এমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার ছিল কোনটা ? উত্তরটা চোখ বন্ধ করেই দেওয়া যাই ।
এলকাট্রাজ (The Alcatraz Federal Penitentiary ) , সবথেকে সুরক্ষিত বলা হচ্ছে কারণ এই কারাগারটা একটা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত এবং এই দ্বীপ থেকে পার্শ্ববর্তী স্যান ফ্রান্সিস্কো উপকূলের দূরত্ব ২.০১ কিলোমিটার । এল ক্যাপোন, মিকি কোহেনের মত দুর্ধর্ষ অপরাধীদের শেষ ঠিকানা ছিলো এলকাট্রাজ ।
এই কারাগার থেকে পালাতে চাইলে প্রথমে বন্দীকে নিজের সেল থেকে বের হওয়া লাগবে । তারপর সেল ব্লক এবং কারাগারের সীমানা প্রাচীর থেকে বের হওয়া লাগবে । এবং সবশেষে ২ কিলোমিটার ঠান্ডা পানি সাতার কেটে পার হওয়া লাগবে । গুজব ছিল এই পানি এতোই ঠান্ডা যে এখানে সাতার কাটতে গেলে হাইপোথার্মিয়ার কবলে পড়া লাগে । সাগরের প্রচন্ড স্রোত তো আছেই এবং একই সাথে এই হাঙরের ভয় । ভালো কথা, প্রতিটা ক্ষেত্রেই কিন্তু কারাগারের গার্ডদের চোখ ফাকি দিয়ে কাজগুলা করা লাগবে ।
১৫৭৬ জন দুর্ধর্ষ বন্দী ছিল এলকাট্রাজে । যাদের মধ্যে ৩৬ জন বন্দী ১৪ বারের মত পালানোর চেষ্টা করেছে । এই ১৪ টা আলাদা ঘটনায় ২৩ জন দ্বীপের ভিতরেই গার্ডের হাতে আটক হয় , ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়, পানিতে ডুবে মারা যায় ২ জন এবং “জন পল স্কট” নামে এক অপরাধী সাতার কেটে তীরে পৌছালেও হাইপোথার্মিয়াতে আক্রান্ত হয় এবং সাথে সাথেই গার্ডদের হাতে ধরা পড়ে । বাকি পাঁচ জনকে দেখানো হয়েছে মিসিং নামে । হয় এরা সাগরে তলিয়ে গিয়েছে অথবা তারা FBI কে ফাকি দিয়ে রিতিমত ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে ।
গল্পটা এই ৫ জনের মধ্যকার ৩ জনকে নিয়ে ।
প্রথমজন ফ্র্যাঙ্ক মরিস , এই পলানোর ঘটনার মাস্টারমাইন্ড । যে লোকটা IQ টেস্টে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২% এর মধ্যে থাকতে পারে , সে কোন লেভেলের ট্যালেন্টেড হতে পারে সে ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব না । তবে এইলোকটা যে আর ১০ টা মানুষের মত টিপিক্যাল হবে না এটা চোখ বন্ধ করেই বলা যায় ।
ওয়াশিংটনে ১৯২৬ সালে জন্ম নেয়া ফ্র্যাঙ্ক মরিস ১১ বছর বয়সে বাবা মা কে হারান । প্রথমবারের মত ফ্র্যাঙ্ক যখন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর । পরবর্তীতে কিশোর বয়সেই কয়েকবার ড্রাগস আর অস্ত্র ডাকাতির জন্য পুলিশের হাতে ধরা খাবার রেকর্ড আছে এই ব্রিলিয়ান্টের । ব্যাংক ডাকাতিতে ধরা খেয়ে ১০ বছরের জন্য লুসিয়ানা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় তাঁকে । সফলতার সাথে এই কারাগার ভেঙে পালাতে পারলেও ১ বছর পর তিনি আবার ধরা পড়েন এবং তাঁকে পাঠানো হয় এমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার এলকাট্রাজে । সময়টা ছিল ১৯৬০ সাল ।
বাকি দুইজন “জন উইলিয়াম এংলিন” এবং “আলফ্রেড ক্লারেন্স এংলিন” , দুই ভাই । ১৯৩০/৩১ সালে জর্জিয়াতে কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করা এই দুই ভাইয়ের আরো ১১ টা ভাইবোন ছিল । দুই ভাই ছিল দক্ষ সাতারু । মিশিগান লেকের বরফ জমা ঠান্ডা পানিতে সাতার কেটে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিতো বাকি ১১ জন ভাইবোনকে ।
১৯৫০ এর দিকে এরা ব্যাংক ডাকাতি শুরু করে টীম হিসাবে । বেশিরভাগ সময় এরা রাতে ব্যংক ডাকাতি করতো যেন মানুষ না মারা লাগে এবং এরা একবার খেলনা পিস্তলের ভয় দেখিয়ে ব্যাংক ডাকাতিও করে । ধরা পড়ার পর কয়েকটা কারাগারে রাখা হলেও সবসময় পালানোর চেষ্টা করার জন্য তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আলকাট্রাজে , এমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার । সময়টা ১৯৬০/৬১ ।
ফ্র্যাঙ্ক মরিস এবং এংলিন ব্রাদার্সের সাথে আরো একজন “হতভাগা” জড়িত ছিল । এলেন ওয়েস্ট । গাড়ি চুরির অপরাধে জেলে যাওয়া এলেন একসময় ফ্লোরিডা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালানোর চেষ্টা করে এবং ধরা পড়ে এলকাট্রাজে নির্বাসিত হন ।
১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্রাঙ্ক মরিস, এংলিন ব্রাদার্স আর এলেন ওয়েস্টকে পাশাপাশি সেল দেয়া হয় এলকাট্রাজে । ফ্রাঙ্ক মরিসের নেতৃত্বে বাকি ৩ জন এমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার থেকে পালানোর প্ল্যান শুরু করে । নেক্সট ৬ মাস তারা ধীরে ধীরে সেলের ভেন্টিলেটরে গর্ত করা শুরু করে । সেল থেকে বের হবার জন্য এর চেয়ে ভালো অপশন ছিল না তাঁদের হাতে । ভেন্টিলেটরে গর্ত করার জন্য শুরুতে চামচ কিংবা ব্লেডের মত সহজলভ্য জিনিস ব্যাবহার করলেও পরবর্তীতে ভ্যাকিউম ক্লিনারের মোটরের সাহায্যে তারা ছোটখাটো হ্যান্ড ড্রিল মেশিন তৈরি করে ফেলে । গ্রুপের ১ জন যখন তাঁর সেলে খোড়াখুড়ি করতো, তখন বাকি সদস্যদের ভিতর কেউ গার্ডকে পাহারা দিতো, কেউ মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতো (গার্ডদের টাকা দিয়ে খুশি করাতে পারলে মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট কিংবা পেইন্টিং এক্সেসরিজ নিজের সেলে রাখা যেত ) যেন খোড়াখুড়ির শব্দ কেউ না শুনতে পায় ।
ভেন্টিলেটরে বানানো গর্তটা তাদেরকে একটা করিডরের সন্ধান দেয়, যেখানে সাধারণত কোন গার্ড থাকতো না । করিডোর থেকে তারা সেল ব্লকের ছাঁদে উঠতে সমর্থ হয় । এবং বিল্ডিঙের ভিতরের এই যাইগাতে তারা একটা ছোট ওয়ার্কশপ বানিয়ে ফেলে । এখানে বসেই তারা চুরি করে আনা রেইনকোর্ট দিয়ে লাইফ জ্যাকেট বানিয়ে ফেলে । এই লাইফ জ্যাকেটগুলা সীল করার জন্য তারা পাশের স্টিম পাইপের তাপ ব্যাবহার করে ।
এখান থেকে পরবর্তীতে তারা বিল্ডিং এর ছাঁদে উঠতে সমর্থ হয় এবং ধীরে ধীরে ছাদের উপরের ভেন্টিলেশন ফ্যান এবং গ্রীলের সাথের সব রিভেট কেটে ফেলে ।
কিছু সময় পরপরই অপরাধীদের সেলের সামনে গার্ড টহল দিতো । এর জন্য ভেন্টিলেটরের গর্ত দিয়ে রুমের বাইরে বের হবার আগে তারা তাঁদের বানানো “ডামি হেড”গুলো এমন ভাবে বেডের উপর রেখে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিতো যেন বাইরের থেকে মনে হয় খাটের উপর কেউ একজন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে । সাবান, টিস্যু পেপার গলিয়ে মন্ড টাইপ কিছু একটা বানাতে পারতো তারা। যেটা দিয়ে পরবর্তীতে ডামি হেডগুলা তৈরি করা হয় ।
জুন ১১, ১৯৬২ :
প্ল্যান শুরু করার ৭ মাসের মাথায় তারা মোটামুটি সবকিছুই ম্যানেজ করে ফেলে । যদিও এলেন ওয়েস্টের রুমের ভেন্টিলেটর তখনো ভাঙা শেষ হয়নি । পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ফ্রাঙ্ক মরিস আর এংলেন ব্রাদার্স তাঁদের বিছানার উপর ডামি হেড গুলো রেখে সেগুলাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলো , যেন না বোঝা যায় সেল থেকে কয়েদী গায়েব হয়ে গিয়েছে । তারপর তারা করিডোর এবং সেল ব্লকের ছাদের ভেন্টিলেশনের যায়গা দিয়ে বিল্ডিং এর ছাদের উপর উঠতে সমর্থ হয় ।
ছাদের ভেন্টিলেশনের প্লেসটা অনেক উপরে থাকার জন্য ১ জনের পক্ষে অসম্ভব ছিল সেখানে ওঠা । কিন্তু যেখানে ৩ জন ব্রিলিয়ান্ট গ্রুপ মেম্বার আছে সেখানে সকল কঠিন কাজ সহজ হতে বাধ্য ।
উল্লেখ্য এলেন শেষ পর্যন্ত রুমের ভেন্টিলেটর ভাংতে পারে । ব্লকের ছাঁদে গিয়ে দেখে তাঁর একার পক্ষে এতো উপরে ওঠা অসম্ভব । বাকি ৩জন যেহেতু আগেই চলে গিয়েছে, সেহেতু এলেন ওয়েস্ট পালানোর চিন্তা বাদ দিয়ে তাঁর নিজের সেলে এসে ঘুম দিলেন । তিনি পরবর্তিতে এই মামলার প্রধান শাক্ষী ছিলেন ।
পরের দিন দুপুর ১২ টার আগে কেউ জানতেই পারলো না ,তিন জন গতরাতে এমেরিকার সবচেয়ে সুরক্ষিত কারাগার ভেঙে পালিয়েছে । গার্ড যখন তাঁদের রুমে গিয়ে বিছানার চাঁদর সরালো, তখন বিছানার উপর ডামি হেড ছাড়া আর কিছুই দেখলো না ।
পরবর্তী ১০ দিন তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর আল্কাত্রাজের পাশে সমুদ্রে বেশ কিছু অযাতিচ জিনিস পাওয়া যায় । বৈঠা সদৃশ কিছু একটা , একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে এংলিন ব্রাদার্সের আত্মীয়দের নাম ,ঠিকানা এবং ছবি । এর কিছুদিনের মধ্যে রেইনকোর্ট দিয়ে বানানো লাইফ জ্যাকেটগুলাও পাওয়া যায় । শুধু পাওয়া যায়না ৩ টা মানুষের কোন অস্তিত্ব ।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও FBI বিন্দু মাত্র কোন লিড খুঁজে পায় না , যেটা দিয়ে তারা পলাতকদের ট্রেস করতে পারে । ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর FBI এই ফাইল ক্লোজ করে দিতে বাধ্য হয় ।
জি , উপরের আর্টিকেল পড়ে আপনার মাথায় অনেকবার আসছে ফ্র্যাঙ্ক মরিস আর এংলিন ব্রাদার্সের শেষ পর্যন্ত কি হয় ? অথবা তারা হিমশীতল সাগর পার হয় কিভাবে ? তারা কি সমুদ্রেই ডুবে যায় নাকি FBI কে ফাকি দিয়ে জেলের বাইরে স্বাধীন জীবন যাপন করে ?
কতগুলা যুক্তি দিয়ে লেখাটা শেষ করি ।
প্রথমত, একটা অপরাধীকে যখন এলকাট্রাজে নিয়ে যাওয়া হতো , তখন তাঁর ভিতরে যে জিনিসটা ঢুকিয়ে দেয়া হতো, সেটা হচ্ছে ভঁয় । এই ভঁয়কে আরো দৃঢ় বানানোর জন্য হইতো সমুদ্রের পানিকে হিমশীতল বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছিল । একই সাথে হাঙরের ব্যাপারটাও নিছক গুজব ছিল । হইতো এই কারণগুলার জন্যই তারা তিনজন ভালোভাবেই লাইফ জ্যাকেট পরে সমুদ্র পার হতে পারে ।
দ্বিতীয়ত, শুরুর দিকে FBI ধারণা করে এই তিনজন হইতো সাগরে ডুবে মারা গেছে । কিন্তু লাশের অস্তিত্ব না পাওয়া প্রমান করে , এটা নেহায়েত গা বাচানো টাইপ কথাবার্তা ছিল ।
ফুটনোট – ধারণা করা হয় এই তিনজন হইতো ব্রাজিলে আত্মগোপন করেন । এংলিনদের দুই বোন ২০০২ সালে ঘোষণা দেন , তাঁর ভাইয়েরা বেঁচে আছে । তাঁদের বয়স সেসময় ৮০ পেরিয়ে যাবার কথা । তারা এটাও জানান ১৯৬২ সালে সান ফ্র্যান্সিস্কো থেকে একটা ফোনকল পান তারা । যেখানে এংলিন ব্রাদার্স তাঁর ফ্যামিলিকে ক্রিসমাসের শুভকামনা জানায় । অপরদিকে , নরওয়ের একটা জাহাজে থাকা কিছু নাবিক দাবী করে তারা গোল্ডেন গেট ব্রিজ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একটা লাশ সাগরে ভাসতে দেখে । যেটা কয়েদীদের ড্রেস পরা ছিল এবং এইঘটনা এলকাত্রাজ থেকে পালানোর ১ মাসের মধ্যে ঘটে ।
৫৫ বছর পর আমরা এখনো জানি না ফ্রাঙ্ক মরিস আর এংলিন ব্রাদার্সের পরিণতি আসলে কি হয়েছিল । সব রহস্যের যে সমাধান হতে হবে , এমন তো কোন কথা নায় । কিছু রহস্য না হয় অমিমাংসিত থেকে যাক ।