somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোন কোন রাত আসে শুধু কান্নার জন্যই

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রাতটা হিম হয়ে আছে, খানিকটা অন্ধকারে, খানিকটা নীরবতায়, খানিকটা চাদ-তারাদের মেঘে ঢেকে যাওয়ায়। বেলকুনির পাশে দাঁড়ানো গোলাপ গাছে পাতাগুলো মৃদু দুলছে, তাও যেন আনমনেই। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কোনটাই নেই – এমন করে। যেটুকু বাতাস জানালা দিয়ে আসছে, তাতে মন খারাপ হবে, নিজেকে দুখী ভাবতে সুবিধে হবে। বাতাসের ধরণটাই তেমন। কয়েকবার মোবাইলে গান ছেড়েছিলাম, ভালো লাগেনি। ধুর ছাই, কয়েকবার! ভাবা যাই। প্রথমবার গান পছন্দ হচ্ছিল না, এরপর সাউন্ড সিস্টেম, এরপরে মনে হল এটা ঠিক গান শোনার রাত নয়। সব রাত সবকিছুর জন্যে নয়, কিছু কিছু রাতে কিছু না কিছু ভাবতে হয়। খয়েরী চেয়ারটা প্লাস্টিকের, বসলে পিঠ একদম সোজাই থাকে। বেলকুনিতেই বসলাম, দরজা খোলা রেখেই। আমার লাল কভারের ডায়েরীটা বালিশের নিচ থেকে উঁকি মারছে। উঠে গিয়ে নিয়ে এসে আবার বসলাম। এতে যা লিখা আছে – সে শুধু আমারই পাঠ্য – অন্য কারো হাতেই আজ অবধি পড়েনি। ‘দ্য এক্সক্লুসিভ সলো’ বলি আমি ওকে। একা মানুষের একা এক সঙ্গী।


আমি কয়েকবার আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরীটা পড়তে গিয়ে নিজেকে উপলব্ধি করার সীমায় যেতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। আসলে একজন কিশোরীকে, মেয়েকে, নারীকে কিংবা বৃদ্ধাকেই, সে ছাড়া কেউই আর বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না শেষ পর্যন্ত। ‘লাস্ট হিউম্যান’ গল্পটা অদ্ভুত লেগেছিল আমার কাছে। এখন পর্যন্ত এটাই আমার পড়া সেরা গল্প! ইশ্বর পৃথিবী ধ্বংস করে দিচ্ছেন, সকল মানুষের মৃত্যুর পরে একদম শেষে যে বেঁচে ছিল – সে একজন মানবী। ইশ্বরের ইচ্ছে হল কিছু আলাপচারিতা করবে সেই মানবীর সাথে। “ হঠাৎ ইশ্বর বলল, তোমার শেষ কোন ইচ্ছা আছে? চোখ বিস্ফোরিত করে মানবী বলল, অবশ্যই!
কী ইচ্ছা?
কাছের মানুষদের একবার শুধু দেখতে চাই!
কারা তোমার কাছের মানুষ?
আমার স্বামী, সন্তান, মা, বাবা, ভাই, বোন – এরা সবাই।
মাঝে মাঝে না তুমি বলতে আমাকে – হায় ইশ্বর! এরা কেউই আমায় বোঝে না। এরা কেউ কি আমার আপন? বলেছিলে তুমি এমন, মানবী?
হু, একবার নয়, অসংখ্য বার বলেছি, ইশ্বর। তবুও ওরাই মনে হয় কাছের, ওরাই আপন!
যারা তোমাকে বুঝতেই পারে না তারা আবার কাছের হয় কীভাবে?
সেটা আমিও বুঝিনা আমার ইশ্বর। ভাবি, যারা কাছে থাকে তারাই কাছের, তারাই আপন! ইশ্বর আর প্রশ্ন করেনি।” ‘লাস্ট হিউম্যানের’ মত আমিও যেন নিজেকে বুঝিনা, কী চাই, কেন চাই। অন্যদেরকেও যা বোঝাতে চাই – সেটা আমার মত করে অন্যরা বোঝে না কেন। দুই সপ্তাহ আগে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কত আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম – মা, বাবাকে কিছু বলেছ ব্যাপারটা নিয়ে ? কিছু একটা তাড়াতাড়ি করো মা! মা পাশ ফিরে কেমন একটা চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে বলল, মা রে, এসব ব্যাপারে একটু সাবধানে চলতে হয়। তোর বাবাকে তো বলেছি, কার কার সাথে যেন কথা বলেছে। তুই কি খুব টেনশন করছিস ইদানীং এটা নিয়ে?
না, মা! সেদিনও আমি কিশোরী হয়ে বুঝতে পারিনি আমার এই ‘না’ এর মাঝে কত বিকট চিৎকারের একটা ‘হ্যা’ ফাঁস লেগে রয়ে গিয়েছিল। আমার ‘হ্যা’র মাঝে না থাকে, ‘না’র মাঝে ‘হ্যা’ থাকে। মুখটা দেখেও কি আমার এত্ত আপন বাবা-মা এই ‘হ্যা’, ‘ন্যা’র লুকোচুরিটা বুঝতে পারে না। নাকি তাদের বুঝতে পারাটাও আমিই বুঝতে পারিনা। আচ্ছা, চোখের আবার কী হল? খচখচ করছে কেন? এই যা! পানিও পড়ছে চোখ থেকে। বাবাটা যে কই থাকে আজকাল? আমি বাবার সামনে কেঁদেছি আর বাবা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে চোখের পানি মুছে দেয়নি – এমন দিন একটাও আসেনি আমার জীবনে। মূহুর্তেই বাবা কিছু একটা করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা মেয়েটার মন ভালো করে দিত যাদুর মত! এই তো গতকালও যখন আমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল তখন বাবার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম। বাবা ধরে বলল, “ভয় পেয়ো না মা! ঠিক হয়ে যাবে।” তখনও আমি বাবার সেই শীতল স্নেহমাখা স্পর্শ অনুভব করলাম। বাবাটাও যেন আমার একটা বিকল্প ডায়েরী! মা তার কলম! তবুও আজ কেন জানি এমন ফাঁকা ফাঁকা, নিঃসঙ্গ রাত, আর অনুপ্রবেশকারী বেদনা চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে আমায়।


এই যে আমি মাকে মাঝে মাথা টিপে দেই এত সুন্দর করে। মা বেশ অবাক হয়, আরামে মা’র চোখ দুটো বুজে আসে! হাতটা মায়ের মুঠির মধ্যে ভরে বলে, কী রে, আমার বয়স না হতেই যে তুই আমার মা হয়ে গেলি! আমার জামাই বাবুজির ঘরে চলে গেলে তখন এই বুড়ি মা টাকে কে দেখবে শুনি? কেউ না, মা! আল্লাহ চাইলে আমিই দেখব! মা কত গভীর আবেগ নিয়ে থমথমে হয়ে যায় তখন। শ্বাস গাঢ হয়ে আসে, কাঁদোকাঁদো হয়ে আমার হাতে চুমো খেয়ে যায় পাগলের মত। দেয়ালে টাঙ্গানো আমার ছোটবেলার ছবির দিকে তাকিয়ে বলে, ছবিটা টাঙ্গিয়ে তোর বাবাকে বলেছিলাম, দেখেছ? ও কেমন অবিকল আমার মা’র মত হয়েছে, না? তোর বাবা দুষ্টুমি করে মুখ ভেংচে বলত, বলেছে তোমাকে! ও দেখতে ঠিক আমার মা’র মত হয়েছে! মা এত্ত সুন্দর করে আমার চুড়িগুলো আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছে, থাক্‌, আজ পড়তে ইচ্ছে করলেও আর পরব না। মা, বাবা, দুজন দুদিকে কত মুখ ভারি করে বসে আছে। আমি জানি ওরা দুজনেই দুজনকে অপরাধী ভাবছে। কেউ কারো মুখোমুখি হতে চাচ্ছে না। আমি অনেকবারই দুজনকেই ডাকলাম। কেউ ভ্রুক্ষেপই করল না। আবারও তাই ঐ কথাই মনে হচ্ছে, একটি মেয়েকে কেউই আসলে বুঝতে পারেনা মনে হয়। আমার শুভ্র মুখের দিকে তাকালেও তো একটু মায়া দিতে পারতাম ওদের, হয়তো মন খারাপটা একটু হলেও ভাল হত। আমি আসলেই কত অসহায় এই অবস্থায়, না? কাউকে বোঝাতে পারি না, নিজে বুঝলেও বলতে পারিনা, বললেও বেশি বলা যায় না। নারী জীবনের আরেকটা যথার্থ প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘অসহায়ত্ব’ – আজ সেটাই আমার মনে হচ্ছে।


রাতটা আরো হিম হয়ে আসছে, তাই দেখে আমার যেন আরো কান্না পাচ্ছে। সুনসান নিঃসঙ্গতা আর সমুদ্রের সমান বিস্বাদ ঘিরে রাখা এই বাড়িটাকে দেখে চোখের পানি আর বাঁধ মানছে না কিছুতেই। আজ কেউ কারো সাথেই কথা বলছে না। আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হওয়া, মলিন আর নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া ছোট্ট আপু রোদেলার ঘুমন্ত হতাশ চেহারাটা দেখেও আরো মন আধার হয়ে আসছে। বালিশে ঠেস দিয়ে ছোট ভাই রবিও আমার আঁকাবুকির খাতাটা নিয়ে উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। কতবার বললাম, অ্যাই রবি, যা, রোদেলার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়! শুনলই না আমার কথা! বাবা মার কষ্টটা যেন ওকেও ছেয়ে ফেলেছে। আবার ওকে ডেকে বললাম, রবি, কাল থেকে গোলাপ গাছটায় তুই’ই একটু পানি দিস্‌ তো! তবুও দুষ্টটার কোন সাড়া নেই।


হঠাৎ দূর থেকে তনু আপু জোরে ডেকে উঠে বলল, অ্যাই রিশা, আবার কাদছিস্‌ , না? স্বর্গে এসেও কেউ কাঁদে নাকি? আপুকে ঘিরে ওখানে আরও অনেক আপু জটলা পেকে আছে। কেউ একজন বলল, ওসব কিছু না রিশা, আবার কেউ না কেউ স্বর্গে আসবে, সবাই একটু মায়া-দরদ নিয়ে কিছুদিন ধরে কান্না করবে, নয়তো কিছু একটা করবে। সময় গড়ালে সবাই ভুলে যাবে। আবার যেমন তেমনই চলবে। আমি বললাম, দেখেছ আপু, আমাদের বাড়ির সবাই অন্ধকারে বসে কেমন বিষণ্ণ হয়ে আছে, কেঁদেই যাচ্ছে। আপু বলল, চিন্তা করিস্‌ না, কিছু কিছু রাত থাকে শুধু কাঁদার জন্য, চাইলেও কান্না থেকে দূরে থাকা যায় না!
-------
সুরাইয়া আক্তার রিশা
১০৪, সিদ্দিক বাজার, পুরান ঢাকা।
ছাত্রীঃ উইল্‌স লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল।






সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৫১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×