সেলিম সাহেবকে আজকে বেশ অস্থির মনে হচ্ছে। এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি তাকে। তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে জীবনে অর্জিত সবকিছুই যেন একনিমিশে হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। উনার মত হাসিখুসি প্রানচ্ছল মানুষ খুজে পাওয়া খুবই কঠিন; উনার কথাবার্তা আর অঙ্গভঙ্গির সাথে মুখে একফোটা হাসির ঝলক না থাকলে বড়ই বেমানান লাগে তাকে। সেলিম সাহেব চাকুরী করেন একটি বহুজাতিক কোম্পানীতে, ভালো বেতন তার, অফিস থেকেই গাড়ী বাড়ী পেয়েছেন, বছর তিনেক আগে অনিন্দ সুন্দরী এক মেয়েকে বিয়েও করেছেন, একজন পুরুষের জীবনে আর কি লাগে? অল্প সময়ের মাঝেই অনেক কিছু পেয়ে গেছেন তাই হয়ত তার মত সুখি মানুষ আর নেই। কিন্তু আজ কি হয়েছে তার? মুখটা এমন গম্ভীর কেন?
আজ সকালে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করছেন তিনি। তার স্রীর নাম লুবনা। একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করেন তিনি। দেখতে চরম সুন্দরী, বাংলাদেশের দু চারটা মডেলের চেয়ে কোন অংশে কম যান না তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মডেলিঙও করেছেন কিছুদিন, বিয়ে হবার পর বাদ দিয়েছেন এইসব। এখন পর্যন্ত কোন ছেলেমেয়ে নেই সেলিম-লুবনার। দুজনে থাকেন ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের একটি ফ্লাট বাড়িতে।
আজকে সকালে ঝগড়ার সুত্রপাত একটি ক্ষুদ্র বিষয়কে কেন্দ্র করে হলেও পরে তা বিশাল পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আজকে সকালে সেলিম সাহেবের বসের সাথে মিটিং, তাই খুব সকালে উঠে প্রস্তুত হয়ে বসে আছেন তিনি। কিন্তু কাজের বুয়া ঘুম থেকে ঊঠতে দেরি করায় নাস্তা দিতেও দেরী করে ফেলছে। অন্যদিন দেরী করলে কোন সমস্যা হয় না কিন্তু আজকের দেরীটা তার সহ্য হচ্ছে না তার। তাই তিনি রেগে গিয়ে কাজের বুয়াকে দিলেন একটা ধমক। লুবনা পাশেই ছিলেন, তিনি বললেন ওকে ধমক দিচ্ছ কেন? দেরী তো হতেই পারে , ওরাও তো মানুষ যন্ত্রতো আর না। সেলিম সাহেব বললেন, তাই বলে আজকেই কেন, আজকে বসের সাথে মিটিং দেরী হলে সমস্যা হবে। লুবনা বললেন, দেরী যদি হয়ই তাহলে না খেয়েই চলে যাও, প্রতিদিনই যে খেতে হবে এমনত কোন কথা নেই, তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই তো তোমার না খাওয়ার অভ্যাস আছে। লুবনার শেষ কথাটা খুব গায়ে লাগল সেলিম সাহেবের, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন তিনি, তার মা তাদের চার ভাইবোনকে একাই মানুষ করেছেন। খুবই অভাবের সংসার ছিলো তাদের, অনেক সময় না খেয়েই থাকতে হয়েছে তাকে। অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন, এতদুর পর্যন্ত এসেছেন। তাই হয়তো অভাবের দিনগুলোর কথা মনে রাখতে চাননা তিনি। কেউ ঐ ব্যাপারে কিছু বললে তার সহ্য হয় না, তাই তিনি লুবনাকে ধমকের স্বরে কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। লুবনাও কম যান না শুরু হয়ে গেলো তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার এক পর্যায়ে চলে আসলো মুহিনের কথা। মুহিন লুবনার বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মুহিনের সাথে লুবনার অন্তরঙ্গ প্রেম ছিল। সমবয়সী বলেই হয়ত টেকেনি তাদের প্রেম। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বিয়ের বয়সটা আগেই চলে আসে, আর ছেলেদের বিয়ে করার আগে ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে হয় কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকাংশে তা প্রজয্য নয়। তাই সমবয়সী প্রেমের পরিনতি বেশিরভাগ সময়ই সুখকর হয় না। লুবনা যে ফার্মে চাকুরী করে কিছুদিন আগে মুহিনও সেখানে যোগ দিয়েছে। সবাই জানে তারা দুজন খুব ভালো বন্ধু। সেলিম সাহেব মুহিনকে নিয়ে কথা বলায় লুবনা অনেক বেশী ক্ষেপে গেলেন। বললেন, বাবা মা তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে আমার জীবনটা নষ্ট করেছেন, তুমি তো একটা রোবট, মুহিন তোমার চেয়ে অনেক ভালো। এই কথা বলে লুবনা ভেতরের ঘরে চলে গেল। সেলিম সাহেব না খেয়েই অফিসে চলে আসলেন। অফিসে আসতে দেরি হওয়ায় বসের ঝাড়িও হজম করতে হলো তাকে। অফিস থেকে যে পরিমান সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়, সেই অনুযায়ী খাটিয়েও নেয়া হয় তাকে দিয়ে, আর দেরি করলে বসের ঝাড়ি তো আছেই।
ইদানিং মুহিনের সাথে লুবনার মিথষ্ক্রিয়া অনেক বেড়েছে। মুহিনের বাসাও ধানমন্ডিতে, সকালে অফিস যাবার সময় দুজনে একসাথেই যান। আগে সেলিম সাহেব লুবনাকে অফিসে পৌছে দিয়ে নিজে অফিসে যেতেন, লুবনার অফিস বনানীতে আর সেলিম সাহেবের গুলশান ২ তে, তাই কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু সেলিম সাহেবের অফিস মতিঝিলে চলে যাওয়ায় এখন আর লুবনাকে দিয়ে আসতে পারেন না তিনি। তাই মুহিনের সাথে যাওয়া আসার ব্যাপারে কিছু বলেন না তিনি। তবে ইদানিং বন্ধের দিনেও মুহিনের সাথে বাইরে বের হওয়াটা ভাল লাগে না তার। অফিস থেকে ফিরতেও ইদানিং দেরি করে সে। নিজেও স্ত্রীকে খুব বেশি সময় দিতে পারেন না তাই কিছু বলেননা তিনি।
আজ শুক্রবার, কিন্তু তবুও অফিসে আসতে হয়েছে সেলিম সাহেবকে। কারণটা সহজ, বহুজাতীক কোম্পানীগুলোর সাপ্তাহিক ছুটি রবিবারে হয় সাধারনত। লুবনার অফিস আজকে বন্ধ। সেলিম সাহেব চিন্তা করলেন অনেক দিন হলো লুবনাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না, সাপ্তাহিক ছুটিটাও মেলেনা তাদের। তাই আজকে তিনি অফিস থেকে বেড়িয়ে পরলেন দুপুরেই। লুবনাকে কয়েকবার ফোন দেবার পরেও ধরল না সে। সেলিম সাহেব ভাবলেন সকালে ঝগড়া হওয়াতে রাগ করে ফোন ধরছে না সে। তাই তিনি সরাসরি বাসায় চলে আসলেন। এসে দেখলেন বাসার নিচে মুহিনের গাড়ী। গাড়ী দেখে সেলিম সাহেবের হৃৎকম্প বেরে গেলো। দরজায় এসে টোকা দিতেই কাজের বুয়া দরলা খুলল। সেলিম সাহেব ভেতরে ঢুকেই দেখলেন তাদের বেডরুম আটকানো। আর কিছুই বোঝার বাকি থাকল না সেলিম সাহেবের। শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মাথার ঊঠে গেল তার। রাগে সমস্ত শরীরে যেন আগুন ধরে গেল। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে পাগলের মত দরজায় নক করতে থাকলেন।কিছুক্ষন পর দরজা খুলে খু দ্রুত গতিতে বেড়িয়ে গেল মুহিন। সেলিম সাহেব হচকচিয়ে ঘরে ঢোকার পর যা ঘটল তা অসভ্য জগতকেও হার মানিয়ে দেয়।
লুবনা এখন হাসপাতালে, তার শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষতের চিহ্ন। নাকের দিক থেকে কিছু মাংস ঊঠে গেছে, একটা চোখের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। সেলিম সাহেব পলাতক, পুলিশ তাকে খুজছে। নারী নির্জাতনের মামলা বলে কথা, ধরা পড়লে নিশ্চিত যাবজ্জিবন কারাদণ্ড। সেলিম সাহেবের খবর কেউ জানে না, হয়ত বাংলার কোন অজপাড়াগায়ে ধানক্ষেত বা কাশবনের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছেন তিনি। আর হয়ত ভাবছেন, নাড়ী নির্যাতনের জন্য মামলা হয়, অথচ যুগে যুগে শত শত পুরুষ যে মানুষিকভাবে নারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয় তার খবর কেউ রাখে না।
বি দ্রঃ এই গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক, কারো সাথে সম্পুর্ন বা আংশিক মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়।