এক.
অবশেষে হাইকোর্ট মাজারের বটতলায় মাথা গুজার ঠাই মিলেছে আলতার। ঢাকা শহরে এই একটি একটিমাত্র জায়গাই তার জন্য উন্মুক্ত, যেখানে সে একটু বুকভরে নি:শ্বাস নিতে পারে, রাতের আধাঁরে বটতলার গানের সুরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চোখের জল ফেলতে পারে।
আলতা বানুর বয়স হয়েছে। জন্ম তারিখ, সন এসব কিছুই সঠিক জানে না আলতা। সবগুলো চুল পেকে সাদা হয়েছে। একটিমাত্র দাঁত ছাড়া বাকিগুলো হারিয়েছে অনেক আগেই। এক পলক দেখামাত্র যে কেউই একবাক্যে বলে দিতে পারে, তার চোখের নীচে বয়সের বলিরেখাগুলো এখন আর কোন এইজ-মিরাকল ক্রিম দিয়েও লুকিয়ে রাখা সম্ভব না।
অবশ্য, একসময় বেশ ‘সুন্দরী’ ছিল আলতা । চোখের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। ছোট্ট একটা সংসারও ছিল। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই ৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধ প্রথম স্বামী এয়াকুবকে কেড়ে নিয়েছে। সে ঘরে কোন সন্তান ছিল না। এয়াকুবের কথা ভেবে আজও রোমাঞ্জিত হয় আলতা। সুঠাম দেহের সুপুরুষ ছিল এয়াকুব। মলিন চোখে ভেসে উঠে ঠুকরো ঠুকরো স্মৃতিগুলো... ... ...
আলতা বলে, “হের মতন জোয়ান পুরুষ... ... ... ওরে আল্লাহ! হে আ- রে বউত মহাব্বত কইরত। এত্ত ভালবাসা আ-রে ( আমাকে) আর কেউ বাসে নয়... বাইর থাইক্যা আইস্যাই আলতা, আলতা কইয়্যা , আ-রে (আমাকে) হে (সে) এমন করি জড়াই ধইরত... আহা! আহা! ...
এয়াকুবের শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে একখানা চিঠি অনেকদিন আগলে রেখেছির আলতা। যুদ্ধের সময় বউকে লেখা চিঠিতে স্বাধীন দেশের স্বপ্নের কথা লেখা ছিল। এয়াকুবের মৃত্যুর পর দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু আলতাকে বারবার মনে করিয়ে দিত সোনালী দিনগুলির কথা। কিন্তু একসময় অভাবের তাড়নায় আবেগ, স্মৃতিচিহ্ন সব হারিয়ে গেল। বড় বড় কোম্পানিরা যখন “যুদ্ধ দিনের চিঠি” সংকলন করছিল, তখন অল্প পয়সায় চিঠিটা তাদের হাতে তোলে দিয়েছে সে। আশ্চর্যজনকভাবে সে এখনো বিশ্বাস করে, চিঠিটা সে সরকারের লোকদের হাতে দিয়েছে, দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সরকারকে সহায়তা করেছে সে, এ নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই।
দুই.
এয়াকুবেরমৃত্যুর পর অনেক কেদেঁছিল আলতা। ৯০ দিনের ইদ্দত পালনও করেছিল। কিন্তু অভাবগ্রস্ত ভাইয়ের সংসারে ফেরত আসা বাড়তি পেটের অন্ন তো আর মান্না-সালওয়া হয়ে আকাশ থেকে ঝরে পড়ে না। যদিও বাড়তি ঝামেলা বিদায় করার তাগিদ অনুভব করেছিল অনেক আগে থেকেই, তবুও কয়েকটা দিন পরে হলেও একটা বিহিত হল আলতার। ইদ্দতের পরপরই পুণ:নিকাহের আয়োজন করেছিল তার ভাই-ভাবী।
এয়াকুবের মৃত্যুর পর আলতা বিয়ে করেছিল রইসুদ্দীনকে। রইসুদ্দীন ছিল বয়সে তার চারগুণ আর একটা আস্ত বজ্জাত। বুড়ো বয়সে আলতার রোজগার খেয়ে খেয়ে নিজের ভুড়িটাকে বেশ মোটাতাজা করেছিল রইস।কথায় কথায় বউ পিঠানো ছিল তার বদ-স্বভাব।
বুড়োর ঘরে সুন্দরী আলতা বানু; ফলে মহল্লার জোয়ান পুরুষদের তো একটু ঈর্ষা লাগতই! কেউ কেউ কাজের ছুঁতা ধরে তাকে দেখার আশায় ছুঠে আসল বুড়ার বারান্দায়। কথার ফাঁকে ফাঁকে কত পুরুষ যে চোখ মেরে তাকে কাম-প্রবৃত্তির আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেসব আজ শুধুই স্মৃতি!
কথায় কথায় মার খেলেও বুড়োর ঘরে মাটি কামড়ে পড়ে ছিল আলতা। অন্যের বাড়িতে ঝি’য়ের কাজ করে, কাপড় কেঁচে, পানি তোলে, ঘর লেপে আরও নানান কাজে অন্ন জুটত আলতার। সারাদিন কামলা খেটেও রাতের বেলা বিছানায় খুব অসহায় লাগত। এদিক-ওদিক করেও ঘুম আসত না। একদিকে যৌবনের জ্বালা, অন্যদিকে বুইড়া স্বামী। মনে মনে খুব রাগ হত বুড়োর উপর।
আলতা বলে, ... “বুইড়ার তো আর মরদ (যৌন স্বক্ষমতা) আছিল ন, ভালবাসা দিব ক্যামনে, যৌআনকালে শরীরের জ্বালা কি আর এ্যমনেই জুড়াই?”
এভাবেই বুড়ো স্বামীর সংসারে দিন কেটে যাচ্ছিল আলতার। এরইমধ্যে সেবার গ্রামে খবর আসল ঢাকায় এক বিরাট মিছিল হবে। বলা হল মিছিলে গেলে কিছু নগদ পাওয়া যাবে। গ্রামের অনেকেই ছুটে আসছিল ঢাকায় শুধুমাত্র সামান্য টাকার আশায়। ঘটনাটা ‘৯০ সালের আগে পরে- কোন এক সময় হবে হয়ত, ঠিক মনে করতে পারে না।
আলতা বানুর ভাষায়,
“... হে মেলা দিন আগের কথা। দেশের রাজারে উপ্রে (উৎখাত করা) ফেইলবার লইগ্যা যে আন্দোলন অইছিল, হে (সেই) আন্দোলনে আইয়্যাই আর ঘরে ফিরা গেল না বুইড়া। হুনছি (শুনেছি) মিছিলে পুলিশের গুলি খাইয়্যা মরে গেছে... ”।
-to be continued ... ( going to be shaped as a novel)