আচ্ছা নীলা, তোমার নাম ‘নীলা’ ই হল কেন?
বাবা রেখেছে তাই। বাবার নীল রঙ নাকি খুবই পছন্দের ছিল।
কোন্ নীল?
সে আবার কেমন প্রশ্ন? আকাশের নীল, সাগরের জলের নীল।
শুধু এই দুটো নীলের জন্যেই?
ভারি মুশকিল হল তো? মানুষ কি দুনিয়ার সব নীল গণনা করে তার মেয়ের নাম নীলা রাখবে নাকি?
তা জানিনে, তবে তোমার নামের বিশেষত্বটা তো একটু গভীরভাবেই তোমার জানা থাকলে ভাল হত।
তুমি তো আমার স্বামী, তুমিই বল দেখি দুই একটা নীলের নাম।
বলব? মন খারাপ করবে না তো?
কেন? তুমি কি ভয়ংকর কিছু বলবে নাকি?
না, স্বাভাবিক কিছুই বলব, কিন্তু তুমি যদি ভয়ংকরভাবে নিয়ে নাও। অনেক সময় মানুষের নিয়ে নেওয়ার মধ্যে থেকেই যে অনেক কিছুই ঘটে যায়! ধরো, প্রথম যেদিন তুমি আমার রুমে গিয়েছিলে, সেদিন দিয়াশলাই দেখে তুমি ভেবেই নিয়েছিলে যে, আমি সিগারেট খাই। কিন্তু আমি তো ওটা শুধু মোমবাতি, কয়েল আর গ্যাস স্টোভ জ্বালানোর জন্যই ব্যবহার করতাম। ম্যাচ জিনিসটা কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল বা আরো খোলাসা করে বললে গেলে, নিরপেক্ষই ছিল। তুমি ওটাকে নিজের মত করে নিয়েছিলে, একটা ধারণা বানিয়ে নিয়েছিলে।
তার মানে আমি কি সবসময় নেগেটিভ ধারণাই করি?
না, সেটাও বলিনি। বলেছি নিরপেক্ষ হও আগে। তারপর তলিয়ে দেখো, যতগুলো পার্শ্ব আছে সবদিক থেকে। আপনা আপনি তখন পজেটিভ – নেগেটিভ বের হয়ে আসবে।
আচ্ছা যাও, তাই হলাম। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। এবার বল একটা নীলের নাম।
চরম বিষধর সাপের কামড়ে আহত মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের মুখেও কিন্তু নীল রঙ ভেসে উঠে! একটা অদ্ভুত নীল! তাকিয়ে থাকতে সাহস হয় না।
আমি কি তবে গোখরাও হতে পারি? আমার বিষে কে নীলাভ হবে তাহলে? তুমি ?
এই যে, তুমি কিন্তু কথার বরখেলাফ করছ। নিরপেক্ষ থাকছ না।
স্বাক্ষর, কে বলেছে তোমায় - মানুষ নিরপেক্ষ হতে পারে কখনো। কখনোই পারে না। মানুষ সবচাইতে পক্ষপাতিত্ব করে নিজের প্রতি, তারপর প্রিয় মানুষগুলোর প্রতি। এজন্য সে সারা দুনিয়াকে ঠকায়, স্বজনপ্রীতি করে।
আমরাও করছি অনবরত, না?
হুম, স্বাক্ষর।
দেখো নীলা, বিছানায় অর্ণব কত সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে, মুখটা কত নিষ্পাপ সুন্দর! আচ্ছা নীলা, তুমি তো অর্নবের মা, আমার জীবনসঙ্গিনী। ধরো, তুমি একটি দানা পেলে খাওয়ানোর জন্য সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজে, যে দানা ভাগ-জোখ করা যাবে না। যে খাবে সেই বাঁচবে, অপরজন চলে যাবে। কাকে খাওয়াবে?
আমি যে গণিতে বরাবরই কাঁচা, স্বাক্ষর।
জীবনের গণিত এড়িয়ে সামনে এগোনো যায় না নীলা। কষতেই হয়, চাও বা না চাও। ভুল হলে শূন্য, সামনে তখন আরো জটিল গণিত এসে উপস্থিত হয়।
শোনো স্বাক্ষর, সন্তান, স্বামী, এদেরকে ভালোবাসার কোন পরিমাপক, সংজ্ঞা, বিশেষণ নেই। আর ওই তো আমার জগত জুড়ে একজন।
সত্যিই তাই? ওকে ভালোবাসার কোন সংজ্ঞা নেই? ওর কিছু একটা হলেই আমাদেরই সজ্ঞাহীন হয়ে যেতে ইচ্ছে করে, না?
হুম।
আমার কেন জানি মনে হয়, আমার আরো সন্তান আছে, নীলা।
সে কেমন কথা গো? সেটা আবার কীভাবে?
গাঁয়ে। আরো দুটো সন্তান। বাবা আর মা।
হু।
কেমন হুম? বাবা-মা শুধু হু’ই, নীলা?
না, তা নয়। আমি তোমার কথায় সায় দিলাম , তাই হু বললাম।
সায় কিন্তু মানুষ অনেক সময় উদাসীনভাবেও দেয়। যেন সে আছে, তবে অতটা তীব্র ভাবে নয়।
তুমি কি বলছ, আমি বাবা-মা’র জন্য ভাবি না। আমি তাদের জন্য কিছু করি না।
বাবা-মা রাতে কী খেয়েছ - খোঁজ নিয়েছ আজ?
না, আমি তো এক সপ্তাহ পরপর তাদের খোঁজ নেই। আর তুমিও তো নিয়মিত খোঁজ নাও না? দু’ দিন পরপর নাও।
সে জন্যেই তো বলছি।, তুমি পারতে? আমি পারতাম? ঠিক এক সপ্তাহ পরপর আমার এই অর্নবের খোঁজ করতে নিতে যে – সে খেয়েছে কিনা।
ও আর বাবা-মা এক হল?
আলাদা হল কীভাবে?
ও ছোট, আর বাবা-মা পূর্ণবয়স্ক। হাটা-চলা তো বেশ করতেই পারে এখনও। তাদের আর কোন ভবিষ্যত নেই সামনে। আর ওর সামনে কত ভবিষ্যত। ওকে মানুষ করতে হবে, ও কত বড় হবে!
তোমার দুটো সন্তান যদি থাকত, একটি যদি জন্মান্ধ হত, সাথে পঙ্গুও হত, তার সাথে বধির আর বোবা হত – যার কোন ভবিষ্যত নেই – তার সাথেও কি তুমি এটাই করতে নীলা?
কী বলছ তুমি? সেও আমার সন্তানই হত, অর্ণবের মতই! দুটোর শরীরেই তো তোমার আমার রক্ত! দুটোই যে নাড়ি ছেড়া ধন হত!
ঠিক সেই ভাবেই বাবা-মা আমার সন্তান নীলা। তাদের শরীরের রক্ত আমার শরীরে। এটাকে উল্টাও, তাহলে হবে আমার রক্ত তাদের শরীরে। তাদের শরীরের রক্ত আর অর্ণবের শরীরের রক্তের মিলনস্থল আমার দেহের রক্ত। ওরা সবাই আমার রক্ত! ওরা সবাই যে আমার সন্তান, নীলা!
জীবনে সবাইকে একসাথে সুখী করা যায় না, স্বাক্ষর।
হুম, ঠিকই বলেছ নীলা, আমার সকল সন্তান আর তোমাকেও তো একসাথে সুখী করতে পারব না কখনোই। তবে কি জান? সকল সন্তানকে একসাথে ভালবাসা যায়, আদর করা যায়, দু’ হাতের বিশাল বন্ধনে জড়িয়ে রাখা যায়!
মোবাইলটা নিয়ে স্বাক্ষর বিছানার কাছে গেল। ঝুকে পড়ে ঘুমন্ত অর্ণবের গালে একটা চুম্বন এঁকে দিল। এরপর মোবাইলে ডায়াল করল একটি নাম্বার যাকে সকালেও একবার ফোন করেছিল। রিসিভ হতেই সে বলল, মা! কেমন আছ? রাতে কী খেয়েছ আজ তোমরা?
কীরে বাপ, আজ যে আবার তুই ফোন কর্লি? কী হয়েছে রে বাবা? বউমার সাথে কিছু হয়েছে, বাবা?
কিছু না মা।
সে ফোনে কথা বলতে বলতে নীলার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবে, তুমি নীল, না নীলা?
নীল, না নীলা?
ফেরদৌস আলম
------
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ৯:২৩