somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ না হয়ে পাখি হলে, মুরাদ হয়তো বেঁচে যেতো

০২ রা জানুয়ারি, ২০১২ দুপুর ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আজকে মুরাদের জন্য শোকযাত্রা ছিলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শোকযাত্রার প্রথম কাতারটা যখন পুরাতন কলা ভবন ছুঁয়ে ফিরে আসছিলো, কাতরের শেষ লোকটা তখন কেবল মেডিকেলের সামনের রাস্তায় ছিলো। মাঝখানের জায়গাটা যদি আপনি হেঁটে পার হন তাহলে কমপক্ষে পাঁচ থেকে সাত মিনিট লাগবে। সবাই এসেছিলো মুরাদকে ভালোবেসে। কাউকে হলের গেট আটকে জোর করে আনা হয়নি, কাউকে আগে থেকে বলা হয়নি। সবাই মুখে মুখে জেনেছে, নিজের ইচ্ছায় এসেছে।

ভূমিকাটা দিলাম, কারন ক্যাম্পাসের অনেকেই কিংবা ক্যাম্পাসের বাইরে যারা পত্রিকা পড়ে ভাবছেন ছেলেটা নেশাগ্রস্ত ছিলো, হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছে, তাদের ভুলটা যেন ভাঙে। মুরাদের কি হয়েছিলো, কেন হয়েছিলো সেটা শুধু মুরাদ আর সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আমরা শুধু দুটো ধারনা করতে পারি, দূর্ঘটনা নয়তো আত্মহত্যা।

আমি বিশ্বাস করি এটা দূর্ঘটনা। মুরাদ আত্মহত্যার করার মতো ছেলে না। যে ছেলেটা তার জীবনের বড় একটা অংশ ক্যাডেট কলেজে কাটিয়েছে, যে মৃত্যুর আগের দিন এক্সিম ব্যাংকের পরীক্ষা দিয়েছে, যে আইবিএ এ্যাডমিশন নিয়ে ভাবছিলো, জাহাঙ্গীরনগর থেকে যে ছেলেটা এই সেদিন ইংরেজিতে অনার্স শেষ করলো সে বলা নেই, কওয়া নেই ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে?? আর এমন একটা জায়গা থেকেই লাফ দেবে যেখানটা উঁচু গাছে ভরা?? মুরাদ কি জানতো ছাদের ট্যাংকির উপর থেকে লাফ দিলে পাম গাছটাতে লেগে ওর শরীরটা উল্টে যাবে আর ঠিক মাথাটাই শুধু ইটের রাস্তার উপর পড়ে অমন বীভৎস ভাবে থেতলে যাবে?? এত কিছু মেপে কি মুরাদ আত্মহত্যার জন্য লাফ দিয়েছিলো?

না। মুরাদ পড়ে গিয়েছিলো। হলের ছাদটা ভীষণ প্রিয় ছিলো ওর। ছাদে রুম থাকলে মুরাদ ঐ রুমটাই নিতো। প্রতিদিনের মত বিকেলে ফোনে কথা বলতে বলতে ছাদে চলে গিয়েছিলো। যে জায়গাটা দিয়ে ও প্রতিদিন ওঠে, সেখান থেকে উঠেই হয়তো আকাশটা দেখার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু কে জানতো ওখানে উঠতে উঠতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া ওর পা দুটো এভাবে ভুল করবে। আমার বারান্দা থেকে ট্যাংকির ঐ জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়। সেদিন দেখলাম একটা পাখি হেঁটে হেঁটে এসে কিনার থেকে উড়ে চলে গেলো। তখনই মুরাদের কথা মনে পড়লো। তখনই মনে হলো মানুষ না হয়ে পাখি হলে মুরাদ হয়তো মরতো না, পা দুটো পিছলে গেলেও ডানায় ভর করে উড়ে আসতো ৪৩১ নম্বর রুমে, ওর রুমে।

আমি নেশা করিনা। ক্যাম্পাসের পাঁচ বছর অনেক বন্ধু এটা শুনে অবাক হয়েছে। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার। মুরাদের মৃত্যুকে যারা আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তাদের বলি, ফার্ষ্ট ইয়ারে যখন আমাদের থাকার রুম ছিলো না, সবাই একসাথে গনরুমে (লাইব্রেরি, সংসদ, গেস্টরুম) থাকতাম তখন থেকে আমি মুরাদকে চিনি। মুরাদকে আমি কখনো সিগারেট হাতে দেখিনি, গিটার হাতে দেখেছি।

আর ফেইসবুকে ওর শেষ স্ট্যাটাসটার কথা বলবেন তো?

Maut Pe Bhi Mujhe Yakeen Hai,
Tum Per Bhi Aitabar Hai;
Dekhna Hai Pehle Kaun Aata Hai,
Humein Dono Ka Intizar Hai . . . !

এটাকে আমি কাকতালীয় ব্যপারই বলবো। অথবা এটা ওর প্রিয় লাইন ছিলো। জেমসের এপিটাফ গানটাও তো আমার প্রিয়। হঠ্যাৎ দুপুরে গানটা শুনে যদি স্ট্যাটাস দেই, ‘মনে রেখো কেবল একজন ছিলো, ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের’, আর পরদিন যদি মরে যাই হুট করে, তাহলে কি মানে দাড়ায়? আমি আত্মহত্যা করেছি??

গতকাল মুরাদের জন্মদিন ছিলো। দুপুরে গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে মুরাদকে দাফন করা হয়েছে। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। আমরা যখন শোকযাত্রা নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটছি নি:শব্দে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। নতুন কলা ভবনে আসতে আসতে বৃষ্টির বেগ বেড়ে গিয়েছিলো খানিকটা। কিন্তু একটা মানুষও তাড়াহুড়ো করে শোকযাত্রা থেকে সরে যাননি। শীতের সকালে বৃষ্টিতে ভিজেই আমরা আমাদের ভাই, বন্ধুটার কথা মনে করেছি, যার লাশ টাঙ্গাইল নিয়ে যাবার জন্য প্রশাসন প্রথমে অ্যাম্বুলেন্স দিতে চায়নি।

আমরা ক্যাম্পাসের ৩৬তম ব্যাচ। মুরাদ আমাদের বন্ধু। আমাদের ব্যাচের সবারই অনার্স শেষ, মাস্টার্স চলছে। কেউ কেউ চাকরি করছে। আমরা বড়জোর আর এক বছর আছি ক্যাম্পাসে। আমরা চলে গেলেই হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া মুরাদকে আর কেউ মনে রাখবেনা। মনে রাখবেনা পহেলা জানুয়ারি মুরাদের জন্মদিন ছিলো আর ৩১শে ডিসেম্বর বিকেলে সে ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলো।

তাই আমরা মুরাদের জন্য কিছু করতে চাই। হলের সামনে একটা কিছু করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। নতুন কলা ভবনের পাশের চা খাওয়ার যে দোকানগুলো আছে সেখানেই মুরাদ আড্ডা দিতো। সেখানে আমরা একটা ‘M’ আকৃতির বসার জায়গা করতে চাই যার মাঝখান জুড়ে থাকবে একটা গিটার। অামরা চলে গেলে জুনিয়ররা সেখানে আড্ডা দেবে আর অপেক্ষায় থাকবে কখন মুরাদ এসে গিটারটা হাতে নিয়ে একটা গান ধরবে।

আমরা আজকেই কলা ও মানবিকী অনুষদের ডীন বরাবর আবেদন করেছি অনুমতির জন্য। অনুমতি পাই না পাই আমরা কাজ শুরু করতে চাই। আজকে শোকযাত্রা শেষে হাতে হাতেই ছত্রিশের বন্ধূরা ১২০০ টাকা উঠিয়ে ফেলেছি। টাকা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। মুরাদকে ভালোবেসে বড় ভাইবোনরা, ছোট ভাইবোনরা এগিয়ে আসবে এটা আমরা জানি।

আমরা শুধু চাই মুরাদকে যেন কেউ নেশাগ্রস্ত না বলে, মুরাদের মৃত্যুকে যেন কেউ আত্মহত্যা না বলে। দূর্ঘটনা এবং আত্মহত্যার মাঝে আমরা যেন দুর্ঘটনাকেই মেনে নেই।

আমার কোন লেখা আমি শেয়ার করতে বলিনা। কিন্তু এই লেখাটার কথা বলছি। কারন আমরা চাই মানুষ জানুক, মুরাদ একটা ভালো ছেলে ছিলো। ও আমাদের বন্ধু, ও আমাদের ভাই। এই কথাটা সবাইকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ।

আজ যে ছেলেটার জন্মদিন, সে কাল বিকেলে ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে, সে আমাদের বন্ধু ছিলো
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×