ভূমিকাঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের জন্য দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। দরূদ ও শান্তির অবিরাম ধারা বর্ষিত হোক নবীকুল শিরোমণী মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং তাঁর পবিত্র বংশধর ও সম্মানিত সাথীদের উপর। ইসলাম একটি শান্তিময় জীবন বিধান। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এর মৃত্যু বরণ করার পূর্বেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই দ্বীনকে মুসলমানদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। একজন মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলাম সুন্দর সুন্দর বিধান প্রদান করেছে। নবজাতক শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর সন্তানের পিতা-মাতা বা তার অভিবাবকের উপর আকীকার বিধান ইসলামের সৌন্দর্যময় বিধান সমূহের মধ্য হতে অন্যতম একটি বিধান। আমরা অত্র প্রবন্ধে ইসলামে আকীকার বিধান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব, ইনশা-আল্লাহ।
আকীকার_অর্থঃ ইসলামের পরিভাষায় সন্তান জন্ম গ্রহণ করার পর আল্লাহর শুকরিয়া ও আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে পশু জবাই করা হয়, তাকে আকীকা বলা হয়।
আকীকার_হুকুমঃ অধিকাংশ আলেমের মতে সন্তানের আকীকা করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। রাসূসুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি তার সন্তানের আকীকা করতে চায়, সে যেন উহা পালন করে”। (আহমাদ ও আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেনঃ প্রতিটি সন্তানই আকীকার বিনিময়ে আটক থাকে”। (আহমাদ, তিরমিজী ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থ) আকীকার বিনিময়ে সন্তান আটক থাকার ব্যাপারে আলেমগণের কয়েক ধরণের বক্তব্য রয়েছে। এ ব্যাপারে ইমাম আহমাদ বিন হান্বালের কথাটি সবচেয়ে সুন্দর ও বিশুদ্ধ। তিনি বলেন, কথাটি শাফাআতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ আকীকা দেওয়া হয়নি, এমন শিশু সন্তান যদি মৃত্যু বরণ করে, কিয়ামতের দিনে সে শিশুর শাফাআত থেকে পিতা-মাতা বঞ্চিত হবে। আর হাদীসে একথা প্রমাণিত আছে যে, মুসলমানদের যে সমস্ত শিশু বাচ্চা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই মৃত্যু বরণ করবে, তারা তাদের মুসলিম পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। উপরের আলোচনা থেকে প্রমাণিত হলো যে, সন্তানের আকীকা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। ওয়াজিব বা ফরজ নয়।
আকীকা_করার_সময়ঃ আকীকার জন্য উত্তম সময় হলো সন্তান ভুমিষ্ঠ হওয়ার সপ্তম দিবস। সপ্তম দিনে আকীকা দিতে না পারলে ১৪ম দিনে, তা করতে না পারলে ২১ম দিনে আকীকা প্রদান করবে। সপ্তম দিনে আকীকা করার সাথে সাথে সন্তানের সুন্দর নাম রাখা, মাথার চুল কামানো এবং চুল এর সমপরিমাণ ওজনের রৌপ্য ছাদকাহ করাও মুস্তাহাব। (তিরমিজী) বিনা কারণে আকীকা দেওয়াতে বিলম্ব করা সুন্নাতের বিরোধীতা করার অন্তর্ভুক্ত। দারিদ্র বা অন্য কোন কারণে যদি উল্লেখিত দিন গুলোতে আকীকা করতে অক্ষম হয়, তবে সন্তান ছোট থাকা অবস্থায় যখনই অভাব দূর হবে, তখনই আকীকা করতে হবে। অভাবের কারণে যদি কোন লোক তার শিশু ছেলে-মেয়েদের আকীকা করতে না পারে, তাহলে সন্তান বড় হওয়ার পর যদি তার আর্থিক অবস্থা ভাল হয়, তখন আকীকা করলেও সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে এবং পিতা- মাতা ছাওয়াব পাবে, ইনশাআল্লাহ। এমন কি কারও পিতা-মাতা যদি আকীকা না করে, সে ব্যক্তি বড় হয়ে নিজের আকীকা নিজে করলেও সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। আনাছ (রাঃ) হতে বর্ণিত, “নবী (সাঃ)নবুওয়াত পাওয়ার পর নিজের আকীকা নিজে করেছেন”। (বায়হাকী) এ হাদীস থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর নিজের আকীকা নিজে দেওয়া বৈধ হওয়ার উপর সুস্পষ্ট দলীল পাওয়া যায়।
কোন ধরণের পশু দিয়ে আকীকা করতে হবে?
সংখ্যা কয়টি,আকীকার ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো, ছেলে সন্তান হলে দু‘টি দুম্বা বা ছাগল আর মেয়ে সন্তান হলে একটি দুম্বা বা ছাগল দিয়ে আকীকা করা। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ “ছেলে সন্তানের পক্ষ থেকে দু‘টি সমবয়সের ছাগল এবং মেয়ে সন্তানের পক্ষ থেকে একটি ছাগল দিয়ে আকীকা দিতে হবে। (আহমাদ ও তিরমিজী) যে ধরণের ও বয়সের ছাগল বা দুম্বা কুরবানীর ক্ষেত্রে বৈধ, তা দিয়ে আকীকা করতে হবে। অর্থাৎ কুরবানীর পশু যেসমস্ত দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত হওয়া শর্ত, আকীকার ছাগল-খাসী বা দুম্বাও সেসমস্ত দোষ-ত্রুটি হতে মুক্ত হতে হবে। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে যদি ছেলে সন্তানের পক্ষ থেকে দু‘টি ছাগল দিয়ে আকীকা দিতে না পারে, তবে একটি দিয়ে আকীকা দিলেও চলবে। কেননা রাসূল (সাঃ) হতে ছেলে সন্তানের পক্ষ থেকে একটি করে দুম্বা দিয়ে আকীকা করার কথাও প্রমাণিত আছে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাসান এবং হুসাইসের পক্ষ হতে একটি করে দুম্বা আকীকা করেছেন। (আবু দাউদ) তবে সামর্থবান ব্যক্তির পক্ষে একটি ছাগল দিয়ে ছেলে সন্তানের আকীকা করা উচিৎ নয়। মোট কথা, ছেলে সন্তানের আকীকার জন্য দু‘টি ছাগল বা দুম্বা হওয়া জরুরী নয়; বরং মুস্তাহাব।
আকীকার_গোশত_কি_করবে?
আকীকার গোশত কুরবানীর গোশতের মতই। তা নিজে খাবে, আত্মীয় স্বজনকে খাওয়াবে এবং গরীব-মিসকীনকে ছাদকা করবে। তবে যেমনভাবে কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজে খাওয়া, একভাগ ছাদকা করা এবং এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে হাদীয়া হিসাবে দান করা জরুরী নয়, ঠিক তেমনিভাবে আকীকার গোশতও উক্ত নিয়মে তিন ভাগ করা জরুরী নয়। আকীকার গোশত যদি সম্পূর্ণটাই রান্না করে এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং অন্যান্য মুসলমানদেরকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ায় তাতেও যথেষ্ট হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যে, কোন ক্রমেই যাতে হাদীয়া ও উপহারের আশায় শুধুমাত্র ধনী ও সম্মানী লোকদেরকে দাওয়াত দিয়ে দরিদ্র ও অভাবী ব্যক্তিদেরকে প্রত্যাখ্যান না করা হয়। যা আমাদের দেশে অধিকাংশ সমাজেই বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে হয়ে থাকে। তবে সন্তান জন্ম গ্রহণের দিন কিছু মানুষ যে অনুষ্ঠান করে থাকে বা প্রতি বছর সন্তানের জন্ম দিবস পালন করে থাকে এবং এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান করে থাকে, তা সম্পূর্ণ বিদআত। এ সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তে কোন দলীল নাই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মাঝে এমন বিষয় তৈরী করল, যা আমাদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখাত”। (বুখারী) শুধু বিদআতই নয় বরং তা অমুসলিম ইহুদী-খৃষ্টানদের অনুসরণও বটে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ "যে ব্যক্তি কোন জাতির অনুস্মরন করবে, সে উক্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। (আবু দাউদ)
গরু_দিয়ে_আকীকা_করাঃ কোন হাদীসেই গরু দিয়ে আকীকা করার কথা উল্লেখ হয়নি। অথচ রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এর যুগে সবধরণের পশুই বিদ্যমান ছিল। সুতরাং উত্তম হচ্ছে ছাগল বা দুম্বা দিয়েই আকীকা করা। গরু দিয়ে আকীকা করা হলে একদল আলেমের মতে তা জায়েয হবে। তবে শর্ত হচ্ছে একজন সন্তানের পক্ষ হতে একটি গরু দিয়ে আকীকা করতে হবে। অপর পক্ষে কতিপয় আলেম সাত সন্তানের পক্ষ হতে একটি গরু দিয়ে আকীকা দিলেও জায়েয হবে বলে মত দিয়েছেন,। তবে সাত সন্তানের পক্ষ হতে একটি গরু আকীকা করার কথা হাদীছে পাওয়া যায় না। আকীকা যেহেতু একটি এবাদত, তাই হাদীছে যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই পালন করা উচিত। আর এটি মোটেই কঠিন কোন বিষয় নয়।
কোরবানীর_সাথে_ভাগে_আকীকা_দেয়াঃ আমাদের দেশে সাতভাগে গরু দিয়ে কুরবানী করার ক্ষেত্রে আকীকার অংশীদার হওয়ার নিয়ম ব্যপকভাবে প্রচলিত আছে। এটি হাদীছ সম্মত নয়। একটি গরু দিয়ে যদি একজন সন্তানের আকীকা করা যদি ঠিক না হয়, তাহলে কুরবানীর গরুর সাথে ভাগে আকীকা করা সঠিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সর্বোপরি কতিপয় আলেম কোরবানীর গরুর সাথে ভাগে আকীকা দিলে তা বৈধ হবে বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু তা হাদীছ সম্মত নয়।
আকীকার ক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস কিছু লোক বিশ্বাস করে যে, সন্তানের পিতা-মাতা এবং যে সন্তানের আকীকা দেওয়া হলো, সে সন্তান আকীকার গোশত খেতে পারবেনা। এটি একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস। এ মর্মে কোন দলীল-প্রমান নাই। পূর্বেই বলা হয়েছে, আকীকার গোশত কুরবানীর গোশতের মতই। পরিবারেই সবাই খেতে পারবে।
আকীকা দিতে অক্ষম হলেঃ পূর্বেই বলা হয়েছে, দারিদ্রতার কারণে আকীকা দিতে অক্ষম হলে, আর্থিক অবস্থার উন্নতি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যখনই সামর্থবান হবে, তখনই আকীকা করবে। আর যদি আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হয় এবং আকীকা দিতে না পারে, তাহলে কোন গুনাহ হবেনা। আল্লাহ তা‘য়ালা বলেনঃ "আল্লাহ তা‘য়ালা কারও উপর সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেননা। (সূরা বাকারা-২৮৬) আল্লাহ তা‘য়ালা আরও বলেনঃ "আল্লাহ তা‘য়ালা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠিন বিষয় চাপিয়ে দেননি। (সূরা হজ্জঃ৭৮) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ "তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তোমাদের সাধ্য অনুযায়ী”। (সূরা তাগাবুন-১৬) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ "যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ দেই, তখন সাধ্য অনুযায়ী তোমরা তা পালন কর। আর যখন কোন কাজ হতে নিষেধ করি, তখন তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাক”। উপরোক্ত দলীল গুলোর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, আকীকাসহ যে কোন আমলই হোক না কেন, অক্ষমতার কারণে পালন করতে না পারলে কোন গুনাহ হবেনা। কিন্তু নিষিদ্ধ বিষয়ের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ। সবধরণের নিষেধ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। কারণ নিষেধ থেকে বিরত থাকতে কোন কষ্ট হয়না বা আর্থিক সচ্ছলতার দরকার পড়ে না।
উপসংহারঃ সন্তানের আকীকা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতে মুহাম্মাদী। তাই এনিয়ে অবহেলা করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যেভাবে ইহা পালন করেছেন, পালন করতে বলেছেন, আমাদেরকেও সেভাবে পালন করতে হবে। পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে এ গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতটি যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দেন। আমীন!
লেখক: আব্দুল্লাহ শাহেদ আল মাদানী