সতের বছর পর দেশে ফেরায় যে অনুভূতি হয়েছিল, ঠিক একই অনুভূতিটা হচ্ছিলো এতোদিন পরে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করার সময়। স্কুল পড়ুয়া একমাত্র ছেলে আর স্বামীকে ঘুরে ঘুরে ক্যাম্পাস দেখাতে থাকি। লাল-সবুজের এই আমার ক্যাম্পাস! এখানে পাড় করেছি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। কলাভবন, মুন্নিচত্ত্বর, হকভাইয়ের দোকান, ট্রান্সপোর্ট, টিএসসি, মুক্তমঞ্চ, অডিটোরিয়াম!
আজ কি মুক্তমঞ্চে কোনো আয়োজন আছে? থাকার কথা না। আমাদের সময় সাধারণত সাপ্তাহিক ছুটিরদিন গুলোতে কোনো আয়োজন থাকতো না। ক্যাফেটেরিয়ার পাশ দিয়ে দিয়ে টিএসসি পেরিয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে যেতে থাকলাম। পুরোনো কারো সাথে দেখা হয় কি না, সেটাই ভাবছিলাম। অডিটোরিয়ামের সামনে কিসের যেনো একটা ব্যানার দেখা যাচ্ছে, আশে পাশে কিছু মানুষ! হুম, একটা চিত্র প্রদর্শনী চলছে। তারমানে অডিটোরিয়াম খোলা। অডিটোরিয়ামের তিন নম্বর কক্ষে থিয়েটারকর্মীদের মহড়া চলতো।
বাপ-ছেলে গেল প্রদর্শনী দেখতে, আমি বাইরের সিঁড়িতে বসে সদ্যকেনা ঝালমুড়ির ঠোঙ্গাটা খালি করতে থাকি। তরুণ তরুণীর দেখতে থাকি। এরকম একটা বয়স তো আমারো ছিল। আমিও এভাবেই ছুটিরদিন আড্ডা দিয়ে পাড় করতাম।
হঠাৎ ছেলে দৌড়ে এসে বললো, মা, বাবা ডাকছে। তাড়াতাড়ি এসো।
ছেলের উৎসাহ দেখে আমিও খানিকটা আগ্রহী হয়ে উঠি। বলি, কেনো? কী হয়েছে?
ছেলে টানতে টানতে নিয়ে যায় অডিটোরিয়ামের ভেতরে। সেমিনার রুম পেরিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখি ছেলের বাবা একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটা পেন্সিল স্কেচ! সাবজেক্ট হলাম, আমি! মুহুর্তে চঞ্চল হয়ে উঠি ভেতরে ভেতরে। আমি জানি এ ছবিটা কে এঁকেছে, কবে এঁকেছে, কোথায় এঁকেছে। তারপরেও খুঁজতে থাকি ক্যানভাসের বাম পাশের নিচের দিকে একটা বিশেষ চিহ্নের দিকে, যে বিশেষ চিহ্নটা বিশেষ মানুষটা প্রতিটি ছবিতে আঁকতো। আমি কেবল এ ছবিতে সে চিহ্নটাকে একটা হৃদয়ের খাঁচা এঁকে আটকে দিয়েছিলাম। পেয়েও যাই চিহ্নটা! হৃদয়টা কি এখনো আগের মতোই আছে?
সময় থমকে যায়! মুহূর্তে নিজেকে বিপন্ন মনে হয়। যে ভয়ে আমি এতোদিন দেশে আসিনি, যে ভয়ে আমি এতোদিন ক্যাম্পাসে আসিনি, যে ভয়ে আমি পরিচিত কারো সাথে যোগাযোগ রাখিনি, আজ এতো দিন পরে সেটাই সত্য হলো!
খুব সাদামাটা একটা জীবন ছিল ছেলেটার কিংবা আমার! যে যার মতো ক্লাশ করতাম, আড্ডা দিতাম। একই ক্যাম্পাসে থাকলেও কেউ কাউকে চিনতাম না। সর্বনাশ করলো একটা তুচ্ছ ঘটনা। সেদিন প্রথম শাড়ি পড়েছিলাম। মেরুন রঙের শাড়ি। জীবনে প্রথম শাড়ি পড়াটা মনে হয় সবমেয়ের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ! আমার সেই দিনটাকে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বানাতেই হয়তো সেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল মানুষটার সাথে। কলাভবন থেকে বের হয়ে রিক্সা না পেয়ে পায়ে হেঁটে হলে ফিরছিলাম বান্ধবীদের সাথে। হঠাৎ টিপটাপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু হলে আশে পাশে ছাউনি খুঁজছিলাম। ঠিক সে সময় কোথা থেকে যেন ছাতা হাতে একটা ছেলে এসে উদয় হলো। ছাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, আপু, ছাতাটা নাও। শাড়ি পড়ে বৃষ্টি ভেজা উচিত না!
ছাতা নেবো, না ছেলেটার পরিচয় জানবো, নাকি ধন্যবাদ দেবো বুঝতে দেরি হয়ে গেলো। এরই মাঝে কোথায় যেনো আবার উধাও হয়ে গেলো।
দ্বিতীয়বার যেদিন দেখা হলো, সেদিন তাকে বললাম, ভাইয়া আপনার ছাতাটা কিন্তু রেখে দিয়েছি যত্ন করে।
সে বলেছিলো, আমি তোমার জুনিয়র আপু, আমাকে আপনি বলবে না।
আহ, জুনিয়র! এই জুনিয়র ছেলেটাকেই তো আমি ভালোবেসেছিলাম। একে অপরকে কখনো বলিনি যে ভালবাসি, তারপরেও আমরা জানতাম দু’জন দু’জনকে কত ভালবাসি।
তারপর একদিন আমরা দু’জনে একশো একটা লাল গোলাপ কিনলাম। একটা ঝুড়িতে ফুলগুলো নিয়ে ক্যাম্পাসময় ঘুরে বেড়ালাম। পরিচিত যার সাথেই দেখা হলো, তাদের সবাইকে একটা করে ফুল উপহার দিলাম। কারণ জানতে চাইলে কিছু বললাম না, শুধু মিষ্টি করে হাসি উপহার দিয়েছিলাম। তখন সারাক্যাম্পাসময় আমাদের বিচরণ ছিল। ভাললাগা ছিল। খারাপ লাগা ছিল। অন্য জুটিদের মতো আমাদেরও মনমালিণ্য হতো। আমরাও একে অপরের মান ভাঙ্গাতাম! স্বপ্ন বুনতাম।
এমনই একটা দিনে সে আমার এই ছবিটা এঁকেছিল। আর আমি একটা হৃদয় চিহ্ন এঁকেছিলাম ভালবাসার প্রতীক হিসেবে।
আজ যদি তার সাথে দেখা হয়ে যায়, তাহলে কী বলবো আমি? বলবো, আমি প্রতারণা করেছি, নাকি আমি পারিনি! আমি আমার বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হতে পারিনি। কিংবা কাউকে বোঝাতে পারিনি আমার ভালবাসার গভীরতা। কিংবা এখনো নিজেকে বোঝাতে পারি না, কেনো সেদিন সাহস করে নিজের পথটা বেছে নিতে পারিনি।
ছেলের ডাকে ঘোর কাটে, মা, এটা কি তোমার ছবি?
বলি, আমারি মতো। কিন্তু আমাকে পাবে কোথায়?
সত্যিই তো আমাকে পাবে কোথায়? আমি তো অনেক অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম।
ছবি: গুগল মামা।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৬