইজন্য নয় যে রোজা রাখতে পেরেশানি হবে (আল্লাহ্র রহমতে টানা দুইদিনও না খেয়ে থেকেছি কোন কষ্ট ছাড়া), কষ্ট ছিল সুস্বাদু খাবার হাতছাড়া হয়ে গেছে। আল্লাহ্ মাফ করুন। সামান্য খাবারের জন্য এই দিলে এত চোট! এখন আমাদের অবস্থা অনেকটা এরকম যে আমরা সাহরি খাই এজন্য যে পরদিন যেন রোজা রাখতে কষ্ট না হয়। অবশ্য এইটাও সাহরি খাবার উদ্দেশ্যের মাঝেই পড়ে। বলার কারণ এই যে, আল্লাহ্র হুকুম সাহরি খাওয়া এইটা কজনেরই বা আর মনে আসে!
মুমিনদের জন্য বহু চিন্তার খোরাক রয়েছে এই সাহরি খাওয়ার মাঝেই। এইখানে আভাশ টা অনেকটা এরকম, হে মুসলমান! রমজানের এই একটি মাস তুমি যদি কেবল খাবার জন্য মাঝ রাতে বিনা বাধায় উঠতে পারো, তবে রমজানের বাহিরে মাঝ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজের জন্য উঠতে তোমাকে কি বিরত রাখছে। রমজান মাসে তুমি নিজেই প্রমান করেছ শেষ রাত্রিতে উঠবার মত যথেষ্ট প্রাণশক্তি তোমার মাঝে রয়েছে। তাহলে কেন মিছে বাহানা দিয়ে তুমি সেই সময় উঠতে পারনা যখন কিনা স্বয়ং পাক পরওয়ারদেগার তোমায় ডাকতে থাকেন। তাহাজ্জুতের সময় কি তোমার কাছে এক থালা ভাতের চাইতে ছোট হয়ে গেল! নিজেই বুঝে দেখুন তো! আমি আসলেই সাহরি খাবার সময় কোন অলসতা অনুভব করি কিনা। এই ১০ মিনিটের সামান্য খাবার জন্য আমার প্রস্তুতি কত বড় থাকে!
রমজানের এই শিক্ষা যদি কেউ দিল দিয়ে গ্রহন করতে পারে, তবে তার মুত্তাকী হবার জন্য এই একটি মাস ই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ১:০৪