somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এই নতুন কবিতার পূর্বসূরি নেই

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘কবিতার কোনো মানে থাকে না-- এটা সকলে বোঝে না। কোনো কোনো কবিতার হয়ত মানে হয় কিন্তু পাঠের পর তোমার ভিতরে তো একটি অনুভূতি জাগে। সেই অনুভূতিই আসল।’-- কবিতায় অনুভূতির চেয়ে অহেতুক মানে খোঁজা কিছু বাতিকগ্রস্ত লোকেদের উদ্দেশ্যে কথাটি যিনি বলেছিলেন তিনি জীবনানন্দ দাশ-পরবর্তী একজন গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি ও গণিতবিদ। তিনি বিনয় মজুমদার। প্রয়াত হয়েছেন ২০০৬ সালে। তার মৃত্যুতে ভারত সরকার আলাদাভাবে কোনো শোকসম্মেলনের আয়োজন করেনি, কিন্তু বহু তরুণ বাঙালি কবিই মনে মনে শোকার্ত হয়েছিলেন। শোকার্ত হয়েছিলাম বাংলাদেশে বসে আমরাও অনেকেই।

কিন্তু যাকে কখনও সামনা-সামনি দেখিনি, মিডিয়াতে যাকে নিয়ে খুব একটা প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো হয়নি-- তাকে নিয়ে কেন ছিল এই শোক? কেনই বা আমাদের আড্ডার টেবিলে উঠে আসে এখনো মাঝে মাঝেই তার নাম? কেনই বা তিনি পেয়েছিলেন জীবদ্দশায় ‘কবিতার শহীদ উপাধি’-- এই প্রশ্ন হয়ত অনেকের মনেই উদয় হতে পারে। এর উত্তর সম্ভবত তার নতুন ধরনের কবিতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত নির্লোভ জীবনযাপন ও মানসিক অসুস্থতা! যে বিনয় মজুমদার চাইলেই বড় ইঞ্জিনিয়ারের জীবনযাপন করতে পারতেন কিংবা ভোগ করতে পারতেন জীবনের অগাধ প্রাচুর্য-- তিনি কিনা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে জীবনের অনেকখানি সময়ই বসবাস করলেন কলকাতা থেকে দূরে কখনও ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে, কখনও বা পাগলা গারদে। এরপরও এই বৈরী পরিস্থিতিতে লিখে গেলেন কবিতার পর কবিতা, সাজিয়ে গেলেন পৃথিবীবাসীর উদ্দেশ্যে ভাবনার পিঠে ভাবনা!

তার কবিত্বশক্তি আর চিন্তার অভিনবত্বের দিকে তাকালে মনে পড়ে মধ্যযুগে ইউরোপের প্রচলিত কিছু ধারণার কথা। ওই সময়ে ইউরোপে পাগল কিংবা উন্মাদদের ঐশ্বরিক গুপ্তজ্ঞানের অধিকারী ভাবা হতো। ফলে ওই সময়ের জনগণ একটু বাড়তি শ্রদ্ধা-ভক্তি করতেন তাদের ঈশ্বরের পাগল প্রতিনিধি হিসেবে। তখনকার সমাজে কোনো পাগলাগারদ ছিল না, পাগলরা সাধারণ মানুষের মধ্যেই বাস করতো সম্মানের সাথে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে দেখা চোখে পৃথিবী যত এগিয়ে এল, যুক্তির পৃথিবী থেকে পাগলদের ততই অস্বাভাবিক মনে হতে লাগলো আর তাদের পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো পাগলা গারদে!

কিন্তু বিনয়ের ক্ষেত্রে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তিনি ছিলেন সত্যিই ঈশ্বরের পাগল প্রতিনিধি। যাকে ভদ্র ভাষায় বললে বলতে হয় অসম্ভব প্রতিভাবান একজন মৌলিক কবি ও দার্শনিক। দ্বিধাগ্রস্ত কিছু পন্ডিত হয়ত আমার উচ্চারিত ‘মৌলিক কবি’ ও ‘দার্শনিক’-এ এসে তাদের চোখ আটকে রেখেছেন। আমি এই লেখায় অল্প কথায় এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা করবো তিনি যে নতুন ধরনের কবিতা লিখেছেন, ওই কবিতাগুলি পৃথিবীতে কীভাবে নতুন। তবে এর আগে বিনয় মজুমদারের বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়া প্রসঙ্গে কিছু কথা লিখতে চাই।

১৯৬৭ সালে একবার বিনয় মজুমদার বিনা পাসপোর্টে এসেছিলেন বাংলাদেশে (তখন বাংলাদেশকে বলা হতো পূর্বপাকিস্তান) এবং এখানকার পুলিশ স্টেশনে স্বেচ্ছায় ধরাও দিয়েছিলেন। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে এখানকার জেলে কাটিয়েছিলেন ছয় মাস। ধারণা করা হয়, তার আচরণের ওই দিকটা ছিল জটিল কোনও মানসিক ব্যাধির প্রথমিক লক্ষণ। আমার প্রশ্ন হলো, এভাবে বিনা পাসপোর্টে তার এ দেশে আসাটাকে কি কেবল মানসিক ব্যাধিই বলা ঠিক হবে, নাকি অন্য কোনো বিষয় এর মধ্যে লুকিয়ে ছিল! তার পূর্বপুরুষের শিকড় তো এ দেশের মাটিতেই গাঁথা ছিল। তিনি কি তবে মেনে নিতে পারেননি ধর্মের নামে ব্রিটিশদের চতুর দেশভাগ-নীতি; মেনে নিতে পারেননি নিজের ভাষার দেশে আসার জন্য পাসপোর্ট করার রীতিকে! আমি জানি বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবাংলার অনেকে এখনো এই দেশভাগটাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখে। আজও অনেকেই স্বপ্ন দেখেন সারা বাংলা ভাষাভাষিদের নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের! এমনও অনেক আসাম বা ত্রিপুরাবাসী আছেন যারা বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবতেই ভালোবাসেন। এ দেশে বেড়াতে এলে আবেগাপ্লুত হয়ে এ দেশের মাটিতে চুম্বন করেন। কবি বিনয় মজুমদারের এভাবে বিনা পাসপোর্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পুলিশের কাছে ধরা দেওয়াটাকে আমি ‘রাষ্ট্র’ সম্পর্কে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারণার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ হিসেবেই দেখি। বিনয় মজুমদারের জবানবন্দিতেই বিষয়টা শোনা যাক ‘পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে থাকার সময় একদিন নিজেই হাজির হলাম পুলিশের কাছে। ওদের বললাম, আমাকে আর ভারতবর্ষে ফিরে যেতে বলবেন না। যদি দরকার হয় আমি মুসলমান হয়েই থাকব এইখানে, যেখানে আমার বাবা জন্মেছিলেন।’ (সূত্র: ‘যোগসূত্র’)

মহান চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকও মেনে নিতে পারেননি বাংলা ভাগের বিষয়টাকে। তার এই মেনে নিতে না পারার প্রকাশটা আমরা দেখতে পাই তার প্রায় সব সিনেমাতেই। অকালপ্রয়াত মহান মাতাল চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের সাথে বিনয় মজুমদারের দেখা হয়েছিল পাগলা গারদে। ঋত্বিক ঘটক বিনয় মজুমদারকে ভাবতেন শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি। তিনি ১৯৭১ সালে বিনয় সম্পর্কে লিখিত আকারে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘বিনয় মজুমদার যা লিখেছেন, তাতে তিনি এ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ কবি। কবিতার সমস্ত পঙক্তির অর্থ করা হয়তো অর্থহীন, কিন্তু সামগ্রিকরূপে শেষ পর্যন্ত একটা অর্থে আসতে বাধ্য, যখন কবিতাটিকে পড়ে শেষ করা হবে’।

২.
বিনয় হচ্ছেন সেই কবি, যিনি মিডিয়ার প্রচারের বাইরে থেকেও অনেক জনপ্রিয়তালোভীদের মধ্যে ঈর্ষা জাগিয়ে দুই বাংলাতেই গুরুত্বের সাথে গুপ্তভাবে পঠিত হতে থেকেছেন। জেনে ভালো লাগে যে, ষাটের দশকেই আবুল হাসানের কাছ থেকে নিয়ে আহমদ ছফা প্রথম পড়েন বিনয় মজুমদারের কবিতার বই। আহমদ ছফা ওই বই পড়ে আলোড়িতও হয়েছিলেন। অর্থাৎ বলা চলে প্রথম থেকেই বিনয় ছিলেন তার সমসাময়িক বাংলাদেশের তরুণ কবিদেরও পাঠ্যের তালিকায়। আর আজকের তরুণ কবিদের কাছে তো জীবনানন্দের পর তিনিই সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় কবির আসন দখল করে আছেন।

বিনয় মজুমদারের সমগ্র কবিতার দুটি খ- রয়েছে। রয়েছে আলাদাভাবে শ্রেষ্ঠ কবিতাও। প্রথম খন্ডের মধ্যে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’সহ আরও বেশ কিছু বইয়ের কবিতা। বিনয় বেশি আলোচিত তার এই দুটি কবিতার বইয়ের জন্যই। অনেকের ধারণা, এই দুটিই তার সেরা কাজ। এরপরে যা লিখেছেন তা হচ্ছে এক ধরনের পাগলামি। আর এই পাগলামি বলে পরিচিত কবিতাগুলিই রয়েছে তার কাব্যসমগ্র দ্বিতীয় খন্ডে।
ফলে অনেককেই দেখেছি বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ বই দুটির পরের বইগুলির ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাতে। এই দুটি বই অনেকের মতো আমারও প্রিয় হলেও এ বই দুটিকে আমি বিনয়ের পরিপূর্ণ মৌলিক কবিতার বই বলে মনে করি না। এ দুটি বইয়ের মধ্যে অসংখ্য স্মরণীয় পঙক্তি থাকলেও, আমার মনে হয়েছে এখানে প্রচলিত অর্থে মুগ্ধতায় বুদ করে দেওয়ার মতো কবিতা যতখানি আছে, নতুনত্বের ছোঁয়া ঠিক ততখানি নেই। একজন কবি মহৎ কবির মর্যাদা পান পূর্বসুরিদের ছায়ায় থেকে মনোমুগ্ধকর ভালো কবিতা লেখার জন্য নয়, নতুন ধরনের ভালো কবিতা লেখার জন্যই। বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ হচ্ছে জীবনানন্দীয় ধারার কাছাকাছিই অসাধারণ দুটি বই, যেখানে স্মরণযোগ্য বিনয়সুলভ অসংখ্য পঙক্তি আছে, কিন্তু পরিপূর্ণ বিনয় মজুমদার নেই।

পরিপূর্ণ বিনয়ের দেখা পেয়েছি ‘পাগলামি’ বলে খ্যাত তার কাব্যসমগ্র ২-এর কবিতাগুলির মধ্যে। ওই সমগ্রে পাওয়া যাবে তার প্রায় দশটি কবিতার বই। যেখানে রয়েছে কবিতার নতুন ধারা। অর্থাৎ যে বইগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে পাগলামি মনে হচ্ছে কিন্তু দার্শনিকতায়, নিজস্বতায়, কবিতার আঙ্গিকে, বিষয়বস্তু নির্বাচনে, প্রকাশভঙ্গির সহজতায়, গণিতের প্রয়োগে ওইগুলিই হচ্ছে আমার মতে বিনয়ের শ্রেষ্ঠ কাজ এবং বাংলা কবিতা কেন, বিশ্বকবিতার ক্ষেত্রেই নতুন। এছাড়া বিনয়ের একটি ডায়েরির বইও রয়েছে। ওখানকার বেশ কয়েকটি কবিতা পড়েও মুগ্ধ হয়েছিলাম। তার কাব্যসমগ্র-২ ও ডায়েরি থেকে কিছু কবিতার লাইন বিনা ব্যাখ্যায় নিচে তুলে দিলাম। কেননা কবিতাগুলির প্রকাশভঙ্গি এতটাই স্পষ্ট, কবিতার বিচারে এত রহস্যহীন আর অলংকারহীন যে এখানে কবিতাগুলি অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের কাছে নিজেই নিজের ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির। হাজির আত্মবিলাপরত শিশুর মেধাবী সারল্যে নতুন চিন্তাকে উসকে দিয়ে:

১.
পাখিরা যেসব কাজ করে থাকে
মানুষেরা তা করতে চায়।
পাখিরা ওড়ে-- মানুষও উড়তে চায়।
পাখিরা আকাশ ভালোবাসে
মানুষ আকাশ হতে চায়।
মানুষ কি পাখিদের দুঃখ বোঝে।
মানুষ কি পাখিদের কাছে যেতে পারে।
মানুষের আছে অহংকার-- শিল্পের বাসনা
পাখিদের আছে মুক্ত হাওয়া।
পাখিরা কি মানুষদের কাজ করতে চায়।
পাখিরা পদ্ধতি দেখে মানুষের--
মানুষদের বানানো ঘরবাড়ি দেবতার,
মানুষদের কবরখানা চিতার আগুন।
মানুষ কলতলায় দাঁত মাজে।
পাখিদের সমাজে এ দাঁত-মাজা আচরণ নেই
দাঁত-মাজা ব্যাপারটা তাই পাখির অজানা।

(পাখি ও মানুষ : বিনয় মজুমদারের ডায়েরি থেকে)

২.
যে সব উদ্ভিদ, তরুলতা, আনাজ
ইত্যাদি আমরা প্রাণীরা খাই সেইসব
খাদ্যগুলি গাছ থেকে কাটবার কালে,
ছিঁড়বার কালে গাছ ব্যথা পেতে পারে।
সুতরাং আমাদের খাদ্য উদ্ভিদ-এর ফল, লতা
আমাদের নখের মতো করলেই হয়।

(যে সব উদ্ভিদ : কাব্যসমগ্র-২)

৩.
মানুষের গায়ে এক কেজি মাংস হতে লাগে পুরো
আট কেজি চাল ধরা যাক।
আট কেজি চাল পেতে বত্রিশ টাকা লাগে, মানে
মানুষের শরীরে এক কেজি মাংস গায়ে থাকা অবস্থায়
মূল্য হল বত্রিশ টাকা
(মাংসের দাম : কাব্যসমগ্র-২)

৪.
যত দিন ডাব গাছে থাকে
ততদিন ডাবের জলের প্রাণ আছে
যতদিন কমলালেবু গাছে থাকে
ততদিন কমলালেবুর রসে প্রাণ আছে।

(যতদিন গাছে থাকে : কাব্যসমগ্র-২)

৫.
পৃথিবীর ঘাস, মাটি, মানুষ, পশু ও পাখি-- সবার জীবনী লেখা হলে
আমার একার আর আলাদা জীবনী লেখা না-হলেও চ’লে যেতো বেশ।
আমার সকল ব্যথা প্রস্তাব প্রয়াস তবু সবই লিপিবদ্ধ থেকে যেতো।
তার মানে মানুষের, বস্তুদের, প্রাণীদের জীবন প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক
অসংখ্য জীবন নয়, সব একত্রিত হয়ে একটি জীবন মোটে; ফলে
আমি যে আলেখ্য আঁকি তা বিশ্বের সকলের যৌথ সৃষ্টি এই সব ছবি।
(এ জীবন : কাব্যসমগ্র-২)

৬.
মানুষের খাদ্য সব প্রকৃতিতে আপনিই হয়--
ধান গম শাক কচু প্রভৃতি প্রকৃতি থেকে পাই।
মানুষের খাদ্য সব প্রকৃতিতে আপনিই হয়।
তবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের কিছু কাজ যুক্ত হয়ে যায়--
যেমন ধানের গাছ পঙক্তিতে পঙক্তিতে রুয়ে দেয়
মানুষেরা ধান ক্ষেতে জল দেয়-- এইভাবে বিশ্বের প্রকৃতি
এবং মানুষ মিলে তবে খাদ্যশস্য পাই প্রকৃতি থেকেই।

এইসব খাদ্যদ্রব্য-- ভাত রুটি সুক্তো ডাল ভাজা
আহার করার পরে কিয়দংশ শরীরের মাংস রক্ত হয়।
এই অবিস্মরণীয় খাদ্য দেহে থেকে যায় মৃত্যু অবধিই
মাংস রূপে অস্থি মজ্জা রূপে।
মাঝে মাঝে মনে পড়ে এইসব চিরায়ত খাদ্যসমূহকে।
( মানুষের খাদ্য : কাব্যসমগ্র-২)

আমার মনে হয়েছে বিনয় কবিতায় গণিতের জ্যামিতিক ফর্মুলা ব্যবহার করেছেন। আমাদের আশপাশের পরিচিত কোনো বিষয় ও বস্তুর দিকে খুব সাধারণ দৃষ্টিতে না তাকিয়ে, একজন বিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিকের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন তিনি। পরিচিত দৃশ্যের অচেনা অংশটুকুকে আবিষ্কার করে নিজের কাছে নিজেই দার্শনিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিলেন। এবং এর উত্তরের খোঁজে বের হয়ে তিনি ওই পরিচিত বিষয়টার মধ্য থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছিলেন।

আমরা জানি, একই পৃথিবীতে আমরা মানুষেরা যেমন বসবাস করছি তেমনি আমাদের সাথে বাস করছে অসংখ্য গাছ-পশু-পাখি এবং প্রাণীও। কিন্তু এই পৃথিবী সম্পর্কে এই ভিন্ন প্রাণীদের ভাবনা কি এই বিষয়টা আমরা কখনও ভাবি না, কিন্তু বিনয় ভেবেছিলেন। তিনি নিজেকে এইসব প্রাণীজগত থেকে জীবন-যাপন এবং চিন্তায় কখনও আলাদা করে ভাবেননি। যে কারণে এই পৃথিবীকে কখনো পাখির দৃষ্টি দিয়ে, কখনও গাছের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কিংবা কখনও জড়বস্তুর জায়গা থেকে দেখেছেন।

বিজ্ঞানীদের কল্যাণে আমরা জেনেছি, মানুষেরা খালি চোখে যে সমস্ত বস্তু দেখে এবং দেখে দেখে বিশ্লেষণ করে তার মধ্যে বিশাল ঘাপলা থাকতে পারে। প্রতিবেশী প্রাণীদের চোখ দিয়ে দেখেও যে পৃথিবীর অনেক কিছুর ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে এটা আমরা কখনও ভাবি না। যেমন মৌমাছি পৃথিবীর সমস্ত কিছুকেই দেখে বেগুনি রঙের; গরুর চোখে সবই সাদা-কালো, মুরগি আকাশের চাঁদটাকে গোল নয় দেখে চারকোনা। এখন পৃথিবীকে বেগুনি রঙের দেখা চোখে নিশ্চয়ই মৌমাছির দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেয়ে ভিন্ন রকমের, যে সবুজ ঘাস দেখে আমরা মাঝে মাঝে মুগ্ধ হই-- সারা জীবন তার মধ্যে থেকেও একটা গরু নিশ্চয়ই ওই সবুজটাকে বুঝতে পারে না! তার কাছে আমপাতার সবুজ আর জামপাতার সবুজের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আবার যে গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে মা তার শিশুকে ঘুম পাড়ায়, সেই চাঁদটাকে যদি মুরগির দৃষ্টির মতো হঠাৎ দেখতে পাই চারকোনা নিশ্চয়ই আমাদের প্রতিক্রিয়াটা হবে ভিন্ন রকমের।

আমার মনে হয়েছে বিনয় মজুমদার কখনো কখনো গাণিতিক নিয়মে এইসব বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতা কবিতায় আনতে চেয়েছেন। যে কারণে পাখির দৃষ্টিতে দেখা মানুষের ঘরবাড়িসহ দাঁত মাজার প্রসঙ্গও হয়ে যায় তার কবিতার বিষয়। তার ভাবনার বিষয় ডাবের পানির প্রাণ আছে কি নেই এইসব। তার ভাবনার বিষয় হয় গাছ থেকে ফল ছিঁড়লে গাছ ব্যথা পায় কিনা-- তিনি লক্ষ করেন চুল কাটলে কিংবা নখ কাটলে মানুষ ব্যথা পায় না। তিনি লক্ষ করেন প্রকৃতির সাথে মানুষের কাজ মিশে কীভাবে তা প্রকৃতির অংশ হয়ে যায়।

এই যে তার কবিতায় এভাবে তুচ্ছ একটি বিষয়কে ধরে গভীর কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা, আমার মনে হয় না বিনয়ের আগে কেউ এ কাজটি কবিতায় অন্তত করেছেন। আর এই কারণে মনে হয়েছে বিনয় কাব্যসমগ্র ২-এ এসে একজন সম্পূর্ণ মৌলিক কবি। এক্ষেত্রে তার কোনও উত্তরসূরি থাকলেও পূর্বসূরি নেই!
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×