somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের গন্ধ

০৬ ই মে, ২০২১ রাত ৯:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হয়ত আপনাদেরও এমন হয়। শৈশবের কিছু কিছু জিনিস কল্পনা করলেই নাকের কাছে তার তাজা ঘ্রাণ পাই। আমাদের অল্প ক'টি জমি ছিল। ধান কাটা হলে বাড়ির মাঝখানের দুয়ারে গরু চরিয়ে ধান মলন দেয়া হতো। এই যে এখন আমি লিখছি, চোখের সামনে সেই ধান মাড়ানোর দৃশ্য ভেসে উঠছে, আর নাকের কাছে ভুরভুর করছে তাজা খ্যাড়ের গন্ধ। খ্যাড় শুকানোর পর জড়ো করার সময় ভাইবোনেরা খ্যাড়ের গাদায়, আকাশে খ্যাড়ের গুচ্ছ উড়িয়ে দিয়ে, আবার সারা শরীরে খ্যাড় মেখে খেলা করতাম। এখনো সেই খ্যাড়ের গন্ধ নাকে ভাসছে। বাড়ির বাইরে, রাস্তার ধারে আমন ধানের নাড়ার পালা দেয়া হতো। নাড়ার গাঁদায় আমরা পলানতি খেলতাম। নাড়ার গন্ধটা খুব শুকনো, এখনো সজীব।

ঘরের এককোণে একটা ডোল ছিল। ডোলের ভেতর ধান রাখা হতো। ওখানে ঢুকে জোরাসিন দিয়ে বসে উবু হয়ে দু’হাতে ধান নাড়তাম। কাঁচাগাবের কষ-মাখানো ডোলের একটা গন্ধ ছিল। ধান আর ডোলের গন্ধ মিশে অন্য একটা গন্ধ হতো। চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলে ঐ গন্ধটা পাই, আর আমার ছোট্ট ‘আমি’কে দেখি – মুঠো ভরে ধান নাড়ছে, আর গভীর হয়ে ভাবছে, একটা বছর পার হবে তো এই এক-ডোল ধানে!

খুব ভোরে মা-চাচিরা ধান সিদ্ধ করতো। সিদ্ধ ধানের ভাঁপের একটা গন্ধ ছিল। দুয়ারে সেই ধান শুকানো হতো। দুয়ার থেকে ধানের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। ঢেঁকিতে ধান ভানতো। কুঁড়ার গন্ধ, নতুন চাউলের গন্ধ, তূষের গন্ধ- প্রতিটা গন্ধই ছিল খুব আলাদা।

তেমনি, মুড়ি ভাঁজার দিনও খুব ভোরে উঠতো মা-চাচিরা। অনেকক্ষণ লবণ-রঁসুন-মসলা-মাখানো মুড়ির চাউল জ্বাল দেওয়ার পর আগুন-গরম বালুর হাঁড়িতে সেই চাল ফেলে অপরূপ এক ছন্দের মাধ্যমে হাঁড়িটি দোলানো হতো। পুটপুট পুটপুট শব্দে চাউল থেকে মুড়ি ফুটতো, ক্ষুদ্র ধবল পোনামাছের মতো লাফাতো; তারপর বালুসমেত মুড়ির হাঁড়িটি কাত করে ঝাঁঝরে ফেলা হতো। যারা এ দৃশ্য দেখেছেন, ভাবুন, সেই দৃশ্যটি- আর সেই মৌ মৌ মুড়ির গন্ধ, রঁসুনে মাখা।

আমাদের কয়েকটা গাভী ছিল। আমাদের পরিবারের অংশ ছিল ওরা। আমাদের সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে ওরা চিনতো। একদিন গাভীগুলো এক গ্রামবাসীর কাছে বিক্রি করে দিলাম। যতদিন ও-বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছি, কিংবা রাস্তায় ওদের সাথে দেখা হয়েছে, ওরা ছুটে আমার কাছে দৌড়ে আসতো। আমার শরীর ঘেঁষতো। মুখ দিয়ে শরীরের গন্ধ শুঁকতো। গোয়াল থেকে ছুটতে না পারলে আমার চলার পথে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো, ওদের চোখের কোণ ভিজে যেত, আমার বুকও হুহু করে উঠতো। ওদের শরীরের গন্ধ আমার সারা শরীরে লেগে আছে, এমন মনে হয় ওদের কথা ভাবলেই।

গোয়ালার মতো গাভীর দুধ দোহাতাম আমি। দুধ দোহানোর সময় প্রায়ই একটা দুষ্টুমি করতাম। গাভীর বাঁছুরের মতো আমিও গাভীর বানে মুখ দিয়ে দুধ টানতাম।

আরেকটা মজার খাবার ছিল, জানি না আপনারা কেউ কখনো খেয়েছেন কিনা। দুধ দোহানোর পর কাঁচা দুধ দিয়ে শুধু লবণে মেখে পান্তাভাত দারুণ লাগে। এটা আমি প্রায়ই খেতাম। হায়, ঐ মজাটা পাওয়ার আর কোনো সুযোগই নাই এখন আর।

আরো কিছু গন্ধ আছে। ঘাস কাটার সময়, বিশেষ করে আড়িয়াল বিলে, কিছু কিছু ঘাসে খুব মাদকতাময় গন্ধ ছিল। মাঝে মাঝেই সেই গন্ধের কথা মনে পড়ে, গন্ধেরা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে থাকে, নাকের খুব গভীরে ঢুকে সুড়সুড়ি দেয়।

বর্ষায় শাপলা, কচুরিপানা তুলতাম আড়িয়াল বিল থেকে, বাড়ির উত্তরের ধানভাসা চক থেকে। ডুব দিয়ে শাপলার গোড়া থেকে ঝুঁটিওয়ালা শালুক তুলতাম। কাদার সেই গন্ধটা খুব অদ্ভুত ছিল, শাপলা আর কচুরিফুলের ঘ্রাণটা ছিল বুকজুড়ানো শান্তির মতো। গন্ধগুলো নাকে ভাসে, মনে হলেই।

আষাঢ়ের ক্ষেতে কোমর পানিতে উবু হয়ে পাট কাটা হতো। পাটক্ষেতের পানিতেই সেই পাট জাগ দেয়া হতো। পাট জাগ হলে নৌকা করে বাড়ির ঘাটে আনা হতো। খালের পাড়ে যেন মেলা বসতো- সারি সারি মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা, মা-চাচিরা, বোনেরা, পিঁড়িতে বসে পাট বাছতো, অর্থাৎ, পাটের কাণ্ড থেকে পাটের আঁশ আলাদা করতো। সামনে পাটখড়ি, একপাশে আঁটিবাঁধা পাটের আঁশ। চারদিকটা তখন পাটের গন্ধে ছেয়ে যেত। শরীরেও সেই গন্ধটা লেগে থাকতো। পানিতে পাট খাঁচার সময় (অর্থাৎ, পাট ধোয়ার সময়) শরীরে গন্ধটা আরো বেশি লাগতো। পাটের সেই পঁচাগন্ধ, ঘষির গন্ধ (গোবর শুকিয়ে বানানো ঘুঁটে), আথালের গন্ধ, আধুনিক পারফিউমের গন্ধের চাইতেও অনেক মধুর ও সহজাত ছিল। এখনো ভাবলেই কোমর-ডোবা পানিতে পাট-জাগের পাশে দাঁড়িয়ে নৌকায় পাট-তোলা আমাকে দেখতে পাই, ভুরভুর করে পাটের গন্ধ ছুটে এসে নাক ভাসিয়ে দিচ্ছে। আহ! আমার শৈশবের গন্ধ। তোমার জন্য আমার বুকভরা এত কান্না কেন?

নুরুদের বাড়িতে ডঙ্গলফল, খাঁয়গো বাড়ির ঝুপড়ি গাবগাছেরর পাকা গাব, এগুলো এত খেয়েছি, মনে হলেই গন্ধে মাতাল হয়ে যাই।

আরো অনেক গন্ধ আছে, ফল, ফুল, গাছ ও পাখি আছে, আছে আবুল, জসীম, করিমের সান্নিধ্যের গন্ধ, আছে ধাপারি খালের মাছ গাবানির গন্ধ, আড়িয়াল বিলের নৌকা বাইচের গন্ধ।

এগুলো হলো শৈশবের গন্ধ, মনে হলেই বুঁদ হয়ে যাই, মায়ের গন্ধের মতো, যা কোনোদিন ভোলা যায় না, সতত নাকের কাছেই বাতাসে মায়া জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকে।

আপনাদের গ্রামে কেউ কি এখনো এই গন্ধগুলো পান? কিংবা, কারো কাছে কি এসব গন্ধের কোনো সন্ধান আছে? কিংবা কখনো এসব গন্ধের কথা শুনেছেন?

অথচ এ গন্ধ আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, নতুন গন্ধের বীজ বোনার প্রণোদনা দেয়। আর এ গন্ধগুলোই হলো বাংলার আদি ও এক্কেবারে অকৃত্রিম গন্ধ।

০৪ মে ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ রাত ১০:৪৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×