somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্লান্তি ও শ্রান্তি

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক্লান্তি ও শ্রান্তি
==============
বাবা, কী কর এত রাতে বেলকুনিতে?

এই তো, রাত দেখছি, রাতের সৌন্দর্য দেখছি। দূর হতে দখিণা বাতাস আসছে খুব পরিমাণ মত। যেটুকুতে শরীর আরামে হিম হয়ে যেতে চায় ঠিক সেটুকুই। ঘুমও আসছে না। যেন অকর্মা বয়স্ক লোকেরা তারও বড় শত্রু। তোর কী হল, বাবা? বৌমাকে একা ঘরে রেখেই এলি যে!

ও ঘুমাচ্ছে বাবা। বাবা, তুমি এত অদ্ভুত সুন্দর করে কথা বলতে পার কীভাবে? জানো বাবা, তোমার কথা শোনার পরে আজও আমার কাছে আর কোন মানুষের কথা, বক্তব্য বা মুখ নিঃসৃত যাইহোক না কেন – সেরা মনে হয়নি। তুমি এত গভীরে গিয়ে ভাবতে পার, আমি যেন তার তলায় খুঁজে পাইনা।

না, না, বাবা। আমি তোর বাবা তো, তাই তোর এমন মনে হচ্ছে। এই যে দেখছিস সুনসান নীরবতা ছেয়ে আছে চারপাশ, কেমন বোবা হওয়ার অভিনয় করে আছে সবকিছু, আঁধারের দখলদারিত্ব জেঁকে বসে আছে। মানুষ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এ তো সবই চেনা দৃশ্য, তাই নারে বাবা?

হ্যা, বাবা। এ তো সবই চেনা। মানুষের গড়পড়তা ভাবনা, কাজ আর লক্ষ্য একই। কেউ কেউ আলাদা। সে লাখে একজন।

ধর, তোর বাবা সেই রকম একজন। একটু পাগল টাইপের! কিন্তু জানিস বাবা, এই চেনা দৃশ্যগুলোর মধ্যেও অচেনা কিছু ব্যাপার থাকে যেগুলো আমরা দেখতে পাইনা। আচ্ছা, তোর আজ মন খারাপ অনেক, নারে?

হ্যা বাবা। অনেক। নইলে কি আর তোমার কাছে এসে এভাবে ঘাপটি মেরে বসি। সবাই এত সংসার সংসার করে কেন বাবা? টাকা টাকা, বাড়ি বাড়ি, গাড়ি গাড়ি!

বৌমা তোকে বলে, “যা কিছু করি তোমার সংসারের জন্যই তো করি, একটা ভালো বাড়ি আমাদের ভবিষ্যতের জন্যই প্রয়োজন, ছেলেটা বড় হচ্ছে। ওর জন্য কিছু সঞ্চয়ও করা দরকার।” এসব বলে, না?

হ্যা, বাবা। মানুষের এত চাহিদা আসে কোত্থেকে? সবাই সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার কী উন্মত্ত প্রতিযোগিতা। কেউ থামার মত নয়।

এটার একটা কারণ আছে বাবা। চোখ দূষিত হলে মগজ দূষিত হয়। মগজ হলে মন। আর চারপাশটা তো দূষিত আছেই। দেখ বাবা, আঁধারকে কি তাড়ানো যায়? সূর্যের আলো কি ঢেকে ফেলা যায়? সময় হলে আঁধার আপনা-আপনি চলে যায়। সূর্যও তখন আপনা আপনি আসে। মানুষের সসমস্যাগুলো, চাহিদাগুলো আঁধারের মতই। মানুষ যাই করুক না মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত সেগুলো জেঁকে বসে থাকবেই।

আচ্ছা বাবা, জীবন কি শুধু এটাই? এই প্রতিদিনের মত? স্কুলে গেলাম, স্কুল শেষে কলেজ, ভার্সিটি, একটা ভালো চাকুরি নয়তো ব্যবসা, বিয়ে, সংসার, সন্তান, সন্তানদের জন্য অনেক কিছু রেখে যাওয়া – এরপর শেষ হয়ে যাওয়া। তারপর সেই সন্তানদেরও সেই একই জীবন।

দেখ বাবা, এগুলো জীবনের একটা বড় অংশ। এগুলোর মধ্যেই হয়তো জীবন তার বিস্তার ঘটায়। তাই এগুলো করতে হবে অবশ্যই। কিন্তু জীবনের সুন্দরতম দিকটিও আছে। সেটা হল, নিজের ভাবনার বাইরেও কিছু কাজ করে যাওয়া। প্রতিদিন পৃথিবীর এই চারপাশটার সাথে কথা বলা। চারপাশটার খোঁজ নেয়া, প্রতিদিনের রুটিনের বাইরে গিয়েও কিছু করা। ধর্‌ , তুই প্রতিদিনই একটা গাছের যত্ন নিস, একটা মেঠোপথে ঘাস মাড়িয়ে হাটিস, আলো - আঁধারের সাথে আলাপ করিস, সকালের প্রথম আলো ফুটার সাথে তোর দেখা হয় প্রতিদিনই। এদের সবার একটা ভাষা আছে, বুঝতে পারবি সেটা। সেই ভাষাই এরা তোকে বলবে – ওরা আসলে কেমন আছে। ওরাই তোকে বলবে, পৃথিবীর জন্য কিছু একটা করো। শুধু নিজের জন্যে এই হাহাকার নিয়ে মরে যেওনা।


বাবা, তুমি কিন্তু সত্যিই পাগল, এটা জানো?
জানব না কেন? সারাটা জীবনই তো পাগলামি করে এলাম। তোর মা এই পাগলামির জন্যই তো তেলে-বেগুনে আগুন আমার উপর আজ পর্যন্ত।

বাবা, তোমার হাতটা ধরে থাকি একটু। খুব ইচ্ছে করছে?

আমি তোর বাবা তো?

কেন বাবা? তুমি আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুও।

তাহলে হাত ধরার আগে অনুমতি নিচ্ছিস যে! জানিস্‌ , পৃথিবীতে এখন বাবা-ছেলেদের এমন সম্পর্ক খুব একটা হয় না। একটা দূরত্ব থাকে, বোঝাপড়ার ঘাটতি, ভয় বা সমীহের একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এটা অমান্য করে বাইরে দেখে অভিনয় করে লাভ কী, বল্‌ ? আমার হাত ধরলে তোর খুব শান্তি লাগে, না ?

হ্যা, সেই ছোটবেলার মতই! যেন একটা শীতল ছোঁয়া তোমার হাত বেয়ে আমার শরীরে চলে আসে। আমার অস্থির মন প্রশান্ত হয়। জাগতিক দুশ্চিন্তাগুলো পালিয়ে যায়। একটা খুব ভালো মানুষ নিজের ভেতরে উদয় হয়! এই মানুষটা কিছু চমৎকার ভাবনা ভাবে! আর স্নেহ বা ভালোবাসা, সে তো এমনিতেই তোমার কাছে আসলেই কি, দূরে থাকলেই কি, মনে হয় ঐ জিনিসটার প্রাচুর্যে আমার সারাটা জীবনই ভরা।


আচ্ছা, বৌমা তোকে পছন্দ করেছিল কেন রে বিয়ের আগে?

আমি অনেক ভালো গান গাইতাম বলে, ভালো আবৃত্তি করতাম বলে।

এখন তোর গান, আবৃত্তি শোনে বৌমা?

নাহ্‌ বাবা। এখন সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংসারের কাজ, সন্ধ্যার পরে সংসারের হিসাব। আগামীকালের বাজার কী – হবে তার লিস্ট। এগুলোই। এখন বরং গান, কবিতাই তার শত্রু। বলে, “পুরুষ মানুষকে সারাদিন এত উদাস থাকলে চলেনা। গান কবিতা বিয়ের আগে করেছ ভালো কথা। এখন ওসব করলে ক্যারিয়ার কোথায় যাবে, ভেবেছ? একটা ফ্ল্যাট কবে কিনব, বল তো? ঢাকা শহরে গাড়ি ছাড়া চলে এখন? বাসার ফার্নিচারগুলো চেইঞ্জ করা দরকার।” অথচ তোমার এই বৌমাই বিয়ের আগে প্রতিদিন আমার মুখে একটা কবিতা আবৃত্তি শোনার জন্য কত জেদ করত! রাস্তায়, মাঠে, চেনা-অচেনা পথ ধরে হাটতে চাইত আমার সাথে। আমার গান কবিতা নিয়ে তার নিজেরই কত স্বপ্ন! একটা ম্যাসিভ চেইঞ্জ, বাবা!

হ্যা,রে। পুরো পৃথিবীটারই একটা ম্যাসিভ চেঞ্জ হচ্ছে। সেখানে ও তো এক নারীমাত্র। আমাকে একটা কবিতা শোনাবি, বাবা? কিন্তু একটা শর্তে!

কী শর্ত বাবা?

শোনানোর পরে সোজা ঘুমোতে যাবি ঘরে। ঘুম না আসার এই বুড়ো-বয়সী বদ অভ্যাসটা এখনই না হোক তোর, বাবা!

আচ্ছা, মেনে নিলাম। তুমি কিন্তু বাবা আসলেই অসম্ভব একটা বাবা! তোমার মত বাবাময় পৃথিবী হোক পৃথিবীর সকল সন্তানদের।

এই যা, এত পাগল হোস্‌ না বাবা।

কবিতা শোনার পরে কিন্তু তোমাকেও ঘুমোতে যেতে হবে?

হ্যা, হ্যা, সে তো যাবই। কর্‌ , এবার আবৃত্তি কর্‌!

এটা আবুল হাসানের কবিতা, শিরোনাম –

ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়
=======================



দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায়
বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায় ক্লান্ত দেখায়।
ক্লান্ত মুখটি ক্লান্ত দেখায়, ক্লান্ত চোখটি ক্লান্ত দেখায়।


দুপুর ঘুরে কিশোর তুমি বিকেলবেলায় বাড়ি ফিরলে ক্লান্ত দেখায়! ক্লান্ত দেখায়!
কোথায় ঘুরে সারাদুপুর, ক্লান্ত কিশোর কোথায় ঘোরে?
বুকের মধ্যে কিসের একটা কঠিন দুঃখ রুক্ষ দুপুর শাসন করে,
কিশোর তুমি তার ভিতর বসেই থাকো বাড়ি ফেরোনি... বাড়ি ফেরোনা!


একহারা শরীর দোহারা জামা, দু'হাত যেনো দগ্ধ তামা,
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা, রক্ত চক্ষু শক্ত চোয়াল
সূর্য ঘেরে সকল দেয়াল ভেঙে তুমি কোথায় যে যাও...
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা বাড়ি ফেরোনা!


উত্তোলিত হাতের মুষ্ঠি, কী তুমি চাও?
সর্বনাশ? না সুহৃদ আকাশ? ফিরে তাকাও না, রাস্তা চলো?


কিসের একটা কঠিন দুঃখ যেনো তোমাকে পাথর ছোড়ে
যেনো তোমাকে আউছি করে?
অভিমানে বাড়ি ফেরোনা, সারাদুপুর বাড়ি ফেরোনা বাড়ি ফেরোনা
কোথায় যে যাও ...


বিকেলবেলায় যখোন ফেরাও পা দুটিকে, ক্লান্ত দেখায়
ক্লান্ত কিশোর তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়,
ক্লান্ত দেখায়! তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়!



সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ৭:৫৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×