জটলা পাকা মানুষগুলির মধ্যমনি চুলে জটপাকা ঐ তেজস্বী বৃদ্ধটার জন্য পিশাচের মত রক্ত-ক্ষুধা ছাড়া আপাতত মস্তিস্ক আর কিছুই বিবেচনা করতে পারছেনা । খুনটা হবেই; মানে করতে হবেই ! বিকল্প নেই, হবেও না আর । যে অপরাধ তাতে মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য এবং তা পুরোপুরি ন্যায্য । কী হবে এই খুনটা হলে ? পাল্টা মৃতুদণ্ড ! হাসি পায় এই নিস্তব্ধ রাতে । সে হাসির প্রতিধ্বনি কেমন ভুতুরে হয়ে উড়িয়ে দেয় নিশাচর কিছু বাঁদরকে ! পাল্টা মৃতুদণ্ড তো তার অনেক আগেই হয়ে গেছে । এখন সেই আমি জীবন্মৃত ! শুধু মাত্র ঐ গণকটার জন্যেই । যার গোঁফের কারণে ঠোট দুটোই ঠিকমত দেখা যায়না সে আবার অন্যের ভবিষ্যত কীভাবে দেখে এটাও একটা রহস্য । ওর বোঝা উচিত ছিল এই হাতটা দেখে তার বিদ্যের বাহাদুরি দেখানো খানিক সময়ের জন্য চেপে যাওয়াই ভাল হবে-অন্তত একটা অপমৃত্যুর হাত থেকে বাচতে । বাড়িতে কে কে থাকতে পারে ওর ? তাদের অসহায়ত্ব কি খুব চরম ? বুড়োর নিজেরই এটা মাথায় রাখা উচিত ছিল যে তার অবর্তমানে এরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে । অন্তত আমার হাত দেখার পরে ভবিষ্যদ্বাণী করার আগ মুহুর্তে বিশেষভাবে আরেকবার ভাবাই ছিল বুদ্ধিমানের কাজ । ওর পরিবার নিয়ে চিন্তা করে লাভটা কী-পৃথিবী কারো জন্যেই তো কখনোই থেমে থাকেনি আর থাকবেও না । গতি একটা হবে ।
যখন মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলাম, তখনই তো একবার সেই তো বলেছিল – বালক, তুমি স্ট্যান্ড তো করবেই ! আমার মেধা-তরবারির ঝলকানি মনে হয় একটা খোপ থেকে বেরিয়ে এসে এমনভাবে তাকে শাসিয়ে দিয়েছিল যে, সে নিমিষেই বুঝে গিয়েছিল । সেই কল্পিত তরবারিটাই আজ তার মৃত্য পরোয়ানা জারি করা দেবদূত ! আমি স্ট্যান্ড করলামই বটে ! প্রায়ই তার জটপাকা চুলগুলো ভেসে আসতো মনের চিত্রাকাশে । যে এতকিছুর খবর বলে দিতে পারে সে তার ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেনা কেন । অন্তত চুলের জটতো ছাড়াতে তো পারবে ! নাকি করেনা ইচ্ছা করেই । সেই ইচ্ছাটা জন্মেই বা কোথা থেকে ? নিজেকে সুন্দর দেখতে কে না চায় ? আর স্বেচ্ছায় অবয়বে কালিমা লেপন ! অবাককরা কাণ্ড ! ছেড়া কাপড়, তালি দেয়া ঝুলি, জটাচুল, অনবরত উদোম রাখা বিশ্রী রকমের নোংরা পা, দিনের পর দিনের গোসল না করা আরো ..... ওয়াক থু ! না, খুনটা করলেই কেবল এর একটা বিহিত হবে ।
প্রায় বছর তিনেক পরে আবারও দেখা ! হাত দেখালাম । ও বলেছিল, আমি নাকি সীমা ছাড়িয়ে যাব অবাধ্যতায় ; বাবা আর মাকে অসম্মান আর অপমান করার ক্ষেত্রে ! সবগুলো লোম একসাথে খাঁড়া হয়ে গেল, চোখদুটো বেশ বড় বড় হয়ে গেল ! কপালের চামড়া কুঁচকেও গেল আমার ! বলে কী ! অসম্ভব ! মিথ্যা এ সবকিছু । প্রতিদিন বাহির থেকে এসে ধুলি-মাখা ঠোটে যে মাকে চুম্বন করে আদরের পরশ পাই, তার সাথে গলা উঁচিয়ে কখনো আমিই নাকি ........ ! ধুত্তুরি, ভুয়া গনক ! তাহলে স্ট্যান্ড করার ব্যাপারটা ? আরে ওটা আন্দাজে ঢিল মারছে ! মনকে প্রবোধ দিই ! কিন্তু অবচেতন মন যেন দিনের পর দিন ঐ শয়তান গণকটার কথায় সায় দিতে লাগলো । ও কি আসলে গণক নাকি ....... শয়তান ! আরও ভাবলাম, রাতে রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে, শশ্মানে অমাবস্যায় একা একা বসে । কেন জানি আমার কাছে ধরা দিল – সে আসলে মানুষ নয় , কোনভাবেই নয় । এবং সে আমাকেও রুপান্তরিত করছে একটা আস্ত শয়তানেরই সাগরেদে । কারণে অকারণে মা’র সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করলাম ! তার চাইতে তীক্ষ্ণ তীরের মত বাণ । পক্ষাগাত-গ্রস্ত মা বিছানায় থাকল প্রায় বারটা বছর । অভাবের তাড়নায় নিজে খেয়েও মার কোন খোঁজ নেইনি । আইসক্রিমের ফ্যাক্টরির আয়ে এক হালি সন্তান আর সংসার কলকাতায় কী যে বীভৎস জীবন ! মা’র পেটের চামড়া পিঠের সাথে লেগেই গিয়েছিল শেষ দিকে । প্রথম দিকে একটু একটু খোঁজ নিতাম কিন্তু দেখতাম মনটা তখনও আবেগহীন । মায়ের সাথে কথা বলার সময় দীর্ঘ হলেই আবারো তা মাকে আঘাত করত পাহাড় থেকে বেয়ে আসার মত পাথরের মত ! মাকে ছেড়ে আসলেই ঐ বুড়োটার ভবিষ্যদ্বাণী মনে পরে ! নাকি অবচেতন মন বা বৃদ্ধ তা মায়ের সাথে সাক্ষাতের সময়, কথাবার্তার সময় ঐ ভবিষ্যদ্বাণীটা আমায় দিয়ে প্রতিফলিত করে । শেষে মা যখন ইহলৌকিক জীবন আর ছেলের কুৎসিত আচরণ উভয় থেকে বিদায় নিল তখনই সিদ্ধান্তে আসলাম – জ্যোতিষীর মৃত্যুদণ্ড পাওয়াই উচিত ! ঘন জঙ্গলের যে কুটিরে ওর বসবাস ছিল সাধনার জন্য, ওটাতে যেদিন গেলাম খুন করার জন্য সেদিনও অমাবস্যা ! ভয় ডর নেই যেমন তেমন নিজেই তো অমাবস্যা আমিও তখন ! আমাকে দেখে বুড়ো বলল, তুমিই আমার স্থলাভিষিক্ত !
- মানে ?
- আমিও আমার মাকে এমন করে পৃথিবী থেকে নরপশুর আচরণ করেই বিদায় দিয়েছি !
- আমাকে দিয়ে কেন তা করালে ?
- শয়তানী খায়েশ আমার ! ইচ্ছে পূরণ !
- মরতে যাচ্ছ , জানো ?
- হুম, এভাবে মেরেওছি এক শয়তানকে !
একবার এক খুনি গাড়িতে পাশে বসে গল্প করছিল । চাকুটা গলার নিচ দিয়ে বাম পাশে একটু চাপ দিয়ে চালালেই মৃত্যু নিশ্চিত ! আমিও চালালাম !
পরের দিন মায়ের কবরের পাশে দাড়ালাম । কাঁদলাম , বৃষ্টি নামলো অঝোরে ! মায়ের হাতের শেষ চিঠিতে লেখা পেলাম, “ বাবা, তোর সুস্থতা কামনা করছি, নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে হলেও ! তুই সুস্থ হবিই ! আমার দোয়া ও আশীর্বাদ থাকলো ।” আমি কি তাহলে অসুস্থ ছিলাম ? কতদিন ?
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:১৪