somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাবার জন্য অমৃতফল

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৪ ভোর ৪:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার বাবা যেদিন মৃত্যুশয্যায় পড়ে গেলেন, সেদিন থেকেই তাঁর পানাহার বন্ধ হয়ে গেলো। বাবার সিথানে বসে আমরা ভাইবোনেরা শিশুদের মতো কান্নাকাটি করি। আমাদের কলেজ-ভার্সিটি-পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা কাছে বসে সান্ত্বনা দিতে সচেষ্ট হয়।
‘বাবা, কিছু খাইবেন? খান না একটা আতাফল। আতাফল তো আপনার অনেক প্রিয়।’ বাবাকে এ কথা বললেই তিনি ইশারায় বুঝিয়ে দেন, তাঁর কোনো কিছুতেই আর রুচি নেই। মালটা চিপে রস বানিয়ে তাঁর মুখে ধরি, চামচ দিয়ে স্যুপ এগিয়ে নেই। না, বাবা আর কিছুই খাবেন না। তাঁর কথাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, বেশিরভাগ কথা আকার-ইঙ্গিতে বলেন।

হঠাৎ একরাতে বাবা বিছানায় উঠে বসলেন। ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
‘পায়খানা ধরছে, বাবা? বাটি আনি?’
‘কাউকে ডাকবো? খোঁজেন কাউকে, বাবা?’
আমরা শরীর, হাত ও পা মালিশ করতে করতে বলি, ‘বাবা, আপনার কি অনেক কষ্ট হইতেছে?’
বাবা কোনো কথা বলেন না। তাঁর চোখে পানি টলমল করে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে মা হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।
হঠাৎ বাবা কথা বলে উঠলেন। আমরা সচকিত হই। খুব অস্ফুট স্বরে বাবা একটা ফলের কথা বলেন, যে ফলটি ছোটোবেলায় তাঁর বাবা তাঁকে বহুদূরের গঞ্জের হাট হতে এনে দিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ জীবনে তিনি সেই ফল অনেক খুঁজেছেন, পান নি। মৃত্যুর আগে সেই অমৃতময় ফলটি খাওয়ার জন্য তাঁর প্রাণ ছটফট করছে।

আমি সেই রাতেই পৃথিবীর বিরলতম ফলটির সন্ধানে বের হয়ে পড়লাম। সঙ্গী হলো আমার বড় ছেলে। গ্রাম থেকে গ্রাম, গঞ্জ থেকে গঞ্জ আমরা ঘুরতে থাকি ফলের সন্ধানে। রোদে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি। খিদেয় আমাদের পেট পুড়ে যায়। কেউ সেই ফলের সন্ধান জানে না। আমি হতাশায় কাতর হয়ে পড়ি। হায়, মৃত্যুকালে আমার বাবার সাধটি অপূর্ণই থেকে যাবে!
আমরা আরও অনেক দূরের গঞ্জের দিকে রওনা হই। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পা অবশ হয়ে আসে। পায়ের পাতা ছিঁড়ে যায়। মাথার চাঁদি ফেটে মগজ বেরুবার উপক্রম হয়। কিন্তু আমাদের আশা মরে না- হয়তো আমরা পরের গ্রামেই ফলটি পেয়ে যাবো।

‘বাবা!’
আমার ছেলে কী যেন বলতে চাইল। ওর দিকে তাকাতেই সে মাথা নীচু করলো। তাঁকে খুব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ও হতাশাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। আমি জানি সে কী বলতে চায়। তাকে বুঝিয়ে বলি, ‘শোনো বাবা, এটাই হয়তো তোমার দাদার শেষ ইচ্ছা। সারাজীবন তিনি আমাদের কত না ফল, কত না অমৃত আর মধু খাওয়াইছেন। মরণকালে সেই বাবাকে একটা ফল খাওয়াইতে পারবো না? যে-বাবার জন্য এই পৃথিবীর মুখ দেখলাম, সেই বাবাকে ফল না খাওয়াইতে পারলে আল্লাহ কত নারাজ হইবেন, তা কি তুমি বোঝো না?’
আমার ছেলের চোখ বেয়ে টুপটুপ করে পানি ঝরে পড়লো। সে খুব ব্যথিত ও লজ্জিত হলো। বললো, ‘বাবা, ইনশাল্লাহ, দাদাজানের জন্য ফল আমরা পাবোই। চলেন, যত দীর্ঘ পথই হোক না কেন, দাদাজানের জন্য ফল না নিয়া আমরা ঘরে ফিরবো না।’


আমার ছেলেমেয়েগুলোকে পাগল ছাড়া আর কী বলা যায়, বলুন? একেকদিন একেক ধরনের ফল আনবে, আর বলবে, ‘বাবা, আপনার আর কী কী খাইতে মন চায়, বলেন তো?’ পৃথিবীর কোন প্রান্তে কী ফল জন্মে, কোন জগতে কোন খাবার আছে- প্রতি সপ্তাহে এসব নিয়ে আমার সামনে হাজির। আমি হাসি। আল্লাহ আমাকে কত সুখ দিয়েছেন! ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চোখ ভিজে ওঠে।

আমার বাবার কথা মনে পড়ে। বাবার জন্য শেসমেষ অমৃত ফলটি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটি তাঁকে খাওয়াতে পারি নি। বাড়িতে ফিরে আসার আগেই তিনি ফলের তৃষ্ণা বুকে নিয়ে পরলোকের পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

৯ আগস্ট ২০১৪




উৎসর্গ

ছেলেকে, যারা বাবাকে বোঝে না, যদ্দিন না তারা নিজেরা বাবা হয়।

২৭টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×