আমাদের অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট ও পেশা বা কর্মক্ষেত্রের সাবজেক্টের মধ্যে কতখানি মিল আছে বলে মনে হয়? আপনি অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন ইংলিশ বা বাংলায়, এই সাবজেক্টের উপর আমাদের কী কী কর্মক্ষেত্র আছে? হ্যাঁ, শিক্ষকতা পেশাটাকে বাদ দিয়েই বলুন। তেমনি, যাদের সাবজেক্ট ছিল কেমিস্ট্রি বা বায়োলজি, তারা কি তাদের সাবজেক্ট অনুযায়ী পেশা নির্বাচন করতে পেরেছেন?
এরকম প্রায় সবগুলো সাবজেক্টের বেলায়ই এমন প্রশ্ন করা যায়, ব্যতিক্রম হিসাবে হয়ত ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়াররা থাকবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সাবজেক্ট অনুযায়ী যদি পেশা নির্বাচনের সুযোগ না থাকে, তাহলে ঐ সাবজেক্টে আমাদের ডিগ্রি অর্জন করা কতখানি প্রয়োজন?
এ প্রসঙ্গে কি এটা বলা যায় যে, কেবল সাবজেক্ট অনুযায়ীই পেশা হবে কেন? এক সাবজেক্টে ডিগ্রি নিয়ে অন্য সাবজেক্টের পেশাও নেয়া যেতে পারে, তাতে সাবজেক্ট কোনো অন্তরায় হবে না।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি একজন ডাক্তার। কবিতা লেখেন, ব্লগিং করেন। ডাক্তারি হলো আপনার পেশা। পেশা বাদ দিয়ে আপনার কি সাহিত্য রচনা, ব্লগিং করা উচিত? আপনি নিশ্চয়ই আপনার নিজ পেশায় মনোযোগী নন, কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন। ব্যাপারটা তাই নয় কি?
তেমনিভাবে আপনি হতে পারেন একজন ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পুলিশ, আর্মি বা অন্য কোনো সরকারি কর্মকর্তা, কিংবা কোনো সংবাদপত্রের এডিটর, সাব-এডিটর, রিপোর্টার; কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা, ইত্যাদি। নিজের কর্মস্থল ও পেশায় বর্তমান থেকেই (অর্থাৎ, অবসর গ্রহণ না করেই) আপনি বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ কার্যক্রম, যেমন, লেখালেখি, সঙ্গীতচর্চা, ব্লগিং, ভ্লগিং করছেন। এটা কি আপনাদের কাছে বৈধ মনে হয়?
যদি এটা বৈধ না মনে হয়, অর্থাৎ, পেশার সাথে এসব ক্রিয়েটিভ কাজ যদি আপনার কাছে অবৈধ মনে হয়, তাহলে বলুন বাংলাদেশে লেখালেখি বা ব্লগিং-কে পেশা হিসাবে নেয়ার কোনো উপায় আছে কিনা। বাংলাদেশে কোনো পেশাদার ব্লগার নেই, আমি নিজে একজন ব্লগার হওয়ায় তা জানি, কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে কতজন পেশাদার লেখক আছেন বলে মনে হয়? আনিসুল হক? তিনি প্রথম আলোতে চাকরি করেন, ওটা তার পেশা। লেখালেখি, নাটক, সিনেমা তার বাড়তি ক্রিয়েটিভ কাজ। হুমায়ূন আহমেদ শুরুতে টিচার ছিলেন। পরে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখাকেই পেশা হিসাবে নিয়ে নেন। হুমায়ুন আজাদ, শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার বাইরে তিনি লেখালেখিও করতেন, অর্থাৎ শিক্ষকতা ছিল তার পেশা, লেখালেখি ছিল বাড়তি ক্রিয়েটিভ কাজ। ইমদাদুল হক মিলন? তার সম্পর্কে আমার ধারণা খুব কম। তবে, বর্তমানে তিনি দৈনিক কালের কণ্ঠে সম্পাদক হিসাবে কর্মরত আছেন। অর্থাৎ, তার পেশা হলো সম্পাদনা, লেখালেখি হলো বাড়তি কাজ।
এই কথাগুলো বললাম এ কারণে, বাংলাদেশে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন লেখক ছাড়া সবাই কর্মজীবনে কোনো না কোনো পেশার সাথে যুক্ত আছেন। অর্থাৎ, দু-একজন ছাড়া আমাদের কোনো লেখকই লেখাকে পেশা হিসাবে নিতে পারেন নি; আবার প্রত্যেক লেখকই নিজ নিজ পেশার সমান্তরালে লেখালেখি বা অন্যান্য ক্রিয়েটিভ কাজ চালিয়ে গেছেন।
এবার আসি পরের প্রশ্নে। আপনার পেশা কোন বিষয়ে, আর আপনি লিখছেন কোন বিষয়ের উপর? হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন রসায়নের শিক্ষক, আর তিনি রসায়নের উপর কোনো বই লিখেছেন বলে আমার জানা নেই, বা শিক্ষকতার উপরও কোনো বই আছে বলে আমার জানা নেই। তিনি লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, গান, তৈরি করেছেন নাটক ও সিনেমা। হুমায়ুন আজাদ বাংলার অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলা ভাষার উপর প্রচুর গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন। কিন্তু অধ্যাপনার উপর তার কোনো লেখালেখি নেই। একই সাথে, পেশার বাইরে গিয়ে তিনি লিখেছেন গল্প, কবিতা, উপন্যাস।
এভাবে আমরা একেকজন কবি বা লেখককে ধরে ধরে বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে, নিজ পেশার সাথে সম্পৃক্ত বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেছেন এমন লেখকের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
আমি ১৯৯৫/৯৬ সালের দিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর ইংরেজিতে লেখা বই খুঁজছিলাম। অত্যন্ত হতাশ হয়ে দেখলাম, ইংরেজিতে লেখা কোনো বই নাই। খুঁজে খুঁজে যেসব বই পেলাম, সেগুলো ইন্ডিয়ান রাইটারের বই। পরবর্তীতে অবশ্য মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ Bangladesh At War নামে একটা বই লিখেছিলেন, ইংরেজিতে।
আমাদের পেশাজীবী ব্যক্তিগণ তাদের নিজ নিজ পেশার উপর খুব কমই লেখালেখি করেছেন বলে আমার ধারণা। তার কারণ কী?
আমাদের ব্লগের দিকে তাকাই?
জানা মতে আমাদের ব্লগে কয়েকজন শিক্ষক আছেন, আরো আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সম্ভবত বিজ্ঞানীও আছেন। সরকারি কর্মকর্তা আছেন। উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, ফ্রি-লান্সারও আছেন। অ্যাডভোকেট ও সাংবাদিক আছেন।
আমাদের ব্লগে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আছেন।
আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধা নই (আমি তখন ৫/৭ বছরের কিশোর), কিন্তু আমার চাচা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি ছোটো চোখে মুক্তিযুদ্ধের বিস্ময়কর কিছু স্মৃতি ধারণ করে আছি, আকৈশোর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বড়ো হয়েছি, এখনো ছুটছি। এ ব্লগে মুক্তিযুদ্ধ্বের উপর আমার স্বল্প কয়েকটা কবিতা, পোস্ট আছে। (আমার প্রথম উপন্যাস 'স্খলন'-এ আমার দেখা মুক্তিযুদ্ধের কিছু বর্ণনা আছে।) এই 'স্বল্প' কয়েকটা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পোস্টও বর্তমানে সক্রিয় যে-কোনো মুক্তিযোদ্ধা ব্লগারের চাইতে বেশি। আমার প্রশ্ন : আমাদের শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা ব্লগারগণ মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখালেখি না করে অন্য বিষয়ের উপর লিখছেন কেন?
আমাদের ব্লগে যে ক'জন শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী আছেন, তারা তাদের নিজ নিজ পেশার উপর না লিখে অন্য বিষয়ে লেখালেখি করছেন কেন? যিনি প্রবাসে আছেন, তার কর্মক্ষেত্র নিয়ে সবিস্তারে, ধারাবাহিকভাবে লিখছেন না কেন? যার অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট ধর্ম বা তুলনামূলক ধর্ম ছিল না, তিনি কেন ধর্ম নিয়ে লিখছেন? যার সাবজেক্ট ইতিহাস ছিল না, তিনি কেন ইতিহাস নিয়ে লিখছেন? তবে, একটু প্রশংসা করতেই হয়, অ্যাডভোকেট তরিকউল্লাহ ও গোফরান ভাই ব্যতিক্রম, যারা ক্রমাগত তাদের নিজ পেশার উপরই লেখালেখি করে যাচ্ছেন, পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও অবশ্য লিখছেন। আরো দু-একজন ব্লগার নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রকে উপজীব্য করে লিখছেন, কিন্তু তা সংখ্যায় স্বল্প, তাদের বেশির ভাগ পোস্ট অন্যান্য বিষয়ে।
আমরা অবশ্যই আশা করতে পারি যে, আমাদের ইঞ্জিনিয়ার ব্লগারগণ তাদের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কলাকৌশল নিয়ে লিখবেন, ডাক্তারগণ লিখবেন তাদের ডাক্তারি পেশা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, ইত্যাদি নিয়ে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ব্লগারগণ মুক্তিযুদ্ধের উপর পোস্ট লিখতে থাকবেন। শিক্ষকগণ লিখবেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। প্রবাসী ব্লগারগণ লিখবেন প্রবাস-জীবন নিয়ে। ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি।
আসলে, আমাদের দেশে অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট অনুযায়ী পেশা নির্বাচন প্রায়ই সম্ভব হয় না। এজন্য দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সেই সাথে দায়ী কর্ম-কাঠামো, যার সাথে শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সামঞ্জস্য দরকার।
একই সাথে, পেশা বা অ্যাকাডেমিক সাবজেক্ট অনুযায়ী আপনার লেখালেখির সাবজেক্ট মেলানোও দুষ্কর। লেখালেখি হলো একটা সৃজনশীল কাজ, যা আপনার মন থেকে উদ্গত হয়। আপনার মন যা চাইবে, আপনি তাই লিখবেন। আপনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বলে আপনাকে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিঙের উপরই লিখতে হবে, এ ব্যাপারটাও এমন না। আপনার মনই বলে দেবে আপনি কোন বিষয়ে লিখতে যাচ্ছেন। এজন্য দেখা যায়, পেশাজীবনে আপনি একজন কম্পিউটার ইন্সট্রাক্টর, কিন্তু লেখালেখি করছেন ধর্মের উপর, গল্প লিখছেন, কবিতা লিখছেন। এতে আমি কোনো অন্যায় দেখি না, অন্যায় হলো ওটা - আপনি যদি আপনার কর্মস্থলে ফাঁকি দেন, এবং দুর্নীতি করেন।
০৬ এপ্রিল ২০২৪
ফুটনোট :
গবেষণাবিহীন, সাদামাটা পোস্ট
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:২৮