somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তিলাবুবুর কথা

২৬ শে এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একদিন পেছন থেকে হঠাৎ দু’হাতে আমার চোখ বন্ধ করে কে যেন বলে উঠলো, ‘বল্‌ তো, কে আমি?’ আমি তার চোখ ছাড়িয়ে উলটো ঘুরতেই একফালি হাসি উড়িয়ে সে বললো, ‘আমি তোর তিলাবুবু, আমাকে চিনলি না, বাবুসোনা? এই দেখ, আমার ডান অধরে এই যে একটা কালো তিল, এজন্য আমার নাম তিলাবুবু।’ বুবুর ডান অধরের তিল তাকে করেছে তিলোত্তমা। বুবু যখন হাসলো, আমি তার হাসির বিভায় মিশে গেলাম। তিলাবুবু এরপর বলতে থাকলো, ‘আমি তোর পাশের গাঁয়ে থাকি; আড়িয়াল বিলের উত্তর পাড়ে আমার ঘর আর বর।’

কখনো কখনো কেন যে এত বেশি ভালো লাগে জানি না। মন খুব হালকা থাকে আর শুধু ভালো লাগে, শুধু ভালো লাগে, আর ভালো লাগে শুধু। এমন ভালোলাগা-সময়ে কাউকে ভাবতেও অনেক অনেক অনেক বেশি ভালো লাগে। যেমন ধরো, আজ সকাল থেকেই তিলাবুবুর কথা উথলে উঠছে মনের ভেতর। বুবুর কথা ভাবছি আর সুনিবিড় সুখে আমার বুক ভেসে যাচ্ছে; অতলান্ত আনন্দে আমার হৃদয় দুলছে নৃত্যচ্ছন্দে।

আমার তিলাবুবু, কেমন আছে, কোথায় আছে অনেকদিন সে খবর জানা নেই। আমার জানা নেই, আমার তিলাবুবু কোন ভুবনে কোন দেশে বসত গড়েছে শেষে।

আমার তিলাবুবু আমার সহোদরা নয়, কিন্তু সে আমাকে এর চেয়েও অধিক ভালোবাসে; আমিও তার বাৎসল্যের গভীরে ডুবে গিয়ে পৃথিবীকে ভালোবাসতে শিখেছি। তিলাবুবু আমাকে শিখিয়েছে ভালোবাসতে হবে মানুষকে, যতখানি ভালোবাসা ভেতরে আছে তার সবটুকু বিলিয়ে দিতে হবে মানুষকে।

তিলাবুবুকে নিয়ে একদিন আড়িয়াল বিলে শাপলা কুড়োতে গেলাম। ছোট্ট একটা কোষানাও ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছিল, বুবুর হাসি ফুটন্ত শাপলার ধবধবে শাদা পাঁপড়ির সাথে মিশে অপূর্ব ধবল বর্ণ হয়ে যাচ্ছিল।
‘পানিতে নাববি না?’
‘না। অথৈ নদীতে আমার ভয় হয়।’
‘ছিঃ! বড্ড ভিতু রে তুই।’ বলেই সে নাও দুলিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিল। কৃষ্ণস্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কেটে বহুদূর চলে গেলো বুবু। একটা বালুহাঁস কিংবা রাজহাঁসের মতো বুবু ভেসে বেড়াতে লাগলো। আমি নাও বেয়ে তার পেছনে। কয়েকটা ডাহুক আর পানকৌড়ি পানিতে ভাসছিল। একটা দীর্ঘ ডুব দিয়ে অনেকদূর চলে গিয়ে ডাহুকের পা ছুঁতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ডাহুকেরা তার আগেই উড়াল দিয়ে বুবুকে পেছনে ফেলে চলে গেলো দূরের কোথাও। এরপর ডুব দিয়ে শাপলার গোড়া খুঁড়ে তুলে আনলো অনেকগুলো শালুক।

সেদিন বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যার আঁধারে হেঁটে হেঁটে তিলাবুবু চলে গেলে আমি বহুক্ষণ তার চলে যাওয়া পথের অন্ধকারে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষায় ছিলাম, হয়ত, হয়ত-বা তিলাবুবু দৌড়ে ছুটে এসে বলবে, ‘তুইও আয়। একা পথে আমি ভয় পাই।’

তিলাবুবু শেষবার চলে যাবার আগে নিয়ম করে কিছুদিন পর পর হঠাৎ সামনে দাঁড়াতো আর তার স্বভাবসুলভ হাসি ছড়িয়ে বলতো, ‘কেমন আছিস লক্ষ্মীমণি? আমাকে ভুলে যাস নি তো?’ আমি তিলাবুবুকে খুব ভালোবাসি তার সুমধুর, নির্মল হাসির জন্য। আমি তার হাসির ভেতরে ঢুকে যাই, আর উড়ে বেড়াই ভুবনছাওয়া অন্তরীক্ষে। তিলাবুবু শেষবার যখন চলে গেলো, সারাপথ জুড়ে বাতাস ঘূর্ণি খেয়ে আছড়ে পড়ছিল রোদের গায়ে। মোহনীয় কেশগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল পথের প্রতিটি বাঁকে। যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে মৃদু হেসেছিল বুবু। আমি দৌড়ে ছুটে গিয়েছিলাম হাসির গন্ধটাকে জড়িয়ে বুকে নিতে। আমার নিশ্বাস ভরে সেই গন্ধটা তোলপাড় করার পর আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘যাস নে বুবু, তোর বুকের ভেতরে আমাকে গলে যেতে দে, বুবু। তোর বুকের গহনে ঘুমিয়ে থেকে জীবনের শেষ শ্বাসটুকু নিতে চাই বুবু।’
বুবু আরেকবার পেছন ফিরে তাকালো না।

খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছে আমার তিলাবুবু। শেষবার চলে যাবার পর এমনকি স্বপ্নেও আর কোনোদিন আমাকে সে দেখা দেয় নি। বুবুর কথা মনে হলেই আমার চোখ ফেটে কান্না আসে। গোধূলির নিভৃত আলোয় আমার অশ্রুর ফোঁটারা করুণ পক্ষী হয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় মিশে যেতে থাকে।

১৭ মার্চ ২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:৪৮
১৫টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×