somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদেশের ঘরে দেশের স্মৃতি

২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি জীবনের একেকটা সময়ে একেকটা জিনিসের পোকা ছিলাম।

খুব ছোটোবেলায় ঘুড়ি উড়ানোর পোকা ছিলাম। কথিত আছে, একবার আমাকে ঘুড়িতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, এক বুড়ি নানি আমার ঝুলন্ত পা টেনে ধরে রেখেছিলেন অনেকক্ষণ, তারপর বহুকষ্টে নীচে নামাইতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই কাহিনি নিয়া আমার গল্পও আছে।

ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বইয়ের পোকা ছিলাম। ঠিক এই সময়েই রেডিও'র পোকাও ছিলাম। ঘুমানোর সময় কানের কাছে মৃদু ভলিয়্যুমে রেডিও ছেড়ে রাখতাম, স্বপ্নের ভেতর গান শুনবো বলে। এর একটু পরে ক্যাসেট প্লেয়ারের পোকা হয়ে পড়লাম। নতুন ক্যাসেট বেরোলেই কিনে ফেলতাম, পছন্দের গান রেকর্ড করতাম। রাতভর ননস্টপ গান ছেড়ে রাখা আর স্বপ্নের ভেতর গান শোনা ছিল মধুরতম সুখ (পার্শ্ববর্তীরা কেউ কেউ উপভোগ করতেন, বেশির ভাগই বিরক্ত হতেন)।

এর পরের সময়টা খুব ভয়াবহ ছিল। আমি টিভির পোকা হয়ে গেলাম। তখন শুধু একটাই চ্যানেল- বিটিভি; পৌনে তিনটার সময় প্রাক-অনুষ্ঠানাদি শুরু হতো, তিনটায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে চলতো রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। কোরআন তেলাওয়াত এবং বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো ও জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দিনের অনুষ্ঠান শেষ হতো। হায়, এত সকালেই টিভিটা বন্ধ হয়ে গেল! আমি খুব মনমরা হয়ে টিভিরুম ছাড়তাম।

১৯৯৩-এ আইসিসিতে কেনিয়ার কাছে পরাজয়ের পর ১৯৯৬ বিশ্বকাপেও বাংলাদেশের খেলার স্বপ্ন তিরোহিত হয়ে গেলে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, ১৯৯৭-এ সেমিফাইনালে আয়ারল্যান্ডকে হারানোর মাধ্যমে ১৯৯৯-বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলার সোনার ভিসা পেয়ে গেলেও ১৯৯৩-এর ক্ষত বুকের ভেতর রয়েই গেল। তবে আমি ক্রিকেটের পোকা হয়ে গেলাম ১৯৯৩-এ বাংলাদেশের হারের পর থেকেই- খেলোয়াড় হিসেব খুব সামান্যই, তবে ক্রিকেট সাবজেক্টটা আমার কাছে সবচেয়ে স্মার্ট, আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য হয়ে উঠলো; ক্রিকেটের যাবতীয় তথ্য হাতের কাছে চলে এলো। ক্রিকেট উন্মাদনা চললো ২০০৪ পর্যন্ত। এর মাঝখানে ২০০১-২০০২-এ এক বছরের জন্য সিয়েরা লিওন ছিলাম; সেখানে স্যাটেলাইটে ক্রিকেট দেখার সুযোগ না পেলেও ইন্টারনেট ব্রাউজিংয়ে সর্বকালের সেরা সময়টা কাটিয়েছি সেখানেই। ইন্টারনেটে ক্রিকেট আমার নেশা হয়ে গেল। আমার ঘুম, নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেল, আমি ক্রিকেটের নানান তথ্য ডাউনলোড করি আর একের পর এক সিডিতে তা রেকর্ড করি।

এ লেখাটায় যা লিখবো তা হলো সেই সিয়েরা লিওনের দিনগুলোর কথা।

মানুষ কোনো কিছুরই দীর্ঘদিন ধরে পোকা হয়ে থাকতে পারে না, একঘেঁয়েমি দানা বাঁধে ধীরে ধীরে। বিদেশের মাটিতে একসময় ইন্টারনেটও আমার মন আর ধরে রাখতে পারলো না। দেশের মাটিতে, অনেক অনেক দূরে, ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে, স্ত্রীর ছবি, ছেলের ছবি, মেয়ের ছবি, বাবার ছবি, মায়ের ছবি, ভাইবোন, বন্ধুবান্ধবদের ছবি খুব করুণ ভাবে চোখে ভেসে ওঠে, আর নীরবে চোখের কোনা জ্বলে যেতে থাকে।

এই বিষণ্ণতা কাটানোর কত রকমের পদ্ধতি আমাদের!

এর আগে, ২০০০ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত একবার পাকিস্তানে ছিলাম। সেখানেও এরকম হোম-সিকনেস পেয়ে বসেছিল। কী আর করা, সস্তায় একটা ৭ ইঞ্চি রঙিন টিভি কিনেছিলাম।

পাকিস্তানের সেই ছোট্ট টিভিটা সিয়েরা লিওনে আমার রুমে। রুমমেটের একটা ভিসিআর আছে, আমার আছে আরেকটা ক্যাসেট প্লেয়ার। বিকেল হলেই আমাদের রুমে আড্ডা বসে। আমরা ৩-৪ হালি বাংলাদেশী ব্যাচেলর বসে যাই তাস খেলতে।

আমরা তাস খেলি, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে আমার ক্যাসেট প্লেয়ার বাজে। আমার অনেকগুলো ক্যাসেটের মধ্যে একটা নির্বাচিত পুরোনো দিনের গানের ক্যাসেট আছে; এটি আরও বছর আষ্টেক আগে খুব যত্ন করে গান বাছাই করে ক্যাসেটের দোকান থেকে রেকর্ড করিয়েছিলাম। সেই ক্যাসেটটা বাজে। এ ক্যাসেটের গানগুলো আমার অনেক অনেক প্রিয়। এ ক্যাসেটটা যখন বাজানো হয়, তখন আমাদের রুমটা জমজমাট হয়ে ওঠে; সুরে সুরে সবার মাথা দুলতে থাকে; কেউ কেউ শিল্পীর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে ওঠে। ক্যাসেটটা এতই বাজানো হতো যে কোন গানের পর কোন গান বাজবে, তা যেন সবারই মুখস্থ হয়ে গেল।

একদিন তাস খেলা চলছিল। কেউ একজন ক্যাসেট প্লেয়ারে পুরোনো দিনের গানের ক্যাসেটটা না চালিয়ে অন্য আরেকটি ক্যাসেট চালালো, আর সাথে সাথে সবাই সমস্বরে বলে উঠলো : আরে, ওটা সরাও, খলিল, তোমার ঐ পুরোনো দিনের ক্যাসেটটাই লাগাও।

রাত ২-৩টা পর্যন্ত আমাদের রুমেই খাওয়া-দাওয়া চলতো, তাস খেলা ও আড্ডা দেয়া চলতো। আর মাঝে মাঝে দল বেঁধে আমরা মুভি দেখতাম।

যখন সব মুভি দেখা শেষ হয়ে গেল, তখন আমরা বাংলাদেশী বাংলা ছবি দেখা শুরু করলাম। দেশ থেকে বাংলা ছবি পাঠানো হতো। মনে হতো, এসব বাংলা ছবির চেয়ে ভালো কোনো ছবিই হতে পারে না। শাহনাজ, শাবনূর, একা, পপি নামে যে বাংলাদেশে বেশ কিছু ভালো নায়িকা আছেন, বিদেশের মাটিতে না এলে হয়ত তাঁদেরকে চেনাই হতো না। জেনিফার লোপেজ বা ঐ সময়ের হটকেক কারিনা কাপুরকে খুব নস্যি মনে হতো লাগলো। কারো প্রিয় নায়িকা শাবনূর, কারো একা, কারো পপি, ইত্যাদি ...

সবাই যখন যার যার রুমে চলে যেত, একটা ছেলে রয়ে যেত। ওর নাম খালেদ। ওর তিনটা মেয়ে। প্রথমটার বয়স ৮, পরের দুটো টুইন, ৩-৪ বছর হবে হয়ত।

খালেদ আমার রুমে বসে ক্যাসেট প্লেয়ার বাজাতো। অনেকক্ষণ ধরে রিওয়াইন্ড বা ফরওয়ার্ড করে ও একটা গানই বার বার শুনতো। শুনতো আর চোখ মুছতো।

আমার মনপাখিটা যায়রে উড়ে যায়
ধান শালিকের গাঁয়
নাটা বনের চোরা কাঁটা ডেকেছে আমায়

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ সিয়েরা লিওনে অন্ধকার রাতের নীচে ঠান্ডা হয়ে আসা ঘরের নিভৃত কোণে বসে খালেদ যখন বার বার চোখ মোছে, তখন আমারও বুক হুহু করে কেঁদে ওঠে। আমার স্ত্রীর দু’পাশে আমার দুটো ছেলেমেয়ে করুণ হৃদয়ে আমার জন্য ছটফট করে, আমার মনপাখিটা সমস্ত বাঁধ ভেঙে নিরন্তর ওদের কাছে ছুটে যেতে চায়। হায়, কবে আমি ওদের বুকের পিঞ্জরে লেপ্টে নেব?

আমি যখন যেথা থাকি
হৃদয় ভরা স্বপন হয়ে
বাঁধন হয়ে আপন হয়ে
জড়িয়ে থাকি বাংলাদেশের ভালবাসার রাখি।

৮০’র দশকে রেডিওতে প্রথম শুনেছি এ গানটা। সেই সাথে নীচের এ গানটাও :

স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে,
আমার অনেক ঋণ আছে ঋণ আছে

তারপর ক্যাসেট প্লেয়ারে তন্ময় হয়ে শুনেছি গানদুটো। আজও পরিবার ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে ঐ গান দুটো খুব শুনি আর নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে উঠতে থাকে।

শুধু এই গান দুটোর জন্যই এই দীর্ঘ বাতুলতা। নীচে আপনাদের জন্য গান দুটো শেয়ার করলাম।

৪ মে ২০০৯


আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায় - রুনা লায়লা



স্মৃতি ঝলমল সুনীল মাঠের কাছে - রুনা লায়লা






সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ১০:৩৯
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×