somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কবিতারা বেঁচে থাকে ভালবাসায়

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কবিতা সংক্রান্ত আমার অভিজ্ঞতাগুলো তেমন ভাল না। ক্লাস এইটে থাকতে একবার বাংলার হামিদা ম্যাডাম ক্লাসের মাঝে আমাকে ডেকে বললেন কবিতা আবৃত্তি করতে।হামিদা ম্যাডামকে আমরা সবাই অসম্ভব ভয় পেতাম।ম্যাডামকে পিছনে পিছনে আমরা কাউয়্যা-ম্যাডাম বলে ডাকতাম।এই মহিলার মত কর্কশ কন্ঠ আমি আর কোথাও শুনিনি। ম্যাডাম যখন তার বেটে-খাটো বিশাল শরীরটা নিয়ে স্কুলের ভিতর ঢুকতেন তখন আমরা সবাই দিগ্বিক পাগলের মত ছুটতাম। কারণ,ম্যাডামের সামনে পড়ে গেলে তিনি কখন যে কোন ইস্যু নিয়ে চড় মেরে বসবেন তা কেউ ধারণাও করতে পারবে না। আর সেটা শুধু চড় হলেও কথা ছিল,সাথে থাকবে অশ্রাব্য গালি! একজন স্কুল শিক্ষিকার মুখে সেইসব গালি মানায় না। তাও ম্যাডাম গালি দিয়ে আনন্দ পেতেন। একবার আমি চুলে সাদা ফিতা বেধে যাইনি দেখে ম্যাডামের হাতে পড়ে গেলাম। ম্যাডাম আমাকে সামনে পেয়ে কষিয়ে দুই গালে দুইটা থাপ্পর মেরে বললেন, “ঐ চুলে ফিতা না বাইন্দা স্টাইল মারাইয়া রাস্তা দিয়া হাইট্টা আইছিস ক্যান? রাস্তায় তোর নাগর খাড়াইয়া ছিল?”
আমি ম্যাডামের হাতে থাপ্পর খেয়ে যত না কষ্ট পেলাম,তার থেকে বেশী কষ্ট পেলাম ম্যাডামের মুখে ঐ জঘন্য কথা শুনে।যাই হোক,ধান ভানতে এসে শিবের গীত শুরু করলে হবে না।আমি বরং কবিতা নিয়ে আমার অরুচির কারণটা ব্যাখ্যা করি।
আমি এমনিতেই হামিদা ম্যাডামকে ভয় পেতাম।তার উপর তিনি যখন ক্লাসে কবিতা আবৃত্তি করতে বললেন-তখন আমার আত্মা খাচা ছাড়া হওয়ার অবস্থা।আমি তোতলাতে তোতলাতে কবিতা আবৃত্তি করা শুরু করলাম।আবৃত্তি করেছি বললে ভুল হবে।আমি রিডিং পড়ছিলাম।হঠাৎ মাঝপথে হামিদা ম্যাডাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে কান আচ্ছা করে মলে দিয়ে বললেন-“তুই তোতলা নাকি? যাহ,তোর পড়া লাগবে না।”
ক্লাসে হাসির রোল পড়ে গেল।এর পর ক্লাসের সবাই আমাকে তোতলা-তিতির টাইটেল দিয়ে দিল।সেই টাইটেল সাথে নিয়েই আমাকে স্কুল ছাড়লাম। ওটাই যে আমার কবিতা পছন্দ না করার একমাত্র কারণ তা না।
ভারসিটির শুরুর দিকে আমার পিছনে আশিক নামে এক সিনিওর ঘুরতো। তিনি নাকি আবার কবিতা লেখেন। কোনো কিছু বলার সাহস পেত না। শুধু প্রতিদিন ফেসবুকে বসলেই কবিতা ইনবক্স করে। কবিতা না বলে সেগুলোকে আসলে গবিতা বলাই শ্রেয়। ভদ্রতার খাতিরে কবিতাগুলোর প্রশংসা করতে হত। দেখা যেত বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারছি,এমন সময় সেই কোথা থেকে সেই আশিক-কবি উপস্থিত হয়ে একটা কবিতা হাতে ধরিয়ে বলতেন, “তিতির,নতুন আরেকটা কবিতা লিখছি।একটু পইড়া দেইখো তো কেমন হইল!”
আমি পড়লাম এক মহাফ্যাসাদে!ভদ্রতার খাতিরে আমি সেই কবিকে না পারি কিছু বলতে, না পারি তার কবিতার যন্ত্রণা সহ্য করতে! আমার বন্ধুরাও আবার সেই কবির সাথে আমাকে জড়িয়ে নানা ধরনের ফাজলামী করে। আমি বলতে গেলে সেই কবির উপর ত্যাক্ত।
একদিন আমি আর আমার ক্লাসমেট সোয়েব সেমিনার রুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে আশিক-কবি এসে উপস্থিত। আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল , “তিতির একটা কবিতা লিখছি।প্রেমের কবিতা। নাম পীড়িতের আগুন। কবিতাটা তোমারে উৎসর্গ করছি।পইড়ো।”
-কবিতা কাকে উৎসর্গ করছেন?
-তোমারে!
-ক্যান?আমারে ক্যান?
-এমনেই।
কথাটা বলেই আশিক কবি সেমিনার রুম থেকে বের হয়ে যাওয়া শুরু করল। আমি তাকে পিছন থেকে ডাক দিলাম।
-আশিক ভাই,দাড়ান।একটা কথা শুইনা যান।
-কি?
-আপনে কি জানেন যে আপনি যা লিখেন তা আসলে কিছুই হয় না?
-মানে?
-মানে কি আপনে বুঝেন না, না?কি সব অখাদ্য-কুখাদ্য লেখেন!সেইটা আবার আমারে দিয়া পড়ান। তাও না হয় এতদিন সহ্য করছি। এখন আবার আপনে এইসব অখাদ্য আমার নামে উৎসর্গ করা শুরু করছেন। খবরদার আর জীবনে কোনোদিন এইসব কবিতা নিয়া আসবেন না।

আমার কথায় অপমানিত হয়ে আশিক কবি চলে গেল। আমি নিজেও চরম রাগ-রাগ চেহারা নিয়ে বসে পড়লাম।
“বেচারাকে খুব বেশী অপমান করলিরে।এতটা অপমান না করলেও পারতি!”-পাশ থেকে শোয়েবের মুখে এই কথা শুনে আমার আরো রাগ লাগল।
আমি বললাম, “আমার জায়গায় থাকলে তুই বুঝতি। আর তোর এত মায়া মায়া থাকলে তুই গিয়ে ওর কবিতা শোন। আমার অত কবিতার জ্ঞান নাই।”
-মাথা গরম করিস না তিতির।বেচারা হয়তো তোকে পছন্দ করত বলেই তোকে কবিতা দিত।দেখ হয়তো ওর সব কবিতা তোকে নিয়েই লেখা।একজন মানুষ তোকে নিয়ে কবিতা লিখছে,তোকে উৎসর্গ করছে-এতে দোষের কি আছে?
-দেখ শোয়েব আমি অত কবিতা বুঝিনা।কবিদের দেখলেও আমার মেজাজ খারাপ হয়। যতসব অবাস্তব চিন্তা ভাবনার লোক!
-কে বলেছে তোকে এই সব কথা?
-কেউ বলেনাই।যুক্তিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কবি হওয়া যেমন শক্ত,কবিদের পক্ষে ততোধিক শক্ত যুক্তিসম্পন্ন মানুষ হওয়া!-এইটা সবাই জানে।
শোয়েব আর কোনো কথা বলল না। কেবল একটা কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে গেল। উঠে যাওয়ার সময় বলল, “ করুনা কর তোমাদের এই হতভাগ্য কবিকে।

কবিতার লাইনটা শুনে আমি বুঝলাম আমি ধরা পড়ে গিয়েছি। আমি যতই বলি,আমি কবিতা ভালবাসিনা,আসলে যে আমি বেশ কবিতার খোজ রাখি তা শোয়েব কবিদের ব্যাপারে আমার শেষ মন্তব্যটা শুনেই বুঝে ফেলেছে। ঐ লাইনটা আসলে আমি পাবলো নেরুদার কাছ থেকে ধার করেছিলাম। পাবলো নেরুদাই বলেছিলেন কবিরা যুক্তির ধার ধারে না!

আমি সেমিনার রুম থেকে উঠে ক্লাসে যাই। ক্লাসে শোয়েব নেই। ও ক্লাস করতে আসেনি। ক্লাস শেষ করে শোয়েবের খোজ করতে গিয়ে দেখি ও লাইব্রেরীর পিছনের পুকুর পাড়ে বসে আছে।
আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম।আমার দিকে না তাকিয়ে শোয়েব বলল, “ তিতির, পাবলো নেরুদার কোন কথাটা তোর সবচেয়ে পছন্দের?”
আমি খানিকটা চুপ করে থেকে বললাম, “বিড়ালের জীবনের মতোই কঠিন প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ কবিতারও মৃত্যু নেই। কবিতাকে হয়রানী করে রাস্তায় টেনে নিয়ে আসে-থুতু ছিটিয়ে মশকরা করে-নির্বাসনে পাঠায়-জেলে ভরে রাখে-সিসার গুলি চালিয়ে জখম করে-তবু সে মরে না,সে তার সুন্দর মুখে দিগন্তজোড়া নবান্নের হাসি নিয়ে বেচে থাকে।”

শোয়েব আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
আমি শোয়েবকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই কবিতা লিখিস?”
-যদি বলি হ্যা,তাহলে তো তুই বলবি আমার বাস্তব জ্ঞান নাই।”
-খোচা দিয়ে কথা বলিস কেন সব সময়?
-যাহ,আর তোকে কোনোদিন খোচা মারব না।এই ডায়রীটা রাখ।
কথাটা বলতে বলতে শোয়েব ওর ব্যাগ থেকে ছোট একটা বাদামী রঙের কভার দেয়া ডায়েরী বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়।
-এটা তোর কবিতার খাতা নাকি?
-কবিতার খাতাও বলতে পারিস আবার এক কবিতা বিদ্বেষীর মুখোশের আড়ালে থাকা কবিতাপ্রেমীকে নিয়ে বন্দনাও বলতে পারিস।
আমি অবাক হয়ে শোয়েবের মুখের দিকে তাকাই। ও উঠে চলে যাচ্ছে। এই মানুষটা আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে এ আমার কল্পনার বাইরে। কতদিন ধরে ভেবেছি শোয়েবকে আমার মনের কথাগুলো খুলে বলব। লজ্জায়-ভয়ে বলতে পারিনি। অথচ কি আশ্চর্য,একবারও বুঝতে পারিনি শোয়েব নিজেও তাই চেয়েছে!
আমি পিছন ফিরে দেখি শোয়েব অনেকখানি দূরে চলে গিয়েছে। আমি চটপট উঠে শোয়েবের কাছে ছুটতে শুরু করলাম। কবিতা নাহয় পরেও পড়া যাবে,আগে কবির আঙ্গুলটা গিয়ে ধরি যেন কবি হারিয়ে না যায়!




সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১২:৫৫
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×