......................
আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ, ৩ তারিখের আগেই জাতীয় কমিটির হরতালকে তারা নৈতিক সফলতা দিল। জাতীয় স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে লুটেরাদের নৈতিক হারটা হরতালের আগেই ঘটে গেল। প্রথমত, কনকো-ফিলিপিসের সঙ্গে চুক্তিটা হরতালের আগে প্রকাশিত না হওয়ায় হরতালের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠিত হলো, দ্বিতীয়ত ‘দেশপ্রেমের’ দেমাগ প্রদর্শন শেখ হাসিনাকে আরো জনবিচ্ছিন্ন করলো, তিনি তাঁর অহংকারি পা মাটিতে ফেলতে ব্যর্থ হলেন। তৃতীয়ত, বন ও পাউরুটি মন্ত্রী (নামকরণের কপিরাইট রাজীব নন্দী) টোকাইদের জাতীয় স্বার্থরক্ষক ঘোষণা করায় অজস্র ছাত্র-তরুণদের সামনে টোকাই হওয়া একটা দেশপ্রেমিক দায়িত্ব হিসেবে হাজির হলো; ফলত টোকাই সমাজ সংখ্যায় আরো বাড়লো, স্বভাবে হয়ে উঠলো আরো দুর্দান্ত।
মুখে চুনকালি লাগায় এখন সরকার মান বাঁচাতে মাঠে নামালো চরমোনাইয়ের দলবলকে। কীসব হাবিজাবি কারণে তারা ১০ তারিখে হরতাল ডেকেছিল। কোথাও কলকাঠি নড়লো আর সেই অহেতুক হরতাল এসে পড়লো জাতীয় কমিটির আগামী কালের (৩ জুলাই) হরতালের ওপর। সরকার কেবল ডাণ্ডায় ভরসা পাচ্ছে না, নার্ভাস হৃদয়ে তাই ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু কোনো যন্ত্রেই লাভ হওয়ার নয়। এখন টোকাইদের ডাণ্ডার বাড়ি মারলেও বিপদ, না ঠেকালেও বিপদ। এই অবস্থায় ইসলামওয়ারাই তাদের বিপদতারিনী বন্ধু। ৩ জুলাই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে জাতীয় কমিটির সঙ্গে। উদ্দেশ্য, একদিকে হরতালের বৈধতা ও সফলতাকে ছিনতাই করা, অন্যদিকে প্রগতিশীল দেশপ্রেমিকদের সঙ্গে ইসলামপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের একাকার করায় ভাড়া খাটা। কৌশলটি নতুন নয়। তিনটা উদাহরণ মনে আসছে:
১. নারী উন্নয়ন নীতির ভাওতা প্রত্যাখ্যান করার আন্দোলন ঘুরিয়ে দিতেও এদের নামানো হয়েছিল। বাঘ ছেড়ে ফেউ খেদানোর উস্কানি দেওয়ার এই খেল জরুরি অবস্থার সময়ও আমরা দেখেছি। অনেকের মনে একটা সমীকরণ কাজ করে: মোল্লারা যা কিছুর বিরোধী আমরা তার সমর্থক। নারী সংগঠনসহ ‘প্রগতিশীল বলে পরিচিতি’ অনেকে এই ভাওতাবাজির চক্করে নারী নীতির প্রতারণা খুলে দেখানোর সুযোগই পেল না। সরকারের বিরোধিতাটা সেমিনারে সেরে মাঠের আন্দোলন চললো আমিনী গংদের বিরুদ্ধে। এতে আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল ভাবমূর্তি রক্ষা পেল, নারীরা পেল না কিছুই।
২.জরুরি অবস্থার সময়ও নারী নীতি ঘোষণার পরে বিমানবন্দরের সামনে বাউল ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে একইভাবে পোষা হুজুরদের মাঠে নামানো হয়। হুজুরদের জুজু দেখিয়ে সেই নীতি স্থগিত করায় তখন ফখরু সরকারের আর অসুবিধা হয় না। খেলার নিয়মটা হলো, জুজুর ভয় দেখিয়ে প্রতিপদের তটস্থ করে তাদের ক্ষোভকে অন্যদিকে চালনা করা। নন ইস্যুকে ইস্যু করে আসল ইস্যুকে নজরের বাইরে রাখা।
৩. ২০০৬ সালের বিএনপি আমলে আগষ্টের শেষে ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জি বিরোধী সমাবেশে গুলি করে তিন কিশোর হত্যার প্রতিবাদে জাতীয় কমিটি ঢাকায় হরতাল ডেকেছিল। আওয়ামী লীগ হঠাৎ সেই হরতাল সমর্থন করে বসে। উদ্দেশ্য হরতালের জনসমর্থন ছিনতাই করা। মিডিয়াও একে আওয়ামী-বিএনপি বিরোধের ছকে ফেলে প্রচার দেয়। তাতে জাতীয় কমিটির ইমেজের ধার কিছুটা কমে এবং আওয়ামী লীগের কুম্ভীরাশ্রু মহিমা পায়।
৩ তারিখের টোকাই-বিপ্লবীরা তাই সাবধান। সামনে পুলিশের ডাণ্ডা, পেছনে মোল্লাতন্ত্রের ফেউ। পুলিশ আপনাদের থামাবে আর মোল্লারা আপনার ইমান ও নিশানকে কালিমালিপ্ত করবে। এমনকি শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতায় সেরা বিএনপির সমর্থনও পেয়ে যেতে পারেন_ ২০০৬ এ যেমনটা করেছিল আওয়ামী লীগ। এই চতুর সরকারি চাল কেবল কথা বা বিশ্লেষণ দিয়ে ঠেকানো যাবে না। আবার ‘কিছু করার নাই’ বলে উপেক্ষা করাও উচিত হবে না। অপঘটনাকে পাল্টা ঘটনা দিয়েই ঠেকাতে হবে। নিজেদের কর্মসূচিকে নিজেদের শর্তেই পরিচিত করতে হবে। সুতরাং সমস্যা হলো: সরকার চেয়েছে বাম আর মোল্লাদের একাকার করে উন্নয়নের সমস্যা হিসেবে দেখাতে। মোকাবিলায় এমন ঘটনা ঘটাতে হবে যাতে সরকারি চাল বুমেরাং হয়ে যায়। অর্থাত স্পষ্ট হয় যে, জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রশ্নে জাতীয় কমিটির বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের হরতাল আসলে সরকারেরই চাল। তারা এখানে সরকারেরই পঞ্চমবাহিনী। এটা বোঝানো সম্ভব একইসঙ্গে পুলিশ-মাস্তান আর মোল্লাদের বিরোধিতা করার মধ্যে দিয়ে। জাতীয় কমিটির কর্মীরা যেখানে মাঠে থাকবে, সেখানে কোনোভাবেই ইসলামী শাসনতন্ত্রওয়ালাদের নামতে না দেওয়া, দরকার মতো ধাওয়া করতে হবে। প্রয়োজনে কেবল পুলিশের মার খাওয়া নয় মোল্লাদের মারও খেতে হবে। এই দৃশ্য মিডিয়ায় এলে মানুষ সহজেই বুঝে ফেলবে, সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের বাস্তবায়ক আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে মোল্লাতন্ত্রও জুড়ি বেঁধেছে। সরকারি কূটচাল ঠেকাতে টোকাইদের চাল দিতে হবে সোজাসুজি- রুখে দাঁড়িয়ে। যে গিট্টু খোলা যায় না, সেই গিট্টু কেটে ফেলাই নিয়ম।
হরতালে টোকাইবিধি
জাতীয় সম্পদের ওপর বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদীদের দখল কায়েম নিছক অর্থনৈতিক লুণ্ঠন না; এটা জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্বাধিকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আগ্রাসন। তাই এর বিরুদ্ধে আন্দোলনটাও সিভিকো-মিলিটারি-কর্পোরেটতন্ত্রের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের কায়দায় হওয়া উচিত হবে না। সংবিধান দিয়ে জুতা মোছা হবে না টুপি বানানো হবে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা সেটা নয়। প্রধান সমস্যা হলো প্রকৃতি-জীবন-সম্পদ ও স্বাধীনতার ওপর সর্বগ্রাসী দখলের বাস্তবতা। যাঁরা এর বিরুদ্ধে, তিনি দলের হোন বা না হোন, বাম হোন বা না হোন, তাঁদের দায়িত্ব আগামী কালের হরতালে সর্বশক্তি দিয়ে নামতে হবে। কোনো জ্বালাও পোড়াও নয়, নিজের শরীরে রাষ্ট্রের হিংসা ধারণ করে প্রতিবাদ করুন। যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই আপনার প্রতিবাদকে দৃশ্যমান করুন> প্রতিবাদী টিশার্ট বা ফেস্টুন বা পোস্টার গায়ে নিয়ে ঘুরুন> কয়েকজন এক হয়ে রাস্তার পাশে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে যান> কিংবা গিটার হাতে শুরু করে দিন গান। হাতে জাতীয় কমিটির প্রচারপত্র রাখুন, যাকে পান তাকেই দিন>আড্ডা-আলোচনা-স্ট্যাটাস সবখানে এই প্রসংগ তুলুন। ফেসবুকের প্রোফাইল পিকে রাখুন জাতীয় কমিটির পোস্টার বা অন্য কোনো প্রাসংগিক ছবি। মোবাইলটাকে গণপ্রচারণার হাতিয়ার বানিয়ে তুলুন> মেসেজ, ছবি, ভিডিও আপলোড করতে থাকুন, ছড়াতে থাকুন। যা বিশ্বাস করেন, যে প্রতিবাদ মনে পুষে রাখেন, যে যুক্তি সঠিক মনে হয়, আগামী কাল তা প্রতিষ্ঠায় অন্তত এক পা আগান। নিজেকে বিশ্বাস করলে মানুষের কাছে যান, সহযোদ্ধাদের খুঁজে নিন। মনে রাখবেন, আন্দোলন শেয়ারের ব্যবসা নয়, এতে ক্ষতি হবে, ঝুঁকি আসবে কিন্তু আখেরে সর্বনাশ ঠেকানো সম্ভব হবে। হতেই হবে।
*ফটো কৃতজ্ঞতা নৃপ অনুপ
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৩৫