somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত স্বপ্নগুলো

০২ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আচ্ছা মানুষগুলো সব এরকম কেনো? সবসময় নিজের কথা ছাড়া অন্য কিছু ভেবে দেখে না।

তখন বিকেল ঠিক তিনটে হবে। দুপুরের খাবার খেয়ে ভার্সিটির পুকুর পাড়ে মেহগনি গাছটার নিচে হেলান দিয়ে বসে আছি। শিথি মেয়েটার সাথে কালই আবার একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। মেয়েটা জেদি অনেক। এই মেয়েটাকে আমি বোঝাতে পারিনা যে আমি প্রেম করার মত মানুষ নই। তাছাড়া এতো এতো সুন্দর পয়সাওয়ালা ছেলেপেলে থকতে এই মেয়ে আমার পেছনে যে কেনো পরেছে বুঝছি না। এখন আবার এসে সে উপরের কথাটি বললো।

ওর দিকে তাকালাম। কিছু না বলেই তাকিয়ে আছি। এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও বললো,
“আমি দেখেছি। তখন বন্ধুদের সাথে কি যেন বিষয় নিয়ে তর্ক হচ্ছিলো। এর কিছু পরেই তুমি চলে এলে।”
‘তোমার কেনো মনে হলো যে আমরা তর্ক করেছি? আমরা তো আলোচনাও করতে পারি তাই না?’
“হ্যা পারো তবে তুমি কি জানো তোমার কিছু বন্ধু তোমাকে ব্যবহার করছে?”
‘না জানিনা। আর হলেও তোমার সমস্যা কি বলোতো?’
“কিছু না। আমার মনে হলো তাই বললাম।”
‘বলা হয়ে গেলে যেতে পারো।’
“কেনো এখানে এসে তোমার কি সমস্যা করছি? এটা কি তোমার জায়গা নাকি?”
‘এই মেয়ে এই, তোমার সাথে ঝগড়া করার কোন ইচ্ছে নেই বুঝলে। আচ্ছা তুমি কি আমার কথা গুলো বোঝনা?’
আহ্লাদী স্বরে ও বললো,
“আমি বুঝি তোমাকে তাই তো তোমাকে আগলে রাখি। কিন্তু তুমি আমাকে একটুও বোঝনা আর সবসময় বোকা দাও, হুহ।”
মুখ ভেঙচিয়ে আমি বললাম,
‘ওললললে, তোমার এতো লুতুপুতু কথা নিজের কাছে রাখো বুঝলে। এতো সময় আমার নেই। ধুর মেজাজটাই খারাপ হচ্ছে। এই তুমিই থাকো তো, আমি যাই।’

চলে আসার সময় ওর মুখের মিস্টি হাসিটা আমার চোখ এড়ায়নি। ওর সাথে প্রথম দেখা হয় ভার্সিটির বিতর্ক ক্লাবে। নবীন বরন করছিলো ক্লাবটি। ওই প্রোগ্রামেই আবার আমাদের একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা ছিলো। শিথি ছিলো তখন ভার্সিটিতে নতুন। আমরা এক সেমিস্টার উপরে ছিলাম। অনুষ্ঠানে বিতর্কে আমরা হেরে যাই। তাই একপাশে বসে বসে যখন ভাবছিলাম কেনো হারলাম তখনি শিথি এসে আমায় বলে,
“অনেক ভালো বিতর্ক করেছেন আপনি। একটু ভাগ্য খারাপ ছিলো তাই হয়তো হেরে গিয়েছেন। পরেরবার অবশ্যই জিতবেন এই দোয়াই করি।”
আমি ওকে জিজ্ঞেস করি,
‘আপনি কি নতুন? মানে আপনাদেরই বরন করা হচ্ছে আজকে?’
তখনি ও ডান হাত বাড়িয়ে বললো,
“আমি শিথি। আপনি নিশ্চয়ই মামুন?”
আমি জি বলে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তখনি ও বললো,
“এতো ভাবার কিছু নেই। আপনার নাম আপনাকে ডাকার সময় শুনেছি।”
মুচকি হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। এর পরে তো দিন যেতে লাগলো। আর শিথির সাথে বেশি বেশি দেখাও হতে লাগলো। আমিও টুকটাক কথা বলতে শুরু করি। কিন্তু সমস্যা হলো সেদিন, যেদিন এক বন্ধু বললো, আচ্ছা এই মেয়েটা সবসময় তোর পেছনে পরে থাকে কেনো? কিছু চলছে নাকি তোদের ভেতর?
আমি কথাটা উড়িয়ে দিলেও ভাবলাম যে আসলেই তো। এই মেয়েকে সবসময় আমার আশেপাশেই দেখি কেনো? ক্লাস কি করেনা নাকি?

একদিন ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছি বন্ধুরা মিলে। এমন সময় এই মেয়ে এসে হুট করে বলে,
“আজ আমার জন্মদিন।”
কথাটা শুনে আমার সাথে আমার বন্ধুরাও ওর দিকে তাকিয়ে উইশ করলো। আমি বসতে বললাম সামনের চেয়ারে। ও বসলে আমি বললাম,
‘তোমার জন্মদিন তা তো জানতাম না আমি। তবে এখন যেহেতু জেনেছি সেহেতু তোমাকে তো কিছু একটা দিতে হয়। তাই বলো কি খাবে? আজ আমার থেকে ট্রিট।’
“যদি অন্যকিছু চাই, দিবেন?”
‘মানে?’
মেয়েটা তখনই চেয়ার থেকে উঠে সামনে এসে একটা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে আমায় বললো,
‘একটু ভালবাসবেন আমায়। আপনাকে শুধু ভালবাসি বললে ভুল হবে। আপনাকে ছাড়া আমার বিচরন যেনো আমি নিজেই বুঝতে পারি না। প্রথম দেখার পর থেকেই আপনাকে কেমন যেনো ভাবতে ভালো লাগে। আপনার কথা বলার ধরনটাও ভালো লাগে। আপনার পাশে হাঁটার অনেক বেশি ইচ্ছে। হাঁটবেন কি আমায় পাশে নিয়ে?’

মেয়েটা রীতিমতো প্রপোজ করলো আমায়। আমি কি বলবো বুঝছি না। ওর সাথে আমার বন্ধুরাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমি কি বলবো শোনার জন্য। মেয়েটাকে নিয়ে তো এভাবে ভাবিই নি। আবার মেয়েটার আজ জন্মদিন। সরাসরি না ও তো আর বলতে পারি না। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওকে দাড় করালাম। ওকে নিয়ে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে একটা কফিশপে এলাম। দুটো কফির অর্ডার দিয়ে ওকে বললাম,
‘খুব বেশিদিন না আমরা পরিচিত। আসলে তোমার সমন্ধে আমার যা এখন পর্যন্ত ধারনা তা হলো,তোমার পছন্দ খুবি খারাপ। তুমি আমাকে প্রপোজ করেছো এটা চিন্তা করেই আমার কেমন লাগছে। আরে কোথায় আমার মতো মামুন তোমার পিছু পিছু ঘুরবে তা না হয়ে তুমি আমায় প্রপোজ করলে?’

মেয়েটা দেখছি ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে মাথা নিচু করে আছে। মাঝে মাঝে যখন চোখ উপরে তুলে আমার চোখে চোখ পরছে তখন আবারও মাথা নিচু করছে। আমি বললাম,
‘শোনো মেয়ে, তুমি দেখতে শুনতে অনেক অনেক ভালো। বলতে পারো আমার মতো ছেলেদের কাছে তুমি স্বপ্ন। তাই বলছি এই কয়েকদিনে আবেগে পরে ভুল করো না। তোমাকে না বলার যোগ্যতাটাও আমার নেই। হ্যা তো দুরের কথা। তুমি আমার থেকে অনেক ভালো কাউকে পাওয়ার যোগ্য। তাই বলছি, একটু সময় নাও দেখবে তোমার পেছনেই সবাই ঘুরঘুর করছে। এখন ভালো কিছু খাওয়ার অর্ডার করো। জন্মদিনে ভালোমন্দ খেতে হবে তো।’
মেয়েটা কিছু না বলছে না। আমি নিজে থেকেই পিৎজা অর্ডার করে দুজনে একসাথে খেলাম। মেয়ে মনে হয় পিৎজা পছন্দ করে। ভুল করে আমার সহ খেয়ে ফেলেছে। এরপরে দুদিন দেখা হলো না। আমিও ভাবলাম যাক, মনে হয় সে আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছে। এসব মনে করে নিজের মাঝেই একটা ভালো খারাপের মিশ্রিত একটা অনুভুতি কাজ করলো। মুচকি হেসে ভাবলাম, কি লাভ হতো আর?

এরপর তো দিন পার হয় তবে সময় থেকে যায় এমন অবস্থা। গতানুগতিক কাজের মাঝে দিন গুলো যেনো যান্ত্রিকতার স্বীকার। বেশ কিছুদিন পর ক্যাম্পাসে বসে আছি একা। নতুন সেমিস্টার সবে শুরু হয়েছে। কোন চাপ নেই বলা যায়। এরকম সময়ে আমার একা বসে সমসাময়িক জীবনী গুলো নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে। ভালো লাগে সবার জীবনী গুলোর সাথে নিজেকে যাচাই করতে। হঠাৎ শিথি এসে পাশে ধুপ করে বসে পরলো। আমি ভাবলাম হয়তো এমনিই এসেছে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাই। কিন্তু ও বললো,
“না হচ্ছে না। আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে আর ভালো লাগছে না।”
‘মানে, কি বলছো এসব?’
একটু চুপ থেকে ও বললো,
“এইকদিন চেষ্টা করেও পারিনি তোমাকে ভুলতে। কিন্তু হলো না। তুমি কি আমার বন্ধু হবে?”
‘এক মিনিট। তুমি কি আমাকে তুমি করে বলছো? আর ভুলতে পারোনি মানে কি? আর এখন আবার বন্ধু হওয়ার কথা বলছো যে?’
মেয়েটা কপট রাগ নিয়ে বললো,
“হবে কি না বলো? না হলে খারাপ কিছু হয়ে যাবে কিন্তু।”
‘কি খারাপ কিছু হবে? একটু ঠান্ডা হও প্লিজ।’
হাতটা বাড়িয়ে ও যখন আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে তখন কিছু না ভেবে হ্যান্ডশেক করলাম। মেয়ে মানুষ কখন কি করে ঠিক নেই। সেদিন ধরে ধরে অনেক কথা শুনিয়েছিল মেয়েটা। বন্ধু হওয়ার সুবিধা যেনে একদিনে নিয়ে ফেলবে সে। মেয়েটার মনে কি চলছে এটা ভেবেই ওর সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছিলাম।

এরপর তো আমার বন্ধুদের সাথেও তার ভালো সম্পর্ক হতে লাগলো। এতোদিন তো আড্ডা দিলে নানান বিষয়ে কথা হতো কিন্তু এখন কথার বিষয় হলো শিথি। এরকমটা হলেও হয়তো ঠিক ছিলো কিন্তু এর কিছুদিন পর আমার বন্ধুরাই আমাকে শিথির ব্যাপারে বোঝাতে লাগলো। আমি বোঝাতে পারলাম না তাদের যে আমি ওর ধরনের নই। ও আমার থেকে ভালো কাউকে পাওয়ার যোগ্য। আর আমি একটা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। এসব কিছু আমার সাথে যায় না। কিন্তু না। সবার মাঝেই শিথি আমাকে আবারও প্রপোজ করলে আমি মুখ নিচু করে চলে আসি। বন্ধুরাও তখন কেউ মিশতো না ঠিকভাবে। সবার যেনো এক অগাধ রাগ আমাকে উদ্দেশ্য করে। আমি কিছু বলিনি কাউকে। সময় গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে এই প্রমানহীন আশা নিয়ে নিজের মতো চলছি।

চলতে চলতেই তো অনেক কিছু শিখতে হয় আমাদের। কিন্তু আমার চোখে ধরাও দিয়েছে যে আমার এক বন্ধু আর শিথি ক্যাম্পাসে একসাথে বসে গল্প করছে। তাদের একসাথে দেখে আমার খারাপ লাগছে কেনো যেনো। ঠিক তা না যে শিথি হয়তো আমার বন্ধুর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে কিন্তু আমার বন্ধুরাই এখনো আমার সাথে ওভাবে কথা বলে না। এখন তো দেখি সবি নিজের বিপরীতে। হাসি পেলো আমার। এমন সময় আমার মতো ছেলেদের অনেক আসে। আমাদের মানিয়ে নিতে হয়। নিজেই নিজেকে বোঝাতে হয়। ক্যাম্পাসে এসব ভাবতেই কষ্টের এক হাসি মুখে নিয়ে আমি আবারও শিথি আর আমার বন্ধুর দিকে তাকালাম। ঠিক তখনি শিথির চোখো আমার দিকে পরলো। অনেকটা নড়েচড়ে বসলো ও। আমি হাসিটা ধরে রেখেই নিজের মাঝে কষ্ট নিয়ে উঠে পরি। শিথি ততোক্ষনে দাড়িয়ে গেলেও আমি চলে আসি।

রাতে ছাদে এসে বসে আছি। ভাবছি কাল আবার সবকিছু সাজাতে হবে। সব কিছু ভুলে নিজের উদ্দেশ্য পুরনে আবারও সজাগ হতে হবে। পরেরদিনে ক্যাম্পাসে এসে মাঠে বসলাম। ঐ একা বসে ভাবছি। তখনি দুজন বন্ধু এসে পাশে বসলো। এসে কেউ কথা বলছে না। আমিও বলছি না। পরে আরও চারজন আসলো। একটু পরে শিথি আর আমার ওই বন্ধুটাও আসলো। সেই এসে বললো, কেউ কি কিছু বলবি না? এটা বলতেই সবাই ধীরে ধীরে কেমন যেনো আমাকে জড়িয়ে ধরছে। বুকের ভেতরে একটা খারাপ লাগা ভর করেছিলো, সেটা হুট করেই কেটে গেলো৷ আমি শুধু ভাবছি আবারও ওই আড্ডা হবে। আবারও সেই এক কাপ চা ভাগ করে খাওয়া হবে। আবারও নিজেদের মাঝেই শিল্পদর্শন হবে। শিথির সাথে থাকা বন্ধুটা বললো, কাল শিথিকে তোর ব্যাপারেই বলছিলাম। ওকে বুঝিয়েছি আমি। আর ওইসময় তুই দেখে ফেলেছিস। দয়া করে অন্য কিছু ভাবিস না। আমি খুবই দুঃখিত।
আমি ওকে জড়িয়ে নিলাম। পাশে দেখলাম শিথি দাড়িয়ে আছে। আমার বন্ধুটাকে বললাম, ও কি বুঝেছে? শিথি এটা শুনে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। মেয়েটার সাথে কেনো এমনটা করছি জানিনা। ভেবেছিলাম এরপর হয়তো ও আমাকে ভুলে যাবে। কিন্তু ও লেগেই থাকলো। তারপর বন্ধুদের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হলো। আর এই তো আজকের কাহিনী।

কাল মুলতঃ ওদের সাথে একটু তর্ক হয়েছে একটা প্রজেক্ট নিয়ে। তর্ক হওয়ার পর বন্ধুদের মাঝেই অনেকটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। আজ সবাই একসাথে বসেও যেনো একে অপরের চোখে অপরাধী। কেউ নিজে থেকে সরি বলবেও না আবার সবাই মনে মনে দুংখিত বলছে৷ সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে আজ ওয়াদা করলাম যে আর যাই কিছু হোক আমরা এক থাকবো। সবাই তাই করলো। আর যাই হোক বন্ধুত্বের বন্ধন তো ঠিক আছে আমাদের।

ওদের সাথে আড্ডা শেষে শেষ বিকেলে একা বসে আছি ক্যাম্পাসে। জিবন কতই যেনো বিচিত্র আমাদের। চলমান ব্যস্ততায় আমরা সীমাবদ্ধ অথচ কতো দিগন্ত জুড়ে স্বপ্ন দেখি। এই আমাদের বন্ধুত্বে কত কিছুই না করেছি আমরা। কিন্তু পরিশেষে ওই একাই চলতে হয় মানুষের। বাস্তবতাও যেনো নির্মম আকাঙ্খা দিয়ে তৈরী। শুধু তার সাথে মানিয়ে চলতে হয়। হঠাৎ আবারও শিথি এসে পাশে বসলো। আমি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বললাম না। আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ও পশ্চিমের মৃদু লাল আভায় তাকালো। হাতটা জড়িয়ে বাহুতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। কেউই কিছু বলেনি কিন্তু অনেক কিছুই হয়েছিল তখন। অস্থির জিবনে হয়তো একটু স্বস্তি আবার কারও মনে কাউকে পাওয়ার শান্তি।

খুব জলদি স্বপ্ন দেখে ফেলে আমার মতো ছেলেরা। তাইতো না চাইতে নিজের স্বপ্ন বুনেছি শিথিকে নিয়ে। ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের ভাগ্যে তারা থাকে না। ভালবেসে ফেলেছি অনেক। স্বপ্ন সাজাতাম একে অপরের জন্য আমরা। দুজনার স্বপ্নেই কতো সুন্দর করে নিজেদের গুছিয়ে দিতাম। কিন্তু আসলেই কি তা হয়? ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে একটা স্কলারশিপ পেয়ে যাই আমি। শিথিকে নিয়ে অনেকবার কথা বলেছি যে যাবো কিনা। সে না করেনি কখনই আবার তার চোখে আমাকে হারানোর ভয়টাও দেখতে পেতাম। অন্যদিকে একটু ঝুঁকি নিয়ে যদি বাইরে থেকে ডিগ্রী নিয়ে আসতে পারি তবে দেশে ফিরে নিজেদের জিবনগুলো স্বপ্নের মতো করেই সাজানো যেতো। শিথি আমাকে এমনটাই বলেছিল। বলেছিল সে অপেক্ষা করবে। তার এই কথার ভরসায় আমি জার্মানিতে গিয়েছিলাম। পড়াশুনা সাথে পার্ট টাইম জব এসব নিয়ে যখন সময় পার করছি বিদেশে, তখন দেশে আমার স্বপ্নটাকে যে এভাবে মরে যেতে হবে ভাবতে পারিনি। জার্মনিতে দুবছরের মাথায় আমার এক বন্ধু জানায় যে শিথির বিয়ে হয়ে গেছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। এমনটা না যে আমি ভুল ছিলাম। নিজের মাঝে বস্তাভর্তি কষ্ট নিয়ে মধ্যবিত্ত ছেলেরা চলতে পারে তবে তাই বলে নিজের স্বপ্নগুলো কে নতুন করে সাজানোর সাহসটা যে হারিয়ে ফেলবো এটা ভাবিনি। আমাদের চলতে হয়। দেশে ফেরার কোন ইচ্ছে ছিল না তবে শুধু নিজের কথা ভাবলে তে আর হয় না। পরিবার বলে নিজের সবচেয়ে আপনজন কেউ আছে।

দেশে ফিরে নিজের সব ফিরে পেলাম। শুধু ফিরে পেলাম না নিজেকে। এদিকে ব্যস্ত শহরে এসে মোটামোটি একটা চাকরী করছি। পুরনো বন্ধুদের নিয়ে কেটে যাচ্ছে দিন। কি মনে করে একদিন বিকেলে ক্যাম্পাসে এলাম। পুরনো কিছু স্মৃতি মনে করার খুব ইচ্ছে হলো। কদম গাছটায় শিথির সাথে অনেক ভালো সময় কেটেছে আমার। কিন্তু আজ এসব দেখে কষ্ট হলেও ভালো লাগছে। কেনো যেনে মনে হলো যে মানুষ মাঝে মাঝে এই কষ্ট পেতেও ভালবাসে। এই যেমনটা আমার আজ ভালো লাগছে। কদম গাছের পাশেই হেলান দিয়ে বসে আছি। একটু পরেই শুনতে পেলাম,
’’কেমন আছো?’’

পেছনে ফিরে দেখি শিথি। সাথে ভার্সিটির শিক্ষকের ব্যাচ তার ঘাড়ে ঝুলানো। অবাক হয়েছি। আমি বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছি। অনেকক্ষন পর এটুকু বললাম,
‘কেউ কথা হয়তো রাখে না। তাই বলে কি সেই মানুষটাও রাখবে না যাকে নিয়ে আমরা জিবন আঁকি?’
চশমা খুলে চোখটা মুছে ও বললো,
“এই নির্মম বাস্তবতার জিবনে আমরা চেষ্টা ছাড়া আর কি বা করতে পারি বলো। তবে আমি কোন ত্রুটি রাখিনি কথা রাখার।”
একটু ভালভাবে তাকিয়ে বললাম,
‘শাড়িতে আপনাকে ভালো লাগছে মিসেস রহমান। আপনার স্বামীর নাম নিশ্চয়ই আহনাফ রহমান, তাই না?’
ও বললো,
“শুনবে না আমার ওই সময়ের কথাগুলো যা আমি বলার জন্য ছটফট করছি?”
‘সেসব শুনে কি আর লাভ আছে বলুন। আমি তো স্বপ্ন দেখি না আর।’
এ কথা শুনতেই সে হাতটা ধরে ক্যান্টিনে নিয়ে এলো। বললো,
“তোমার সাথে যোগাযোগ ছিল না তখন। এদিকে বাবা অসুস্থ হয়ে যায়। বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল আমাকে কারও হাতে তুলে দিয়ে যাওয়া। আমি রাগ করেছি কিন্তু হেরে গেছি একজন মেয়ে হয়ে। একজন প্রকৃত মেয়ের প্রথম ভালবাসা আর নায়ক যাই বলো না কেনো, সে হলো তার বাবা। আমার বাবা যখন আমার হাত ধরে বিয়ের কথা বলে আহনাফের সাথে আমি কিছুদিন কথা না বলে থাকলেও আমাকে বাবার কাছে হার মানতে হয়। আমি বাবাকে তোমার কথা সেরকম মুহুর্তে বলতে পারিনি। নিজেই নিজের স্বপ্নকে হত্যা করেছি আমি। ভেবে দেখতো আমার কি কষ্ট হয় নি? বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তবুও আমি শ্বশুরবাড়িতে যাই নি। ওই মানুষটাই আসতো মাঝে মাঝে। তারপর একদিন হুট করে ওই মানুষটা আমার সাথে বন্ধুর মতো মিশতে শুরু করলো। ওই মানুষটারই বা কি দোষ বলো। পারিনি নিজেকে আর অপরাধীর কাতারে রাখতে। আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেছি তাকে আর নিজের স্বপ্নকে ভোলার জন্য এখনো চেষ্টা করেই যাচ্ছি।”

অনেকটা চুপ থেকে বললাম,
‘তুমি চেষ্টা করেছো এটাই আমার জন্য অনেক। তবে এখন এই চোখের পানিটা তোমায় মানায় না। আমার প্রেয়শী যদি অন্য কারও জন্য কাঁদতো তাহলে আমি মানতে পারতাম না। তাই আমি চাই না আহনাফ সাহেব এটা সহ্য করুক। তাই তোমাকে আগের সবকিছু ভুলতেই হবে। উপরআলা হয়তো চায়নি আমরা একসাথে থাকি।’

“আমাকে ক্ষমা করা কি যায়? আমি আমার কথা রাখতে পারিনি।”

‘সত্যি বলতে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের সাথে সেটাও মিলিয়ে গেছে। এখন আমি আর স্বপ্ন দেখি না। তবে আমাদের আর পুরনো কথা না ভাবাই উচিৎ। ভেবে দেখেছো, একসময় আমি তোমার থেকে দুরে থাকতে চাইতাম। কারন আমি কষ্টের ভাগীদার হতে চাই নি। কিন্তু পারিনি তোমার ভালবাসা কে উপেক্ষা করতে। পারিনি তোমার মায়াভরা চোখটাকে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু আজ আমাদের দুজনকে উপরআলা আবারও বুঝিয়েছেন যে, তোমরা কি চাও তা কিছুই না বরং আমি যা চাই তাই হয়। হয়তো এটাতে কারো ভালো ছিলো।’

নিজের কান্না আটকিয়ে শিথি বললো,
“নিজেকে কি গুছিয়ে নেওয়া যায় না? এবার একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। দেখবে সুখে থাকবে অনেক।”

‘হাহাহা, বিয়ে। করতে তো হবেই। নিজের জন্য তো আর পরিবারের ইচ্ছেকে মেরে ফেলতে পারি না। তবে তোমার অভাবটা আমায় কোন এক মধ্যরাতে জাগিয়ে তুলবে। সেদিন হয়তো নিজের বউকে সান্নিধ্যে নিয়েই রাত পার করবো তবে কোন একটা সময় মনে হবে যে তুমি হলে হয়তে আরও ভালো হতো সবকিছু।’

“আমার এটা সবসময় মনে হয় তবে আমি চাই না ওই মানুষটাকে ঠকাতে। আমরা নাহয় বন্ধু হয়ে নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখলাম। শুধু তুমি নিজের মনে আমার প্রতি কোন বোঝ চেপে রেখো না।”
‘হাহা, নাহ। এমন কিছুই না। তবে আজ কষ্ট খুজতে এসে তোমায় পেয়েছি। ভার্সিটির স্মৃতিগুলো যেনে ছড়িয়ে আছে।’
“আমিও একারনেই এই ভার্সিটিতেই শিক্ষকতা করেছি। যেনো সেই স্মৃতিগুলো জড়িয়েই বাঁচতে পারি।”
‘আমাদের পথচলা হয়তো এ পর্যন্তই ছিলো। তবে আমি চাই তুমি সুখে থাকো।’
শিথি চোখের পানিটা মুছে চশমাটা পরে বললো,
চা খাবে?
আমি হেসে উত্তর দেই,
‘কোন একদিন আহনাফ সাহেবকে নিয়ে বাসায় বেড়াতে এসো, আমি নিজে রান্না করে খাওয়াবো।’
শিথি মুচকি হাসলো। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ভার্সিটির গেট পর্যন্ত এসেছি। শিথিকে বিদায় জানাতে হবে।
আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভালো থেকো মামুন। এটাই শেষবার জড়িয়ে ধরা তোমাকে।”
মৃদু হেসে বলি,
‘তুমিও ভালো থেকো। আর নিজের আপন মানুষটাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে শেখো। আমরা বাস্তবতার মহাস্বীকার।’

এক পা দুপা করে শিথি ফিরে যেতে লাগলো। মনে মনে আবারও বললাম, ভালো থেকো শিথি। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসাটা কতটা কঠিন হবে, আমার জানা নেই।
আমিও চলে আসছি। নিজের আবেগী মন বারবার নিজের কাছেই প্রশ্ন করছে,
আমাদের কি আর দেখা হবে?
নিজের বাস্তব মন উত্তর দিচ্ছে,
হয়তো দেখা হতে পারে কোন এক ট্রেনের বগিতে। যেখানে দুজনের চোখ দুজনকে চিনবে। দুজনের কথা হবে চোখের এক অদ্ভুত আকর্ষনে। অথবা দেখা হবে কোন কাশফুলের বিচরনে। যেখানে তার হাতের কাশফুল থেকে একটি পরাগ রেনু তোমার শার্টের হাতায় আটকে যাবে। আর নয়তো দেখা হবে সেই চাঁদের আলোয়। যেখানে দুজনি একই আলোতে নিজের গা ভেজাবে। নয়তো দেখা হবে সেই অনুভুতিতে যেই অনুভুতি ছিলো শুধুই তোমার আর আমার……

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৪৩
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×