somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসে ছিল

২১ শে এপ্রিল, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মেয়েটি সুন্দরী; আমরা সুন্দরী মেয়েদের নিয়েই কাব্য লিখি; যারা সুন্দরী নয়, তারা বড়জোর মানবতাবাদীদের সামান্য কৃপা পেয়ে থাকে মাঝে-সাঝে, সেটা মেয়েটির জন্য নয় যতোটা, তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁদের নাম ফাটিয়ে অস্তিত্ত্ব ও কৃতিত্ব জাহিরের জন্য।

সুন্দরী মেয়েটির কথাই বলছিলাম।

মেয়েটি কোন্‌ দেশের? ছোটোবেলায় পড়েছিলাম, ইরানি ও টার্কিশ মেয়েরা পরীর মতো সুন্দরী। পরে যোগ হয়েছিল লেবানিজ আর ইসরাইলি মেয়েদের চোখ-ধাঁধানো রূপের গল্প। যে-কজন ইরানি-তুরানি-লেবাননি ললনা আমার চোখে পড়েছে, তাদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের মনে হয়েছে ‘অতুলনীয়া’।

ব্রিটিশ, ফিনিশ, জার্মান আর আমেরিকানদের খসখসে চামড়াঅলা চেহারায় কোনও মোহ কিংবা মাদকতা আছে বলে মনে হয় নি। তবে, এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি, ফ্র্যান্সের মেয়েটিকে দেখে, আর পপ-এলিজিকে, আমার মনে হয়েছে, কোনও এককালে বাঙালি-ফ্রেঞ্চ পাশাপাশি বসত ছিল; এদের মধ্যে জিনের এক্সচেঞ্জ ও মিকশ্চার ঘটেছে; কিন্তু তা ঐতিহাসিকভাবে সত্যসম্ভব নয়।

এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি প্রথম সাক্ষাতে যে অপরূপ হাসিটি আমায় উপহার দিয়েছিল, অনেক কাল আগে, সদ্য-কৈশোর-পেরোনো উত্তাল বয়সে আফরোজার একদিনের-একটা হাসির সাথেই কেবল তার তুলনা চলে।

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসেছিল রেসিডেন্ট কোর্ডিনেটরের গা-ঘেঁষা সিটটাতে; সে কি সদ্যনিযুক্ত পার্সোনাল সেক্রেটারি? শুকনো কাঠির মতো ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ; ও যেন কোন্‌ দেশের, ভুলে গেছি; রানি মুখার্জির ফ্যাঁসফেসে গলায় কী অপূর্ব মাধুর্য আছে, তাই না? আর থোবড়ানো পাটের আঁশের মতো এলোমেলো চুলঅলা এ ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ, হাসে খুব শুকনো ঠোঁটে, হ্যান্ডশেকের সময় শরীরের হাড়গুলো যেন কড়কড় করে নড়ে ওঠে, আর মনে হয় ওর মনটাও বড্ড খসখসে। মেয়েদেরকে আমরা 'পেলবতার' সাথে উপমিত করে অভ্যস্ত। কাষ্ঠখণ্ড ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ এদ্দিন পার্সোনাল সেক্রেটারি ছিল। এ মেয়েটি কে? কী সে?

‘স্যার, আমায় কি ডেকেছিলেন?’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে হেডউইগ-এর দিকে তাকাই। বলি, ‘আপনি বরং এখানে বসুন। আমাদের বেশ কিছু পেন্ডিং ইস্যু রয়ে গেছে। আজ সেগুলো ডিস্‌কাশনে তুলতে হবে।।’

আমি ভুল দেখছিলাম চোখে। ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ রেসিডেন্ট কোর্ডিনেটরের পাশে বসে শুকনো মন নিয়ে শুকনো আঙুলে শুকনো নোটবুকে কনফারেন্সের শুকনো বিষয়গুলো নোট করে নিচ্ছে, মিনিট্‌স অফ মিটিঙের জন্য। হেডউইগ ওখান থেকে উঠে এসেছে আমার ইশারা পেয়ে।

হেডউইগ ম্যায়েক্স। ব্রাসেলসের নাগরিকা। সুন্দরী। স্মার্ট। চুলগুলো কালো। ভ্রূ তার কালো। তার চোখের মণিও কালো। ঠোঁটে লিপস্টিক পরেছে, যেভাবে বাঙালি মেয়েরা পরে। একটা ব্রাউন-পিঙ্ক মিশ্র স্ট্রাইপের লং স্কার্টের সাথে ডার্ক ব্লু টপস পরেছে, তার উপর ধবধবে সাদা ওভারকোট। বেলজিয়ামের কোনও মেয়ে এর আগে দেখি নি। হেডউইগ-এর পূর্বপুরুষ বাংলাদেশ বা এর আশপাশের দেশের নাগরিক ছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু হেডউইগের চেহারা ও কথা অবিকল বাঙালি নারীর।

ফলপ্রসূ মিটিঙের পর হেডউইগ আর আমি দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। ও গাড়ি চালায়, আমি ওর পাশে বসে কনফারেন্সের পয়েন্টগুলো আলোচনা করি, আলোচনার অন্তরালে হেডউইগ-এর সমগ্র ভুবন উথাল-পাথাল ঘুরতে থাকি। সুদান ভেঙে যাচ্ছে। দশ হাজার শান্তিরক্ষীকে পাঠানো হয়েছে মূলত সুদানকে শান্তিপূর্ণভাবে টুকরো টুকরো করবার জন্যই, উত্তর সুদানিদের সুদৃঢ় বিশ্বাস; ৯ জুলাইয়ে সিপিএ পিরিয়ড শেষ হবার পর নর্থ সুদানের সরকার এক ঘণ্টাও ইউএনকে নর্থে থাকতে দেবে না; অথচ উভয় সুদানেই আমাদের কর্মকাণ্ড ব্যাপ্ত। আমাদের অফিস ভাগ হয়ে যাবে।

‘আমরা দুজন খার্তুমেই থেকে যাই। কী বলেন, হেডউইগ?’

‘সেটা খুব মন্দ প্রস্তাব নয়। কিন্তু নর্থের ক্রুয়েল গভর্ন্টমেন্ট দারফুরবাসীদের উপর অমানুষিক জেনোসাইট চালাচ্ছে, আমি বরং ওখানে থাকতেই প্রেফার করছি।’

‘আপনি খুব নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছেন, ডিয়ার লেডি হেডউইগ ম্যায়েক্স । আপনার শরীরের জাফরান ঘ্রাণ আপনার মনের সাথে বিলকুল বৈসাদৃশ্যময়।’ এ বলে আমি বাঁ-দিকে কাত হয়ে আলগোছে তার বাহু টেনে কাছে এনে নরম গালে মৃদু টোকার মতো একটা চুমু দিই। হেডউইগ স্মিত হেসে জানায়, ‘অতোটা নই, যতোটা আপনি সব সময় ভাবছেন।’

ব্লু নাইল আর হোয়াইট নাইল যেখানে একত্রে মিশেছে, আর জন্ম দিয়েছে দীর্ঘতম নাইল নদী, তারপর হোয়াইট নাইলের উজান টেনে চলে গেছে সুদানের বৃহত্তম নগরী অম্দুরমানকে পদ-পললে রেখে দক্ষিণ বরাবর, একদিন অপরাহ্নে এই রুটে আমরা কয়েকজন কলিগ সাফ-এর স্পিড বোটে রিভার ক্রুজ করেছিলাম। এমন রোমান্টিক মোমেন্ট জীবনে বহুবার আসে না। স্মারক ফটোগুলো দেখে হেডউইগ আফসোসে ভেঙে পড়েছিল- সাথে থাকতে পারে নি বলে; আর হেডউইগকে রিভার ক্রুজের দিন পাশে বসিয়ে রোমান্স না-করতে পারার বেদনা প্রকাশের কোনও ভাষা আমার ভাণ্ডারে ছিল না।

যেসব মেয়েরা এভাবে প্রতিদিন কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে বসে, অহেতুক টেড়া চোখ তাদের বুক ছিদ্র করে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলে, কদাচিৎ চোখাচোখিও ঘটে, তাদের নিয়ে উড়াল দিতে ভয়ানক সাধ হয়। মেরি-ফ্র্যান্স আর নায়ালা কী অদ্ভুত ঢঙে শার্পিন্টিয়ারের গায়ে গড়াগড়ি খায়। এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রিকে দেখবার দুর্মদ বাসনায় এলিজির ‘লা-ইসলা-বোনিতা’ দেখি; কী কবিতা জড়িয়ে আছে এ গায়িকার প্রত্যঙ্গের প্রতি ভাঁজে! আমার এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি, আমার এলিজি, হায় হেডউইগ, তোমাদের প্রতিদিন কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে দেখি, দেখি আর কৈশোরের আফরোজাকে খুঁজি - ভারী বাতাসে উড়াল দিতে দিতে আমার ডানায় এখন জমাট ক্লান্তি- হায়, তোমরা পরীর দেশে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সরে যেতে থাকো, নীল উড্ডয়নে আমি কেবল ভাসতেই থাকি, জমে যেতে থাকি প্রগাঢ় ঠাণ্ডা ও তমিস্রায়- যেখানে আফরোজার একঝাঁক ছায়া ঝাপসা হাত নেড়ে নেড়ে নিবিড় আকুতি জানায়, আর দিগন্তের সুরের সাথে মিলিয়ে যায়।

*২১ এপ্রিল ২০১১
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৪০
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×