somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসে ছিল

৩১ শে আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মেয়েটি সুন্দরী; আমরা সুন্দরী মেয়েদের নিয়েই কাব্য লিখি; যারা সুন্দরী নয়, তারা বড়জোর মানবতাবাদীদের সামান্য কৃপা পেয়ে থাকে মাঝে-সাঝে, সেটা মেয়েটির জন্য নয় যতোটা, তার চেয়ে ঢের বেশি তাঁদের নাম ফাটিয়ে অস্তিত্ত্ব ও কৃতিত্ব জাহিরের জন্য।

সুন্দরী মেয়েটির কথাই বলছিলাম।

মেয়েটি কোন্‌ দেশের? ছোটোবেলায় পড়েছিলাম, ইরানি ও টার্কিশ মেয়েরা পরীর মতো সুন্দরী। পরে যোগ হয়েছিল লেবানিজ আর ইসরাইলি মেয়েদের চোখ-ধাঁধানো রূপের গল্প। যে-কজন ইরানি-তুরানি-লেবাননি ললনা আমার চোখে পড়েছে, তাদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের মনে হয়েছে ‘অতুলনীয়া’।

ব্রিটিশ, ফিনিশ, জার্মান আর আমেরিকানদের খসখসে চামড়াঅলা চেহারায় কোনও মোহ কিংবা মাদকতা আছে বলে মনে হয় নি। তবে, এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি, ফ্র্যান্সের মেয়েটিকে দেখে, আর পপ-এলিজিকে, আমার মনে হয়েছে, কোনও এককালে বাঙালি-ফ্রেঞ্চ পাশাপাশি বসত ছিল; এদের মধ্যে জিনের এক্সচেঞ্জ ও মিকশ্চার ঘটেছে; কিন্তু তা ঐতিহাসিকভাবে সত্যসম্ভব নয়।

এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি প্রথম সাক্ষাতে যে অপরূপ হাসিটি আমায় উপহার দিয়েছিল, অনেক কাল আগে, সদ্য-কৈশোর-পেরোনো উত্তাল বয়সে আফরোজার একদিনের-একটা হাসির সাথেই কেবল তার তুলনা চলে।

কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে মেয়েটি বসেছিল রেসিডেন্ট কোর্ডিনেটরের গা-ঘেঁষা সিটটাতে; সে কি সদ্যনিযুক্ত পার্সোনাল সেক্রেটারি? শুকনো কাঠির মতো ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ; ও যেন কোন্‌ দেশের, ভুলে গেছি; রানি মুখার্জির ফ্যাঁসফেসে গলায় কী অপূর্ব মাধুর্য আছে, তাই না? আর থোবড়ানো পাটের আঁশের মতো এলোমেলো চুলঅলা এ ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ, হাসে খুব শুকনো ঠোঁটে, হ্যান্ডশেকের সময় শরীরের হাড়গুলো যেন কড়কড় করে নড়ে ওঠে, আর মনে হয় ওর মনটাও বড্ড খসখসে। মেয়েদেরকে আমরা 'পেলবতার' সাথে উপমিত করে অভ্যস্ত। কাষ্ঠখণ্ড ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ এদ্দিন পার্সোনাল সেক্রেটারি ছিল। এ মেয়েটি কে? কী সে?

‘স্যার, আমায় কি ডেকেছিলেন?’ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে হেডউইগ-এর দিকে তাকাই। বলি, ‘আপনি বরং এখানে বসুন। আমাদের বেশ কিছু পেন্ডিং ইস্যু রয়ে গেছে। আজ সেগুলো ডিস্‌কাশনে তুলতে হবে।।’

আমি ভুল দেখছিলাম চোখে। ব্ল্যাঙ্কা লোপেজ রেসিডেন্ট কোর্ডিনেটরের পাশে বসে শুকনো মন নিয়ে শুকনো আঙুলে শুকনো নোটবুকে কনফারেন্সের শুকনো বিষয়গুলো নোট করে নিচ্ছে, মিনিট্‌স অফ মিটিঙের জন্য। হেডউইগ ওখান থেকে উঠে এসেছে আমার ইশারা পেয়ে।

হেডউইগ ম্যায়েক্স। ব্রাসেলসের নাগরিকা। সুন্দরী। স্মার্ট। চুলগুলো কালো। ভ্রূ তার কালো। তার চোখের মণিও কালো। ঠোঁটে লিপস্টিক পরেছে, যেভাবে বাঙালি মেয়েরা পরে। একটা ব্রাউন-পিঙ্ক মিশ্র স্ট্রাইপের লং স্কার্টের সাথে ডার্ক ব্লু টপস পরেছে, তার উপর ধবধবে সাদা ওভারকোট। বেলজিয়ামের কোনও মেয়ে এর আগে দেখি নি। হেডউইগ-এর পূর্বপুরুষ বাংলাদেশ বা এর আশপাশের দেশের নাগরিক ছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু হেডউইগের চেহারা ও কথা অবিকল বাঙালি নারীর।

ফলপ্রসূ মিটিঙের পর হেডউইগ আর আমি দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। ও গাড়ি চালায়, আমি ওর পাশে বসে কনফারেন্সের পয়েন্টগুলো আলোচনা করি, আলোচনার অন্তরালে হেডউইগ-এর সমগ্র ভুবন উথাল-পাথাল ঘুরতে থাকি। সুদান ভেঙে যাচ্ছে। দশ হাজার শান্তিরক্ষীকে পাঠানো হয়েছে মূলত সুদানকে শান্তিপূর্ণভাবে টুকরো টুকরো করবার জন্যই, উত্তর সুদানিদের সুদৃঢ় বিশ্বাস; ৯ জুলাইয়ে সিপিএ পিরিয়ড শেষ হবার পর নর্থ সুদানের সরকার এক ঘণ্টাও ইউএনকে নর্থে থাকতে দেবে না; অথচ উভয় সুদানেই আমাদের কর্মকাণ্ড ব্যাপ্ত। আমাদের অফিস ভাগ হয়ে যাবে।

‘আমরা দুজন খার্তুমেই থেকে যাই। কী বলেন, হেডউইগ?’

‘সেটা খুব মন্দ প্রস্তাব নয়। কিন্তু নর্থের ক্রুয়েল গভর্ন্টমেন্ট দারফুরবাসীদের উপর অমানুষিক জেনোসাইট চালাচ্ছে, আমি বরং ওখানে থাকতেই প্রেফার করছি।’

‘আপনি খুব নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছেন, ডিয়ার লেডি হেডউইগ ম্যায়েক্স । আপনার শরীরের জাফরান ঘ্রাণ আপনার মনের সাথে বিলকুল বৈসাদৃশ্যময়।’ এ বলে আমি বাঁ-দিকে কাত হয়ে আলগোছে তার বাহু টেনে কাছে এনে নরম গালে মৃদু টোকার মতো একটা চুমু দিই। হেডউইগ স্মিত হেসে জানায়, ‘অতোটা নই, যতোটা আপনি সব সময় ভাবছেন।’

ব্লু নাইল আর হোয়াইট নাইল যেখানে একত্রে মিশেছে, আর জন্ম দিয়েছে দীর্ঘতম নাইল নদী, তারপর হোয়াইট নাইলের উজান টেনে চলে গেছে সুদানের বৃহত্তম নগরী অম্দুরমানকে পদ-পললে রেখে দক্ষিণ বরাবর, একদিন অপরাহ্নে এই রুটে আমরা কয়েকজন কলিগ সাফ-এর স্পিড বোটে রিভার ক্রুজ করেছিলাম। এমন রোমান্টিক মোমেন্ট জীবনে বহুবার আসে না। স্মারক ফটোগুলো দেখে হেডউইগ আফসোসে ভেঙে পড়েছিল- সাথে থাকতে পারে নি বলে; আর হেডউইগকে রিভার ক্রুজের দিন পাশে বসিয়ে রোমান্স না-করতে পারার বেদনা প্রকাশের কোনও ভাষা আমার ভাণ্ডারে ছিল না।

যেসব মেয়েরা এভাবে প্রতিদিন কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে বসে, অহেতুক টেড়া চোখ তাদের বুক ছিদ্র করে নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে ফেলে, কদাচিৎ চোখাচোখিও ঘটে, তাদের নিয়ে উড়াল দিতে ভয়ানক সাধ হয়। মেরি-ফ্র্যান্স আর নায়ালা কী অদ্ভুত ঢঙে শার্পিন্টিয়ারের গায়ে গড়াগড়ি খায়। এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রিকে দেখবার দুর্মদ বাসনায় এলিজির ‘লা-ইসলা-বোনিতা’ দেখি; কী কবিতা জড়িয়ে আছে এ গায়িকার প্রত্যঙ্গের প্রতি ভাঁজে! আমার এ্যান-সোফি-এ্যালেগ্রি, আমার এলিজি, হায় হেডউইগ, তোমাদের প্রতিদিন কনফারেন্স টেবিলের উলটো পাশে দেখি, দেখি আর কৈশোরের আফরোজাকে খুঁজি - ভারী বাতাসে উড়াল দিতে দিতে আমার ডানায় এখন জমাট ক্লান্তি- হায়, তোমরা পরীর দেশে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে সরে যেতে থাকো, নীল উড্ডয়নে আমি কেবল ভাসতেই থাকি, জমে যেতে থাকি প্রগাঢ় ঠাণ্ডা ও তমিস্রায়- যেখানে আফরোজার একঝাঁক ছায়া ঝাপসা হাত নেড়ে নেড়ে নিবিড় আকুতি জানায়, আর দিগন্তের সুরের সাথে মিলিয়ে যায়।

*২১ এপ্রিল ২০১১
৫৬টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×