পৃথিবীটাই নিজের মত
=======================
ফেরদৌস
======
‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’ দেখার পরে জীবন সম্পর্কে আরেকবার ভাবিয়ে তুলেছিল আমায় সেই পর্তুগিজ ভাষার(সম্ভবত) মুভিটি! ছবিটি দেখার পরে আমার কেন জানি শুধু এটাই মনে হয়েছিল, পৃথিবীতে আমার মন খারাপ করার অধিকার আছে কিন্তু কাঁদার কোন অধিকার নেই। সত্যি কথা বলতে কাঁদার জন্যে আমরা কেউই পৃথিবীতে আসিনি। হয়তো জন্মের পরপরেই না কাঁদলে আমরা যেমন সেই জন্ম নেওয়া শিশুটাকে সুস্থ বা স্বাভাবিক মনে করিনা, আবার অতি আপনের মৃত্যুর পরে না কাঁদলেও সেটাও অস্বাভাবিক মনে করি। শুরু এবং শেষ দুটোই যদি কান্না দিয়েই হয় তাহলে মাঝাখানে কাঁদলেই বা সমস্যা কোথায়? সমস্যা নেই আবার সমস্যা আছে! যার যার কাছে তার তার মত। আমি একবার একটা স্ট্যাটাসে বলেছিলাম’ ‘পৃথিবীটা যার যার কাছে তার তার মত’। আপনি বা আমি, কিংবা আমরা সকলেই একটা পাগল দেখে কত অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, আর আফসোস করি, “ আহা! বেচারা!” কিন্তু সেই পাগলই হয়তো আমাদেরকেও দেখে ভাবে, “ হায় আল্লাহ, দুনিয়ার এত পাগল লোক কবে যে সুস্থ হবে!” এখন প্রশ্ন হতে পারে কার দাবীটা সঠিক? খুব অতল গভীরে গিয়ে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ভাবলে আপনি কোন কারণে পাগলের দাবীর কাছেও হেরে যেতে পারেন। কোন এক বিশেষ কারণে আমরাই সত্যিকারের ‘পাগল মানবজাতি’। আপনি যত উচুতেই আর যত এসি রুমেই থাকেন না কেন ঠিকমত না মুছে ফেললে, বা দীর্ঘদিন তাতে ঝাড়ু বা কাপড় না পড়লে ধূলোর আস্তরণ পড়বেই। প্রত্যেকদিন সকাল বিকাল যে ঘরের চারপাশটা খুব যত্ন নিয়ে অন্তত দুবার পরিস্কার করা হয় তা চকচক করবেই, মনোরম লাগবেই!
আমাদের মনটাও তাই, ধূলোর আস্তরণ পড়লে তা মলিন হবে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে, সেই সুন্দর পরিচ্ছন্ন পৃথিবীটা নোংরা হয়ে যাবে, ছোট হয়ে আসবে। আর মনের নিয়মিত যত্ন নিলে তা সকল সময়েই বেশ পরিপাটি, নির্মল আর সুখী হয়ে থাকবে। মনের ধূলা-বালি বলতে সেইছোট ছোট দুঃখ-ব্যথাকেই বোঝায়! মনটা এক অর্থে মাটির ব্যাংক, যা যা যে পরিমাণে জমাবেন, তাই তাই সে পরিমাণেই জমবে। আপনি সুখময় স্মৃতি জমালে দিন শেষে একটা সুখি মানুষ পাবেন আর দুঃখ জমালে দিন শেষে একটা দুখী মানুষ পাবেন। দুঃখ আপনাকে কাঁদাবে, আর আপনি কাঁদবেন, একা একা কাঁদবেন, শব্দ করে কিংবা নিঃশব্দে, প্রকাশ্যে বা মুখে হাসি রেখেও অভিনয়ের মাধ্যমে, বাথরুমের শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে, নির্জন নদীর পারে একটা অদ্ভুত মায়াবী রাতে, বা দিনের মধ্যাহ্নেও একটা দরজা জানালা-বন্ধ বদ্ধ অন্ধকারপুরীতে।
খুব অদ্ভুতভাবেই পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই নিজেকে বিরহী ভাবতে, দুখী ভাবতে, এবং মারাত্মকভাবে একা ভাবতে পছন্দ করে! হয়তো এটাই সাইকোলজিক্যাল ট্রেন্ড!এটার মাধ্যমে সে নিজেকে একটা গল্পের অসহায় কিন্তু প্রধান চরিত্রের নায়ক ভাবতে থাকে। তার নিজের একটা ‘দুঃখ দুঃখ আধারি’ জগত তৈরি করে ফেলে। কিন্তু ‘দিন শেষে ভালো আছি’ এটাই সবচেয়ে ভালো মানুষের একটা চরম সুখপাঠ্য গল্প। বিশ্বাস করুন আর না করুন। কেননা, পৃথিবীতে সবকিছু বদলানোর মত অসীম ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে পৃথিবীতে পাঠাননি। আপনি চাইলেও সবকিছুই আপনার মত হবেনা কখনোই। কিছু অনিয়ম থাকবে, কিছু অপছন্দ থাকবে, কিছু অসহনীয় দৃশ্য থাকবে আপনাকে দখল করে। আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে; হয় নিজেকে তাদের সাথে অথবা তাদেরকে নিজের সাথে। কোনটি করবেন, তা একান্তই আপনার দৃঢ বিশ্বাস, ইচ্ছাশক্তি, মানুষকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা, দুঃখ হজম করে নেয়ার ক্ষমতা, বাতাসের গতিতে ছোটার ক্ষিপ্রতা-এসবের উপরেই নির্ভর করবে। আপনি মানিয়ে নিতে না পারলে সারাদিন, সারা জনমভর আপনার বিছানায় কেঁদে কেঁদে একটা মহাকাব্য রচনা করলেন, সত্যি বলতে সেই মহাকাব্যের একটা ফুটো পয়সার দামও নেই। কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করবে না। কারণ, এই পৃথিবীতে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজের স্বার্থের সাথে জড়িত যে যাকে দেখবে, দেখে, তাকেই সেই পরিমাণ সময় দিবে ও দেয়। সময় ও বাস্তবতা বিশেষে বাবা মাও স্বার্থপর হয় সবসময়ই। এখন এ দৃষ্টান্ত দেয়ার দরকার পড়বে না, কারণ প্রতিদিন পত্রিকায় যা দেখি তা শুধু চরম নৃশংস দৃষ্টান্ত আমাদের জন্য, তাই স্বাভাবিক উদাহরণের প্রয়োজন নেই বলেই মনেকরি। আমার এক অতি আপন বড় ভাই বলেছিল, “ফেরদৌস, সংসারে যে ছেলেটার আয় সবচেয়ে কম, বাবা-মা সেই ছেলেটার খোঁজ খবরও সবচেয়ে কম নেয়, সেই ছেলেটার সাথেই বাবা-মা সবচেয়ে কর্কশ ভাষায় কথা বলে! সেই ছেলেটা ক ফোটা চোখের জলে তার ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা ভিজিয়ে ফেলল, সে খবর কেউই রাখেনা। যদি কেউ রাখে, সে একজন সেই ছেলেটির পাগল বন্ধু, পাগল আপনজন বা পাগল স্ত্রী- এরকম কেউই হবে, সে সুস্থ নয়।”
হয়তো কারো জন্মদিনে তার বাবা মা কোন পার্টির আয়োজন করলো না, বা বাড়ি থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বাবা মা থাকায় মায়ের আঁচলের সুঘ্রাণটা সে অনেকদিন ধরে অনুভব করতে পারে কিন্তু বাস্তবে পায় না, সে হয়তো এই দুখকে অনেক বিশাল মনে করে একা একা কাঁদতে পারে, কিন্তু চার বছরের যে ছেলেটি জানে ডাস্টবিনই তার জন্মস্থল, আবর্জনাই তার বাবা মা, সে কখনোই কাঁদে না এই ভেবে যে, তার জন্মদিনে কেউ কেন তাকে উইশ করলো না। যে কিশোরী পতিতালয়ে প্রতিরাতে তার বুকের মধ্যেকার একেকটা কোমল প্রজাপতিকে খুন হতে দেখে, সে কখনো এই ভেবে কাঁদে না যে, তার বাবা তাকে কেন বসুন্ধরার সেই এক্সেপশনাল কস্মেটিক্স বক্সটা কিনে দিল না। কেননা কান্না তার জন্য নয়-সে এটা খুব ভালোভাবে জানে। সে এটাও জানে ঠিক কোন্ কোন্ জায়গায় তাকে কীভাবে কতটুকু কাঁদতে হবে। দিন শেষে সে নিজেকে জীবিত দেখতে চায়, পেটপুরে আহারী দেখতে চায়, এটুকুই তার পৃথিবী আর তার পৃথিবীটাই তার মত!
শেষ করবো একটা অসম্ভব সুন্দর গল্প দিয়ে। ঢাকা শহরের গল্প, বাস্তব তো অবশ্যই। ছেলেটির বাবা লাখপতি, মা উচ্চ শিক্ষিত, সে অনার্স পড়ুয়া, ছোট বোনটি ইন্টারমিডিয়েটে পড়া এক চঞ্চলা পরী। এতটা সুখের পরিবার সে পেয়েছে, মাঝে মাঝে সে মনে করে পৃথিবীতে তার পরিবারের মত সুখী পরিবার আর একটাও নেই! হঠাৎ একদিন শোনা যায়, তার চল্লিশোর্ধ্ব মা তাদের গাড়ীর ড্রাইভারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে। ছেলেটি একটা অন্ধকার জগত তৈরী করে নিল কাঁদার জন্য, আর স্রষ্টার কাছ থেকে একটা সমুদ্র ধার করে নিল সে কান্নার পানি চোখে যোগান দেয়ার জন্য! কিছুদিন পরে প্রমাণসহ জানতে পারলো, তার বাবাও ইদানীং পতিতালয়ে যাতায়াত করে নিয়মিত। ছেলেটা চোখের পানির সাথে বাড়তি নেশার পানিও সেবন শুরু করলো, যাতে তার দুঃখ ঝেড়ে বিদায় হয়। এর কিছুদিন পরে সে পেল কিছু ভিডিও যেখানে তার অতি আদরের বোনটাকে দেখা যাচ্ছে একটা পর্নোগ্রাফিতে! এবার কী হবে তার? অনুমান করুন। এরপরে আরো কিছুদিন পরে সে জানতে পায় তার প্রিয় প্রেমিকাও তার চোখের আড়ালে অন্য আরেকটি ছেলের সাথে শারিরীক সম্পর্কের সুখের সমুদ্রে ভাসমান। এবার ভাবুন তো, কতটুকু কাঁদলে, ক’টা সমুদ্রের জল তার চোখ বেয়ে নামলে তার এতগুলো দুঃখ বুক থেকে নেমে যাবে? যেগুলো হিমালয়ের মত ভারী ওজন নিয়ে তার বুকের উপর চড়ে বসে আছে! সে ছেলেটিও আজো বেঁচে আছে, গ্রামে থাকে, একটা বোবা কিশোরীকে বিয়ে করেছে, পরীর মত ফুটফুটে একটা মেয়ে আছে তার; যার জন্য গ্রাম্য মেলা থেকে লাল চুরি নিয়ে আস্লে মেয়েটা খুশি আর আহ্লাদে তাকে অসম্ভব সুন্দর করে ডেকে বলে, বাবা, তোমার গালে একটা আদর দিই? এটাই নাকি তার কাছে বেহেশ্তী একটা দৃশ্য! সে তখন বলে ভাই, সত্যিই “লাইফ ইজ বিউটিফুল!” অথচ এই ছেলেটিও সুইসাইড করার শেষ দৃশ্য পর্যন্ত নিজেকে দাঁড় করিয়েছিল একদিন! একটা ছোট্ট ফ্লেক্সিলোডের দোকান করে। শহরকে সে বসবাসের জন্য ঘৃণা করে যদিও কিন্তু সে আর কাঁদে না, সে এখন বলে “আমি ভালো হলে সারাটা পৃথিবীটাই ভালো। কারণ পৃথিবীটা যার যার কাছে তার তার মত। কেউ কাঁদলে, কেউ চলে গেলেও কারো কিছুই যায় আসেনা, আসবেও না! কারণ পৃথিবীটাই তার নিজের মতই!”
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:১৫