somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপদখল ( ছোটগল্প )

১২ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৫:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-------------
ফেরদৌস আলম
---
নিকেশ কালো আঁধারের তাড়ায় সন্ধ্যারানীর বিদায়কালে দূর্বা ঘাসের মেঠো পথে হালকা হালকা শিশির জমতে শুরু করেছে ততক্ষণে । হাঁটুভাঙ্গা জল আর কাদা ভেঙ্গে লাঙ্গলটানা অবশ শরীর নিয়ে গোয়াল ঘরে বাঁধা গরুগুলো চোখ বুজে আপনমনে জাবর কাটছে । কেরোসিনের হারিকেন বাতিগুলো টিপ টিপ করে জ্বলছে বহু দূরের খরের চালার ছোট্ট কুটীরগুলোতে । উঠোনের সামান্য দূরে অবহেলায় বেড়ে উঠা ঝোপ জঙ্গলের মাঝ থেকে দু’ একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা থেকে থেকে ডেকে উঠছে । শান্ত, নীরব আর নিশ্চল যেন সারা পত্র পল্লবের জগত । হাট করে ফেরা সবজির দোকানীর সাইকেলের বেল টুং টুং করে বেজে উঠলে কান খাড়া হয়ে যায় অপেক্ষায় থাকা গ্রাম্য বঁধুর । টুকরো মেঘবালিকা চাঁদকে আড়াল করতে হুড়োহুড়ি লাগালেও আবছা আবছা আলোয় চাঁদের হাসি যেন আরও বেশী মিঠে লাগে । মিঠে মিঠে হয়ে উঠে বুড়ো দাদা-দাদীর পান চিবানো মুখে বহু আগের রাজা রানীর গপ্প সপ্প । ভাত আর চচ্চরির হাড়ি পাতিলগুলো ঘরের গিন্নির হাত ধরে ঘরের কোণায় ঠাই পায় অতি স্নেহ যত্নে। মোড়ের দোকানে দোকানে বুড়োরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে – “ কী দেখলাম আর কী হল ! ’’ জোয়ানরা এপাশে ওপাশে জটলা পেকে কমদামী বিড়ি ফুঁকে রুজি রোজগারের হাল চাল ঠাউরায় । একাল অকাল মিলে যেন সব জগাখিচুরির আবির্ভাব । ওদিকে জেলে পারার উঠোন থেকে জালের আঁশটে গন্ধ মৌ মৌ করে রাত অবধি ।

এ গন্ধ হয়তো সুগন্ধি নয়, তবুও ওদের কাছে যেন আগাগোড়া তাই। এ আঁশটে গন্ধের তবুও বেশ গভীর এক বিশেষত্ব আছে। যে সীমানা পর্যন্ত এর ছড়াছড়ি সে পর্যন্তই বোঝা যাবে যে এটা জেলে পল্লী। জেলে বা মাঝিই এরা, দুনিয়ার অতশত প্যাঁচগোচ বোঝেনা। তবুও এদের সাদামাটা হৃদয়টুকুতে নানা রকমের অদৃশ্য সুবাস মাখামাখি হয়ে রয় দিনভর। এরা মাছ ধরে, জাল বুনে, ছায়া-পড়া বিকেলে শশব্যস্ত হয়ে বাজারের দিকে ছুটে, বাজারে গলা উচিয়ে একটানা মাছের দাম হাঁকায়, সন্ধ্যেয় গামছার মাথায় পুটলি বেঁধে সবজি কেনে ঘরে ফেরে, নদীতে থাকলে দিনের বেশির ভাগ সময় ভেজা গায়ে নেংটি পড়েই থাকে- এই হল জেলে বা মাঝিদের নিটেল জীবন। আর ওদের ঘরের গিন্নীরা চুলা, পাতিল, কাঁথা সেলাই নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ স্বামীর কাছ থেকে জাল বুননের শিল্পটা রপ্ত করে নিয়ে নতুন বা পুরাতন জাল সেলাই করে।

এই সন্ধ্যেবেলা কোন এক সুনয়না, কোমলিনী, নিঃসঙ্গ জেলেগিন্নী অভিমানী মন নিয়ে গুনগুন করে যাছে একমনে। নাম তার পালকি। তার সোয়ামীর নাম পরান। পরান মাঝি। পরান মাঝির একচালা টিনের ঘর, চারপাশে পাঠখড়ির বেড়া, পেছনে অজগর সাপের মত বাঁকানো একটি নিমগাছ। ঘরের সামনে মুখোমুখি শ’ গজ সামনে নয়ন মাঝির আরেকখানা ঘর। তার বউ নেই, একলা মানুষ, একলা কারবার। বড় ভাই পরান মাঝির ঘরে পালকি বউ হয়ে আসার মাত্র মাস খানেক হল, তাই সম্পর্কটা এখনও দহরম-মহরম মশকরার সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। চৌকিতে অলস দেহে শায়িত পালকি, কানে হাত দিয়ে আনমনে দুল নাড়ছে, মুখে গুনগুনের মিহি সুর আশেপাশে অতটা দূরে যাচ্ছে না। সে নিজেই গায়িকা, নিজেই শ্রোতা, ঠিক কোন গানের সুরে গুনগুন করছে তাও শুধু তারই জানা। বালিশের পেছনে এলিয়ে দেয়া আছে ঘন-কালো এলিয়ে পড়া চুল, মাথা থেকে নেমে গিয়ে মাটি ছুঁইছুঁই করছে। চোখজোড়া বুজে আছে, ঘন ভ্রু, ঘন-কালো তার পাপড়ি, চোখের মাঝেই যেন দুনিয়ার তাবৎ মায়ার ভরাডুবি হয়েছে এই অলস সন্ধ্যেবেলায়। হঠাৎ উঠোনের ওপাশ থেকে আদুরে ডাক আসে-
- গিন্নী আমার, কই গো? দেখি একটু চাঁদমুখখানি।
ত্বরিৎ ছুটে এসে পালকি খোলা চুলে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়, হাতে ধরা শাড়ির আঁচলে কামড় দিতে দিতে বলে,
-চাঁদ উঠে আবার ডুইব্যা যাইতে চায়। এমন সময় চাঁদমুখ কি আর দেখা যায়?
-কও কি গিন্নী! সন্ধ্যেবেলা চাঁদ ডুইব্যা যায় ক্যামনে?
-নিশীরাত আর সন্ধ্যেবেলার মাঝে যে তফাৎ না বোঝে, তারে আবার চাঁদ ডুইব্যা যাওনের কথা বুঝাই ক্যামনে? আজ ঘরে না এলেও হত মাঝি, সবে তো তোমার কাছে সন্ধ্যেরাত এখনও, মাঝরাত্রি নাগাদ নয়নের লগে দরিয়াতেই মাছ ধরতা!
-ওমা, সেকি! চাঁদ ঢাইক্যা যেয়ে অমন কালবৈশাখীর কালো মেঘ যে এই সন্ধ্যেবেলাতেই পালকির আকাশে ভাইস্যা উঠছে, সেইডা তো খেয়ালই করি নাই-চালের উপর মাছ রাখার টিনের কৌটাখান রাখতে রাখতে বলে পরান।
-মাঝি, তোমার নামটাই শুধু পরান, অন্তরটা যেন শুকনা গরান কাঠ। মন-দরিয়ায় ডুব দিতে জাননা তো তুমি। শুধু মুখেই ভাব-ভালোবাসার মন-ভুলানো যত কথা, কী ভুবন-ভুলানো হাসি! আর কাজের বেলায় ঠনঠনে! আমি আর এখন থেকে তোমার অমন হাসিতে ভুলব না কিন্তু হু, বলে দিচ্ছি! এ আমার পাকা কথা। শুধু নামেই ‘পরান মাঝি’ কামের বেলায় ‘হারায়ে গেছি’।
-ওমা, গিন্নি দেহি গালের সাথে মনও ফুইল্যা রাখছে, পরান মাঝির বুক জুড়ে শুধু আঁশটে গন্ধ, তাই না? – বলেই হাত ধরে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে আসে পালকিকে। চৌকির উপর বসায়ে গাল টিপে বলে, ও আমার পরানের পরান, মাছ ঝাঁকায় রাইখ্যা কি আমরা ঘরে আসবার পারি? মাছ রাখুম কোথায়? আড়তের ফ্রিজে রাখতে গেলে যে অনেক টাকা লাগে। তোমার পরান মাঝি এত্ত টাকা কই পাইব?
পালকি আরও অভিমানী হয়ে পরানের কাঁধে হেলান দিয়ে বলে, অতশত কিছু বুঝিনা আমি। আমার পরান মাঝিরে সারাক্ষণই যে আমার পরানের লগে বাইন্ধ্যা রাখবার চাই!
-পরান তো তোমার পরানের লগেই আছে গিন্নী। কিন্তু মাছ না বেচলে খামু কী? আমার আদরের পালকিরে সাজাইব কী দিয়া?
-খামু তোমার নদীর হাওয়া, সে নদীর মিঠে জল, রাতের জোছনা, তোমার চোখে-মুখে লেগে থাকা সুখের মোওয়া!
হাসতে হাসতে পালকির আঙ্গুলে একটুখানি জোরে টিপ দিয়ে পরান বলে, -এগুলা খাইয়া কি পেট ভরব? বাইচা থাকতে হইব না?
-না, প্রেম দরিয়ায় ডুইব্যা মইরা যামু তোমার লগে মাঝি! বলেই হেসে কুটি কুটি হয় পালকি।
পরান মাঝি রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে, পালকির খোলা চুলের দুলুনি, হাসির ঝলকে হাস্যোজ্বল চকচকে চোখ, প্রদীপ আলোয় মাখামাখা অপূর্ব সুন্দর মুখমণ্ডল কী চমৎকার আভাই না ছড়াচ্ছে উজাড় করে। শুভ্রকপাল, শুভ্রচিবুক আর সাথে নিখাদ হাসি-পৃথিবীতে নারীর স্বর্গীয় রুপ যেন ক্ষণিকের জন্য বিদ্যুৎ চমক হয়ে খেলে গেল! এখনই যদি সমস্ত পৃথিবীবাসীকে এই ঘটনার সাক্ষী বানানো যেত! সত্যিই যে মানব প্রেম কত অপূর্ব, কতটা স্বর্গীয়, তা যেন আজই প্রথম পরানের চোখে প্রথম ধরা পড়ল।

(বাকী অংশ আগামী কোন একদিন)

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৫:৫৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×