somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমর্ত্যের সুর

১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একদা এক গায়িকা ছিলেন। তিনি দেখতে সুন্দর ছিলেন না; অর্থাৎ, তার গায়ের রঙ ফরসা এবং চিত্তাকর্ষক ছিল না। কিন্তু তার গলায় ছিল অমর্ত্যের গান। সে-গানে সারা পৃথিবী দুলতো। ভোরের পাখিরা তার ঘরের বাগানে এসে ভিড় করতো, বাতাস থেমে যেত। নদীরা স্থির হয়ে থাকতো তার গান শোনার জন্য।

তার নামডাক চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে একদিন কিছু লোক এসে গায়িকাকে শহরে নিয়ে গেলেন। বিরাট হলঘরে মানুষ থইথই করছে। ঝলমলে আলোতে চোখ ঝলসে যায়। গায়িকাকে মঞ্চে উঠানো হলো। তিনি গান ধরলেন। কিন্তু মানুষের উল্লাস আর উচ্ছ্বাস ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকলো। মানুষের মন উতলা হলো না। আসর জমলো না।

শহুরে লোকগুলো তবু থামলেন না। আরেকদিন অনেক বড়ো এক খোলা ময়দানে তারা গানের আয়োজন করলেন। বহু ডাকসাঁইটে শিল্পীরা গান গাইলেন। গাইলেন না, বলা চলে তারা নাচলেন। শরীর দোলালেন। কোমর দোলালেন। গলা ফাটালেন। চিৎকার করলেন। লাফালাফি করলেন। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে দর্শকরা মুগ্ধ ও উন্মাতাল হলেন। আনন্দ উথলে উঠলো আকাশে বাতাসে। সবশেষে আমাদের গায়িকাকে মঞ্চে তোলা হলো। মেয়েটা খুব সাধাসিধে ছিলেন। তিনি জানতেন না কীভাবে শরীরের কসরৎ দেখিয়ে দর্শকহৃদয়ে দোলা দিতে হয়। তিনি শুধু জানতেন দু চোখ আধো-নিমীলিত করে নিগূঢ় কণ্ঠে সুর তুলতে। তিনি গান ধরলেন। স্থির দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে একমনে গান গাইতে থাকলেন। কিন্তু এবারও দর্শকরা সাড়া দিলেন না। তাদের মন ভরলো না মোটেও। কোনো উত্তেজনার ঢেউ নেই কোথাও। সবকিছু নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তারা একসময় জেগে উঠলেন এবং ‘হিন্দি চাই হিন্দি চাই’ বলে তুমুল শোরগোল করলেন।

আয়োজকরা বিমর্ষ হলেন। তারা খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করে বলেই ফেললেন, ‘আপনি দেখতে সত্যিই একটা ‘ক্ষ্যাত’। আপনি কি কিচ্ছু বোঝেন না?’ এটা গায়িকাকে খুব আহত করলো। তার রূপ নাই তিনি জানেন। তিনি চটপটে, সপ্রতিভ নন, তাও জানেন। তিনি আরো জানেন, তার মোহনীয় অঙ্গসৌষ্ঠব নেই, যা মানুষের নজর কাড়ে। কিন্তু তিনি জানেন তার একটা কণ্ঠ আছে, যা খুব মন্দ নয়; এ ব্যাপারে তিনি খুব আত্মবিশ্বাসী। তিনি নীরবে মাথা নীচু করে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন।

গায়িকা তার প্রিয় জন্মগ্রামে চলে এলেন। তিনি আর শহরের মঞ্চে যান না। কীজন্য তাকে আলোর শহরে নেয়া হয়েছিল, সে রহস্য তিনি জানেন না। তিনি করেন মাটির গান। তার মাটির শরীরের প্রতিটি পরতে মাটির সুর গেঁথে আছে। এ সুরে মাটির হৃদয় দোলে। এ সুরে মাটির মানুষ দোলে। যাদের জন্য তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন, তারা কেউ মাটির মানুষ ছিলেন কি?
জন্মভিটায় বসে নীরবে গায়িকা কাঁদেন। নিরবধি কাঁদেন। তার গলা খুব উচ্চমার্গীয় নয়, এ নিয়ে তাকে গালমন্দ করলে তার খুব কষ্ট হবার ছিল না। কিন্তু তিনি দেখতে একটা ‘ক্ষ্যাত’, তিনি চৌকষ বা সুদর্শনা নন- এটা তাকে খুব আহত করলো। পৃথিবীতে সুরের কি সত্যিই কোনো মূল্য নেই? শরীরের ঝকমকিই কি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু? তিনি নিজে কোনোদিন রূপের কাঙাল ছিলেন না, ছিলেন সুরের কাঙাল। তিনি চান সুর। তিনি চান গান। তার কাছে গানই হলো সব সুন্দরের আধার।

গায়িকা কাঁদেন। নীরবে গুমরে কাঁদেন। সৃষ্টিকর্তা তাকে রূপ দেন নি – সেজন্য কাঁদেন না, তিনি কাঁদেন মানুষ কেন বোঝে না এই রূপ তার নিজের ইচ্ছেতে হয় নি। নিজের ইচ্ছেমতো রূপ সৃষ্টি করা গেলে এই পৃথিবীতে রূপের জন্য কোনো হাহাকার হতো না, রূপের কোনো মূল্যও থাকতো না।
আরো তিনি কাঁদেন এজন্য যে, মানুষের কাছে সুরের কোনো কদর নেই, শরীরের সম্ভারই মানুষের মূল্যবান সম্পদ, যা তাকে সবার কাছে দামি ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
গায়িকা কাঁদেন; নিভৃতে তার হৃদয় পুড়ে যায়, কুরে কুরে ক্ষয় হয়।
কিন্তু আদতে তিনি কাঁদেন না। তার কণ্ঠে নিঃসৃত হয় করুণ সঘন সুর। সেই সুরে নদীর কান্না গর্জন করে ওঠে। পাখিরা কূজন ভুলে গিয়ে তার বাড়ির চারপাশে এসে গাছে গাছে ডালে ডালে ভিড় করে বসে। ফুলেরা সেই সুরে কান্নায় ভিজে যেতে থাকে। তারা তন্ময় হয়ে শোনে; গায়িকার অন্তরক্ষয়ী গানের মূর্ছনায় সারা পৃথিবী দুলতে থাকে। পৃথিবীটা যেন একটা স্বর্গোদ্যান। শুধু সুর আর সুর, যার গভীরে রূপের কোনো অস্তিত্ব নেই, নেই কোনো বাহ্যিক চাকচিক্য। সেখানে এই সুরটাই হলো সমগ্র সৌন্দর্যের মূল রহস্য।

অমর্ত্য থেকে মৃত্তিকার মর্ত্যে এ সুর ঝরে পড়ে, আর সুরপিয়াসী মানবহৃদয় এ সুরের সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়। সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম।

২ মার্চ ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১০:৫০
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×