somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইলিশের সুখবর টেকসই করতে হলে

২৫ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত বছর থেকে দেশে ও উজানে বেশ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উজান থেকে প্রচুর পানি নামার ফলে ইলিশ সমুদ্র থেকে ওপরের দিকে উঠে আসে। একদিকে অনুকূল পরিবেশ, অন্যদিকে মৎস্য বিভাগের কড়া নজরদারি; ফলাফল ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। গত অর্থবছরে ইলিশের মোট উৎপাদন ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন। আশা করা হচ্ছে, চলতি অর্থবছরে সাড়ে পাঁচ লাখ টনের কিছু বেশি ইলিশ উৎপাদিত হবে।
ইলিশের অর্থনীতি
ইলিশ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৭১ কিলোমিটার বেগে সাঁতার কাটতে পারে এবং ডিম পাড়ার জন্য ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার সাঁতার কাটতেও রাজি। এই দীর্ঘ সাঁতারের মাধ্যমে মা ইলিশ দেশের অর্থনীতি, পুষ্টি বৃদ্ধি ও রসনাবিলাস—সবকিছুকেই বেগবান করে তুলেছে। বাংলাদেশের মৎস্য খাতে একক প্রজাতি হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ ইলিশ। এই সম্পদ নবায়নযোগ্য এবং দেশজ মাছ উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ। জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। শুধু উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ইলিশ আহরণ, স্থানীয় বাজারজাতকরণ ও পরিবহনের কাজে সরাসরি নিয়োজিত।

প্রজনন মৌসুম নির্ধারণে সমস্যা
ইলিশের এই সুদিনের কারণ প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেক মা ইলিশের ডিম পাড়ার আগ পর্যন্ত বেঁচে যাওয়া। কিন্তু প্রজনন মৌসুমের মেয়াদ কত দিন, তা ঠিক করায় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। ফলে আশানুরূপ সুফল পাচ্ছি না।

ইলিশ শুধু পূর্ণিমাতেই প্রজনন করবে, এমন চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে আগে ১০-১১ দিন ইলিশ ধরা নিষেধ ছিল। ২০১৫ সালের পরে এ মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়। হিসাবটা এ রকম: আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে তিন দিন, পূর্ণিমার দিন এবং পূর্ণিমার পরে ১১ দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকত। দু-তিন বছর ধরে ইলিশ সংরক্ষণ সময়সীমা ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার আগের চার দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরের ১৭ দিনসহ মোট ২২ দিন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সুফল মিলেছে বেশ।

গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশ মাছের প্রজনন ঋতু নির্ধারণের প্রচলিত পদ্ধতি ভুল। ২০১০-২০১৫ সালে প্রজনন ঋতু নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছের জিএসআই (Gonado Somatic Index) পরিমাপ পদ্ধতির গবেষণার ভিত্তিতে এই স্থগিতাদেশ প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্পকালীন এবং অটেকসইও। জিএসআই হলো মাছের ডিমের ওজন ও দেহের ওজনের অনুপাতের শতকরা হার। গবেষণা বলছে, নিষেধাজ্ঞার ঠিক পরেও অন্তত তিন সপ্তাহ বাজারের প্রায় শতভাগ ইলিশে ডিম থাকে—এরও আগে পরে মিলিয়ে প্রায় দেড় মাস বাজারের ৭০ ভাগ ইলিশের পেটেই ডিম থাকে।

মৎস্য গবেষক বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহের অধ্যাপক হারুনুর রশীদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে ইলিশ সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত প্রজনন করে। সেপ্টেম্বরের শেষ ভাগে জিএসআই ১০-১১ থেকে বাড়তে বাড়তে অক্টোবরের মাঝামাঝি কিংবা শেষের দিকে এসে সর্বোচ্চ ১৫-১৭ পর্যন্ত পৌঁছায় এবং নভেম্বরে এসে তা হঠাৎ করে কমে যায়। ১৫-১৭ জিএসআই ইলিশের ভরা প্রজনন মৌসুম নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৃষ্টির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করেও ইলিশের প্রজননক্ষণ কিছু পরিবর্তিত হতে পারে। সুতরাং বর্তমানের আধা বিজ্ঞান ও আধা ধারণার ভিত্তিতে নির্ধারিত মা ইলিশ ধরা বন্ধের সময়কাল নির্ণয়কে পুরোপুরি নিবিড় গবেষণাভিত্তিক করে ফেলা দরকার। এতে টেকসই ফল আসবে।

ইলিশ রক্ষার টেকসই দিক
ক. (স্ত্রী মাছের জিএসআই Gonado Somatic Index পরিমাপ পদ্ধতি) দেশীয় গবেষণায় উঠে আসা উপাত্তের ভিত্তিতে ২২ দিনের পরিবর্তে অন্তত ৪০ থেকে ৪৫ দিনের স্থায়ী ইলিশ নিধন নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা।

খ. জলবায়ু, নদীর স্রোত, পানিদূষণ ও পানির তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইলিশের প্রজনন মৌসুম ভিন্ন হতে পারে—তার জন্য নিরন্তর গবেষণার ব্যবস্থা থাকা চাই। পূর্বনির্ধারিত মেয়াদের বাইরে এসে গবেষণানির্ভর নিষেধাজ্ঞা-সময় নির্ধারণ করা জরুরি।

গ. দীর্ঘ সময়ের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়ে নিবন্ধিত জেলেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং এই সময়ে ইলিশ অঞ্চল বাদে অন্যত্র অন্য সামুদ্রিক মাছ ধরার প্রণোদনা দেওয়া যায়। সস্তায় মাছ ও পরিবেশবান্ধব জাল ও সমুদ্রে মাছ ধরার উপযোগী ইঞ্জিনচালিত ভাড়া ও তা ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। অবৈধ জাল ধরার অভিযানে হাজার কোটি টাকা খরচ না করে এই অর্থ জেলেদের প্রণোদনা এবং টেকসই গবেষণায় লাগানো যায়। নিষেধাজ্ঞার সময় ৩৭ শতাংশ জেলে দাদন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে সমীক্ষায় উঠে এসেছে। যেসব জেলে ইলিশ ধরেন তাঁদের ৭০ শতাংশের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে। ফলে জেলেদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। যেহেতু কর্মক্ষমকে অলস ভাতা দেওয়া অটেকসই, তাই এই ভাতা সামাজিক শিক্ষার বিনিময়ে দিলে ভালো হয়। দুর্নীতি কমাতে সামুদ্রিক ট্রলার ও নদীর জেলেদের মোবাইল সিম জেলে হিসেবে নিবন্ধিত থাকবে, সামাজিক শিক্ষায় উপস্থিতি সাপেক্ষে তাঁদের মোবাইল স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই ভাতা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়। যেহেতু মধ্যস্বত্বভোগীদের অন্য মাছের কিংবা বিকল্প ব্যবসা থাকে, তাই সরাসরি জেলে নয়, এমন কাউকে আর্থিক ভাতা দেওয়ায় দায় রাষ্ট্রের জন্য সীমিত বলেই মনে করি।

ঘ. অবৈধ জাল (কারেন্ট ও বেহুন্দি) নদীতে বা তৃণমূলে গিয়ে বাজেয়াপ্ত না করে আমদানি এবং উৎপাদিত উৎসে এর বাজারজাত প্রতিরোধ করুন। দুর্নীতি করে জাল আমদানি করে এনে আবারও দুর্নীতিনির্ভর খরুচে প্রকল্প তৈরি করে তৃণমূলে এসে তা ধ্বংস করার পুরো প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতিবান্ধব। এটা ব্যক্তি মৎস্যজীবীদের আর্থিকভাবে সর্বস্বান্ত করার মহড়া। লোভীরা ঠিকই ঘুষ আদান-প্রদানে উতরে যাবে কিন্তু সৎ ও গরিব প্রান্তিক মৎস্যজীবী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ইলিশ রক্ষার ৯০০ কোটি টাকার সিংহভাগই লোপাট হবে। এভাবে ৯০০ কোটির বদলে ৯০০০ কোটি দিলেও ইলিশ ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই হবে না।


ঙ. সমাজে প্রাণ ও পরিবেশঘাতী খাদ্যাভ্যাস চালু রেখে মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে টেকসই করা অসম্ভব।

ডিম ওয়ালা মাছ নিধন, ডিম ওয়ালা মাছ বিক্রয়, মাছের প্রকারভেদে নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট মাছ বিক্রয় এবং মাছের ডিম খাওয়াকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইনত দণ্ডনীয় করুন। প্রাণ ও প্রকৃতি রক্ষায় শিক্ষা ব্যবস্থায় এই সব দিকের প্রতি গুরুত্ব দিন, সম্পদ ব্যবস্থাপনার বোধ ও সচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য একটি মা ইলিশে ১০-১৫ লক্ষ ডিম ধারণ করে যা আমাদের হীন আহার বিলাসের বলি হয়। সমাজে হীন প্রাণ ও পরিবেশ ঘাতী খাদ্যাভ্যাস চালু রেখে মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনা টেকসই করা অসম্ভব।



২৫ জুলাই ২০১৮, দৈনিক প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।
ইলিশের সুখবর টেকসই করতে হলে
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৪
৫টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×