১
একজন রমণী, কিংবা নারী- বিকেলের নরম রোদ পেছনে ফেলে শান্ত সৌম্য পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটা ছোট্ট ছেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার মা যখন হাঁটতো, ঠিক এমনি করেই হাঁটতো। রমণী হেঁটে যাচ্ছেন। তার শাড়ির আঁচল একপাশে ঝুলে পড়ে বাতাসে উড়ছে। শৈশবে মায়ের হাত ধরে গুঁটি গুঁটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আঁচলের ঝাঁপটায় তার মুখ ঢেকে যেত। দু’হাত পাখার মতো দু’দিকে ছড়িয়ে দিয়ে আঁচল ভেদ করে মুখের হাঁ আর নাক দিয়ে শুউশ্শ্ শব্দে সে বাতাস টানতো। তার খুব ভালো লাগতো। মা মারা গেছে সেই কবে; মায়ের ঘ্রাণও সে ভুলে গেছে। কখনো-বা হঠাৎ হঠাৎ কোথাও থেকে মায়ের একদঙ্গল ঘ্রাণ দমকা হাওয়ার মতো ভেসে এসে যখন ওর মুখ ভিজিয়ে দেয়- মা মা বলে সে করুণ আর্ত স্বরে গুমরে কেঁদে ওঠে; ওর বুক ফেটে যেতে চায়, আর মনে হয় পাঁজরগুলো যেন ভেঙে যাচ্ছে।
২
সে এক তরুণী। খোঁপায় গুঁজেছে ফুল। কী সুন্দর ঢঙে ছন্দের মতো চরণ ফেলে সে হেঁটে যাচ্ছে। বাতাসে মৌ মৌ করছে ফুলের ঘ্রাণ। বেলি ফুল। হাসনাহেনা। রজনিগন্ধা। আরো নাম জানা বা না-জানা হাজারো ফুলের ঘ্রাণে টগবগে ছেলেটা মাতাল হয়ে যাচ্ছে। বয়সটাই এমন। মেয়েদের খুব ভালো লাগে। খুব সহজেই মেয়েদের চোখে চোখ পড়ে যায়। প্রতিটা চোখেই কত শত কথা লুকানো। কত কথা যেন বলতে চায় চোখগুলো।
তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। একটা লতানো কবিতার মতো সে দুলে দুলে হাঁটছে। ধীর লয়ে, ধীর পায়ে। সে ডানে তাকায়, বামে তাকায়। মাঝে মাঝে আকাশে তাকায়। আকাশে মেঘ নেই। কী দেখে সে আকাশে? হায়, একবার যদি পেছন ফিরে তাকাতো! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটার মুখ। দেখতে ইচ্ছে করছে অনন্ত মাধুর্যে ভরা সেই মুখে একটুকরো হাসির বিভা। একটু দ্রুত হাঁটে ছেলেটা। আরেকটু পা বাড়ালেই বামে ঘাড় ঘুরিয়ে সে মেয়েটার মুখ দেখতে পাবে। একটা দুরন্ত তৃষ্ণা জেগে ওঠে মেয়েটার মুখ দেখার জন্য।
মেয়েটা হাঁটছে; হাঁটছে মেয়েটা। ধীর পায়ে হাঁটছে; হাঁটছে ধীর লয়ে। একটা স্নিগ্ধ কবিতার মতো গন্ধ ছড়িয়ে হাঁটছে। হাঁটার ঢঙটিতেই এক অপরূপ শিল্প ফুটে উঠছে। ছেলেটা জানে না, বুঝতে পারে না- মেয়েরা কীভাবে এত সুন্দর করে হাঁটে। একপলক মেয়েটার মুখ দেখার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠলো।
কিন্তু হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে মেয়েটা হারিয়ে গেল। হায়, দেখা হলো না কবিতার মতো স্নিগ্ধ মুখখানি! আক্ষেপ আর বেদনায় তার মন ভরে উঠলো। যতদূর গেল, যতদিন গেল- অনেক অনেকদিন ধরে তার মনে জেগে থাকলো মধুর ছন্দে হেঁটে যাওয়া একটি অপরূপা কবিতার ছায়া, এবং তারপরও মেয়েটার হেঁটে-যাওয়া ছায়াটি তার মন থেকে কোনোদিন মুছে গেল না।
৩
সন্ধ্যার কিছু আগে। একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের রাস্তায় গভীর মগ্নভাবে তাকিয়ে আছেন তিনি। গোধূলির অপূর্ব সৌন্দর্যে তার মন আকুল হয়ে উঠছে। এ সময়ে ধীর পায়ে হালকা নীলরঙা শাড়ি পরে যে মেয়েটিকে হেঁটে যেতে দেখলেন, তার মনে হতে থাকলো- এটি কিছুদিন আগে অকালে মরে যাওয়া তার মেয়েটিই যেন।
২৬ মে ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৯ রাত ১০:২৮