হাজারো বারের নেশায় আর শত বারের ভালোবাসায় মাত্র কয়েকবার হিমু হতে চেয়েছিলাম। পারি নাই। না হতে পারার কারণ তেমন জটিল নয়। কালো মানুষ। গায়ে হলুদ মানায় না। যার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাঞ্জাবি বানাব সেই আম্মাজান ও তার কালো মানিক কে হলুদে দেখতে রাজি নন। মনকে বুঝালাম, হিমু হতে হলে যে হলুদ পাঞ্জাবি ই পড়তে হবে এমনটা নয়। খালি পায়ে হাঁটলেও হিমু হওয়া যায়। চেষ্টা করলাম। এইটাও হল না। এই কারণটাও খুব জটিল নয়, তবে বলবার মতও নয় আর কি। কারও ইচ্ছা থাকলে চেষ্টা করে দেখুন। বুঝে যাবেন। মনকে আবার বুঝালাম, হিমু হতে হলে যে কেবল খালি পায়েই হাঁটতে হবে তা কিন্তু নয়। রাতের বেলা গহীন বনে বিশেষ কিছু নিয়ম ফলো করে জ্যোস্না দেখলেও হিমু হওয়া যেতে পারে। বিশেষ নিয়মটা আমার মনে হয় বিশেষভাবে বলবার প্রয়োজন নেই। যারা কোন এক গভীর নিদ্রা রাতে ময়ূরাক্ষীর তীরে আজলা ভরে জল খেয়েছে, তারা ঠিকই স্বপ্ন দেখেছে মধুপুরের শালবনে কোন এক জ্যোস্না বেলায় কোন এক ক্ষণে কোন এক কোণে মাটিতে ইয়া বড় গর্ত করে বসে হা করে চাঁদের আলো খাবার। সাহস করলাম ঠিক সেভাবেই জ্যোস্না দেখার। পারলাম না। পূর্বের মতই এই কারণটাও খুব জটিল নয়। আমি প্রচণ্ড ভূতের ভয় পেতাম আর কি। আবারো মনকে বুঝালাম, হিমু হতে হলে যে ঠিক বনে গিয়েই জ্যোৎস্না দেখতে হবে তা একেবারে ঠিক নয়।
এবার আমি পড়লাম মহা চিন্তায়। কিছুই তো আমার দ্বারা হচ্ছে না। তাহলে কি আর হিমু হওয়া হল না শেষমেশ! অনেক ভাবার পর, অনেক সাহস যোগানোর পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, রূপা ছাড়া হিমু অচল। আমার মত অচল হিমুকে চালাতে হলে একজন রূপা দরকার। অবশ্যই দরকার। সেই রূপা যার সাথে আমার দেখা হবে প্রচণ্ড গরমের কোন এক দুপুরে। যে রূপা তার রূপের অহমিকায় কোন ছেলের সাথে ঠিকভাবে কথা বলে না। এক দুপুরে সে তার প্রাইভেট কারটা থামিয়ে রাস্তার পাশ থেকে আখের রস খাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি গিয়ে তার মোবাইল নম্বরটা চাইব। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকবে।
পরক্ষনেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলবে, নাম্বারটা কি আপনার খুব প্রয়োজন?
অন্য মেয়ে হলে বলত, আমি আপনাকে নম্বর কেন দিব? আমি তো আপনাকে চিনি না।
এইজন্যই সে রূপা। হিমুর রূপা।
আমিও একটা অর্থহীন হাসি হেসে বলব, জী না। এক্কেবারেই প্রয়োজন নেই। তবে থাকলে আজ রাত বারোটায় ফোন করে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতাম। আপনার জন্মদিনের জন্য।
এবারের ধাক্কাটা কাটাতে রূপার বেশ কিছুক্ষণ লেগে যাবে। রূপা তার জন্মদিন কাউকেই জানায় না। আমি অনেকদূর হেঁটে চলে যাব। সে আমাকে পিছন থেকে ডাকতে চেয়েও ডাকবে না।
সেই রূপা যার বাসার কোন নাম্বার থাকবে না আমার কাছে। আমি এমনি এমনি একটা নাম্বার ডায়াল করব। সেইটা চলে যাবে রূপাদের বাসায়। রূপার বাবা ধরবে।
“হ্যালো!”
“হ্যালো, এইটা কি রেলওয়ে বুকিং?”
বেশ গম্ভীর গলায় আওয়াজ আসবে, “জী না! রং নাম্বার!”
ওপাশ থেকে ফোনটা রেখে দেবার আগেই কেউ একজন দৌড়ে এসে ফোনটা ধরবে।
দুপাশ থেকেই অনেক্ষন কোন কথা হবে না। রাতটা হবে ভরা জ্যোৎস্নার।
এরপর থেকে অনেকদিন দুপুর বেলায় রাস্তার পাশে বহু আখের রসের দোকানে বসে থেকেছি। প্রচণ্ড গরমে গায়ের রং কালো থেকে কয়লা হয়ে গেছে। এরকম গরমকে খাঁটি বাংলায় বলে “কুত্তা পাগলা গরম”। এই সুবাদে বহু আখের রস ওয়ালাদের সাথে সখ্যতা হয়ে গেছে। খাতিরের কারনে অনেকের মোবাইল নম্বরও নিয়েছি। কেউ জোর করে দিয়েছে। কিন্তু যার জন্য বসা তার দেখা একেবারেই পাওয়া গেল না।
অবশেষে মোবাইল থেকে দু তিনটা নাম্বারে এমনি এমনি কল দিলাম। এইটাও হল না। কেন হল না এই কারণটাও খুব বেশি জটিল নয়। আবার বলবার মতও নয়।
আমি মনকে এবার বুঝালাম, যে আমার দ্বারা হিমু হওয়া সম্ভব নয়। পাক্কাপাক্কি না। এই ধান্দা বন্ধ। পাক্কাপাক্কি বন্ধ।
প্রায় আধা যুগ পর মাথায় আবার ভুত চাপল। চাপার একটা কারণও ছিল। হুমায়ূন আহমেদ স্যার মারা যাবার পর বেশ কষ্ট লাগলো। স্বাভাবিকভাবেই সবারই কষ্ট হয়েছে স্যারের চলে যাওয়াতে। আমি স্যারের হিমুর বেশ বড় একজন ভক্ত ছিলাম। স্যারের মারা যাবার খবরটা জানতে পেরেই সিদ্ধান্ত নিলাম পুরানো আকাংখা পূরণের। তবে এবার আমি বয়সে অনেক পরিপক্ক আগের চাইতে। এবার নিজেই টাকা কামাই। ভালই কামাই। তাই হলুদ পাঞ্জাবীর জন্য কারও কাছে হাত পাততে হবে না। ভূতের ভয়ও চলে গেছে বেশ খানিকটা। তারপরও কেন জানি সাহস পেলাম না। এবার অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি না হতে পারি হিমু। কিন্তু আমার কলমের খোঁচায় একটা হিমুকে রাস্তায় নামিয়ে দেখি! চেষ্টা করে লিখে ফেললাম। শখ করে পোস্ট করে দিলাম ব্লগে। প্রথম পর্বে পাঠকদের অতি উচ্চদরের প্রশংসা দেখে আরও এক পর্ব লিখে ফেললাম। গুনে গুনে তিন পর্ব শেষে............ আর হচ্ছে না। না হবার কারণটাও খুব জটিল নয়। এই কারন সবাই বুঝে নেবার মত।
আমি নিজেকে বুঝালাম, হিমুকে শুধু ভালোবেসে যেতে হয়। কারন হিমু শুধু একজনের কলমের জন্যই সৃষ্টি, হিমু শুধু একজন রূপার জন্যই, হিমুর হলুদ পাঞ্জাবিও একটা, অনলি ওয়ান পিস, হিমুর পায়ের মাপের কোন স্যান্ডেল হয় না! আর সেই ময়ুরাক্ষী! সেটাও কোন এক ধু ধু প্রান্তরে জ্যোৎস্নায় একাকী ভিজে একাকার হয় আজও!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪৯