সময়টা ১৯৮২ সালের ৪ ডিসেম্বর । অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে টেট্রা-এমেলিয়া সিনড্রোমে আক্রান্ত এক শিশু জন্মগ্রহণ করেন । যার দুই হাত এবং দুই পা কোনটাই ছিল না জন্মের সময় । যেখানে পৃথিবীতে নতুন প্রাণ আগমনের সময় জন্মদাত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর নিয়ম , সেখানে এই বাচ্চাটার মা কে অভিনন্দন জানানোর জন্য হসপিটালে কেউ আসার প্রয়োজন বোধ করেননি । পৃথিবী হয়তো এই বিকলঙ্গ বাচ্চার কোন ভবিষ্যৎ দেখেনি । হয়তো না দেখাটাই স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে । যে মানুষটার দুই হাত কিংবা দুই পা কোনটাই নেয়, তাকে বোঝা হিসাবে গন্য করা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ।
বাচ্চাটার নাম রাখা হয় "নিকোলাস জেমস ভুজিচিচ" । বর্তমানে তিনি "নিক ভুজিচিচ" নামে অধিক পরিচিত ।
নিকের বাবা মা ছিলেন ক্রিচিয়ান । মেলবোর্নের একটা চার্চে নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল তাঁদের । স্রষ্টার কাছে এতো করে চাওয়ার পরেও তাঁদের প্রথম সন্তানের এই পরিণতি মানতে পারছিলেন না কেউই । নিকের জন্মের পর নার্স যখন নিককে কোলে নিয়ে ছিলেন তখন নিকের মা চাচ্ছিলেন না তাঁদের নবাগত সন্তানের মুখ দেখতে । কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন তিনি । পরে হসপিটালের ফুলের দোকান থেকে একটা ফুলের তোড়া নিয়ে আসেন নিকের বাবা । নিকের মায়ের কানে ফিসফিস করে বলেন, আমাদের ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর । তুমি ওর মুখের দিকে তাকিয়েই দেখো একবার ।
ছবি – ছোটবেলায় নিক ভুজিচিচ ।
ঈশ্বরে বিশ্বাসী দুইটা মানুষ ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না, কেন ঈশ্বর তাঁদের কাছে এমন একটা সন্তানকে পাঠালেন ? তবে তাঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, স্রষ্টার অবশ্যই কোন একটা বিশেষ পরিকল্পনা আছে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে । তিনি পরিকল্পনাহীন কোন কাজ করেন না । আর ভুল করা তো স্রষ্টার পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার । এই বাচ্চাটাকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেন । বড় করতে থাকেন এই বাচ্চাটাকে ।
নিকের জন্মের সময় পা ছিল না , ব্যাপারটা কিছুটা ভুল । তার শরীরের নীচের অংশে খুব ছোট ছোট দুইটা পা ছিল । যার একটাতে কয়েকটা আঙুল জোড়া লাগানো ছিল এবং পরবর্তীতে সেই আঙুলগুলা অপারেশনের মাধ্যমে আলাদা করা হয় । এই আঙুল দিয়ে নিক তাঁর হুয়িল চেয়ার চালানো শেখেন , বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টানো শেখেন এবং সর্বপোরি এই আঙুল দিয়ে তিনি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন চালানো শেখেন ।
বাবা মায়ের সাথে নিক ভুজিচিচ ।
নিকের বাবা মা নিককে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চান । নিককে তাঁরা স্কুলে পাঠানো শুরু করেন । এমন একটা বিকলঙ্গ ছেলের জন্য স্কুল জীবন খুব একটা সুখকর ছিল না । প্রায়ই নিক তাঁর সহপাঠীদের দেখতেন তাঁকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে । একটা বাচ্চা ছেলের জন্য ডিপ্রেশনে পড়ার হইতো আর খুব একটা কারণ লাগে না । সহপাঠীদের সাথে একটা সাধারণ শৈশব চেয়েছিলেন তিনি । স্কুলে থাকতেই আর ১০ টা ছেলের মত নিক সাঁতার শেখেন , স্কেটিং করেন শুধুমাত্র সবার সাথে একটু মিশতে পাবার জন্য । কিন্তু তাঁর আশেপাশের মানুষজন তাঁকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা বাদ দিতে পারতো না ।
ছবি – সাম্প্রতিক সময়ে সার্ফিং করছেন নিক ভুজিচিচ । ছবিসুত্র – midweek.com
ছবি – সাতার কাটছেন নিক ভুজিচিচ । ছবিসুত্র – BBC
একাকী নিক চিন্তা করতেন, স্রষ্টা আসলে তাঁকে দিয়ে কি করানোর পরিকল্পনা করছেন । বেশিরভাগ সময় কোন সমধান খুঁজে পেতেন না তিনি । তাঁর বাবা মা তাঁকে পুর্নাঙ্গ সহযোগীতা করেন এই সময়টাতে । তাঁর ভাই বোন কিংবা কাজিনরা কখনই তাঁকে বোঝার সুযোগ দিতো না, সে একা । প্রায়ই তাঁর মা তাঁকে এমন কিছু পেপার কাটিং দেখাতেন যেখানে কোন বিকলঙ্গ মানুষের সম্পর্কে আর্টিকেল থাকতো । হইত তিনি চাইতেন নিক বুঝতে পারুক, সে একা না । পৃথিবীতে তাঁর মত আরো অনেকেই আছে ।
ডিপ্রেশন বা লোকজনের হাসি ঠাট্টা নিককে বিরত রাখতে পারেনি তাঁর লক্ষ্য থেকে । পড়ালেখা চালিয়ে গেলেন তিনি এবং ২১ বছর বয়সে গ্রিফফিত ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন । ব্যাবসা প্রশাসনে গ্রাজুয়েশন করার সময় তাঁর দুইটা মেজর ছিল । একাউন্টিং এবং ফাইন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং ।
আসলে BBA তে গ্রাজুয়েশন করার সময় তিনি চিন্তা করতে থাকেন , সব মানুষ যে পথে আগায়, তাঁর জন্য সে পথে আগানো সম্ভব না । তিনি গভীরভাবে উপলব্ধী করতেন আলাদা কিছু করার ।যখন তাঁর বয়স ১৯ বছর (২০০৫ সালে) তখন তিনি তখন আন্তর্জাতিক একটা সংস্থা খোলেন । নাম রাখেন , “Life withhout limbs” । বিকলঙ্গ লোকজনদের নিয়ে কাজ করা তাঁর প্রধান পরিকল্পনা ছিল ।
পৃথিবীতে মানুষ কত কষ্ট করে থাকতে পারে, সেটা বোঝার জন্যই তিনি বেশ কিছু দরিদ্র বস্তিতে গিয়ে থেকেছেন । মিশরের কায়রোর একপ্রান্তে "আবর্জনার শহর" তাঁদের মধ্যে একটা । এইখানে থাকার সময় তিনি বুঝতে শেখেন তারচেয়ে অনেক কষ্টে মানুষ এখানে বেঁচে থাকে । স্রষ্টা কেন তাঁকে অন্তত একটা হাত দেননি সেটা নিয়ে আফসোস থাকে না আর । বরং বস্তির মানুষের ভাঙাচোরা ঘরে থাকা , খুব কষ্টে খবার সংগ্রহ করা, পানির সমস্যা এইগুলা দেখে তাঁর মনে হতে থাকে, এই মানুষগুলার তিনি জীবনে বেশি সুবিধা পেয়েছেন । বস্তি থেকে বিদায় নেবার সময় তিনি যখন বস্তির কয়েকটা পরিবারকে চাল, ডাল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাবার দিয়ে সাহায্য করেন , তাঁর ধারণা ছিল না এতো অল্পে মানুষ খুশি হতে পারে ।
নিক জীবনের সবচেয়ে বড় যে উপলব্ধিটা পান, সেটা হচ্ছে পৃথিবীতে প্রচুর মানুষ ডিপ্রেসড । হতাশা কাটিয়ে ওঠার চেয়ে তাঁরা আরো বেশি হতাশায় ডুবে যায় । যেহেতু সারাজীবন এই হতাশার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কাটছে তাঁর , সেহেতু এই হতাশাগ্রস্থ মানুষগুলাকে আশা দেয়ার জন্য ২০০৭ সালে তিনি একটা মোটিভেশনাল স্পিকিং কোম্পানি খোলেন । নাম রাখেন “ATTITUDE IS ATTITUDE” । তাঁর বাবা মা আসলে বুঝতে পারছিলেন না , নিক কেন তাঁর পড়ালেখা অনুযায়ী জীবন চালাচ্ছে না । মোটিভেশনাল স্পিকিং কোম্পানি আসলেই নিককে কোন ভবিষ্যৎ দিবে এটা ভাবেননি তাঁরা
ছবি – স্পীচ দেয়ার জন্য দর্শকদের সামনে নিক । ছবিসুত্র – uspressonline.com
শুরুর দিকে নিক বেশিরভাগ সময় বাচ্চাদের স্কুলে এবং চার্চে যেতেন কথা বলার জন্য । তিনি খেয়াল করেন, তার সামনে দাঁড়ানো মানুষগুলো মুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনছে । তিনি মানুষকে শুধু এটাই বোঝাতে চাইতেন , দুই হাত পা না থাকার পরেও তিনি যেভাবে হাসতে পারছেন, সেখানে বাকি মানুষদের আসলে হতাশ হবার কি কোন কারণ আছে ? অন্তত তাঁর থেকে বেশি সুযোগ জীবনে পেয়েছে এই মানুষগুলো । তাঁরা কেন হতাশ থাকবে ? তাঁর মোটিভেশনাল স্পীচগুলা আসলেই কার্যকারী ।
ধীরে ধীরে পরিচিতি পেতে থাকেন নিক । ২০১০ সালে নিজের জীবন নিয়ে লিখে ফেলেন একটা বই । নাম দেন "Life Without Limits" । পৃথিবীর অন্তত ৩০ টা ভাষায় তাঁর এই বইটা প্রকাশিত হয়েছে । এরপরে আরো ৬ টা বই লিখছেন তিনি এ পর্যন্ত । লেখক হিসাবে অসাধারণ তিনি । অন্তত , পাঠকদের কাছে তাঁর সাবলীল ভাষায় জীবন নিয়ে উপলব্ধী সাড়া জাগানোর মত ।
২০১০ সালে "মেথড ফেস্ট ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে" তিনি "বাটারফ্লাই সার্কাস" শর্টফিল্মের জন্য তিনি সেরা অভিনেতা হিসাবে নির্বাচিত হন ।
২০১২ সালে বিবাহিত নিক এখন ২ সন্তানের বাবা ।
ছবি – নিক ভুজিচিচ এবং তাঁর পরিবার ।
বর্তমানে নিকের মোটিভেশনাল স্পীচ শোনার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তাঁকে আমন্ত্রন জানানো হয় । পৃথিবীর বড় বড় স্কুল,কলেজ কিংবা ভার্সিটিতে গিয়ে একঝাক বিপর্যস্ত মানুষকে শেখান তিনি, কিভাবে বাঁচতে হয় ।কিভাবে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েও হাসতে হয় , কিভাবে জীবনকে ভালবাসতে হয় । তিনি মানুষকে শেখান স্রষ্টা কোন ভুল করতে পারেন না । তিনি প্রতিটা মানুষকে একটা লক্ষ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠান । আমাদের একটাই কাজ শুধু সেই লক্ষ্যটা খুঁজে বের করা ।
তাঁর লেখা বই "Life Without Limits" এর একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করবো লেখাটা । একটা বাচ্চাদের স্কুলে একবার কথা বলার জন্য নিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল । নিক যখন কথা শেষ করেন তখন প্রায় সবাই কাঁদছে আর হাততালি দিচ্ছে । এমন সময় একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বললো,আমি কি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে পারি । নিকের অবশ্যই উত্তরটা শোনার সাথেসাথেই বাচ্চাটা নিককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলে, "আমি দেখতে সুন্দর না, সবাই আমাকে অন্য চোখে দেখে । এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক কস্ট পেতাম আমি । আজ আপনাকে দেখে শিখলাম নিজের মূল্য নিজেই সৃষ্টি করে নিতে হয় পৃথিবীতে । স্রষ্টা হইতো সবসময় সবকিছু শুরুতে দেন না ।"
নিককে এর আগে অনেকেই মেইল করে জানিয়েছে সে কতটা অনুপ্রেরণা দিতে পারে মানুষদের । সামনে দেখে অনেকেই নিককে জড়িয়ে ধরে বলেছেন তাঁকে কতটা ভালোবাসে মানুষজন । কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটার কথা নিক সবসময় মনে রাখবেন । পৃথিবীতে যদি মানুষকে হতাশা থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা দেখানোর জন্যই তাঁর জন্ম, তবে তিনি ভাবেন, ঠিক রাস্তাতেই এগুচ্ছেন তিনি ।