সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু সুব্রত শুভ’র ইহজাগতিক চিন্তার ব্যাপ্তি আমাকে বারংবার মুগ্ধ করেছে। একদা বন্ধুকে কথা দিয়েছিলাম, ড. আহমদ শরীফের চিন্তাধারার খানিকটাও হলেও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতার আলোকে নিজের মত করে লেখনিতে তোলে আনতে চেষ্টা করব। শুরুতেই বলে রাখি, ক্ষুদ্র এ শিক্ষানবিশের এহেন দৃষ্টতাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।
ড. আহমদ শরীফ নিজেই লিখেছিলেন,
“আমার লেখার একমাত্র লক্ষ্য লৌকিক, অলৌলিক, শাস্ত্রিক, সামাজিক, নৈতিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুরোনা বিশ্বাস-সংস্কারের ও নীতিনিয়মের দেয়াল ভাঙ্গা।”
দৃঢ়চেতা এবং আতœবিশ্বাসী একজন আহমদ শরীফের পক্ষেই এমন ঘোষণা সম্ভব যিনি নিজে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সৃজনশীল লেখনী সমাজের বিদ্যমান চিন্তা -চেতনার কাঠামোকে ভেঙ্গে নতুন করে চিন্তার সুবিন্যস্ত রূপ দিতে সক্ষম হবে। সামান্য পাঠক হিসাবে আমার অনুধাবনও এটাই যে, যারা আ. শরীফ পাঠ করেছেন, তারা নি:সন্দেহে তারা সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি সবকিছুকে আরো একরার নতুনভাবে জেনেছেন।
৭২’ এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া, না যাওয়া প্রসঙ্গে যখন আমরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে নানা মুনির নানান মতে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, তখনো ড. আহমদ শরীফের চিন্তাধারা আমাদের পথ দেখিয়েছে। তিনি সেক্যুলারিজমকে শুধু সংজ্ঞায়িতই করেননি, বরং দেশে দেশে সেক্যুরারিজমের স্বরূপও বিশ্লেষণ করেছিলেন বহুপূর্বে।
সেক্যুলারিজমের সংক্ষিপ্ততম সংজ্ঞায়ন করেছেন এভাবে-
“ধর্মের তথা শাস্ত্রের সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক অস্বীকৃতিই সেক্যুলারিজম। সমাজ ও রাষ্ট্র ধর্ম সম্পর্কে থাকবে সর্ব প্রকারে উদাসীন, শাস্ত্রাচার সম্বন্ধে সমাজ থাকবে নীরব নিষ্ক্রিয়, রাষ্ট্র থাকবে অজ্ঞ-উদাসীন।” / (বাংলাদেশের সাম্প্রতিক চালচিত্র)
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রশ্নে বিভ্রান্তি সহজে কাটছে না। আমরা যতবারই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলি তখনই “ধর্মনিরপেক্ষতা” প্রশ্নটি বারাবার সামনে আসে। কারণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল ধর্মীয় অপশাসন ও শোষণের বিরোদ্ধে লড়াই। আরো সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দ্বিজাতি তত্ত্বের আলোকে -ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের ফলে জন্ম নেওয়া অসন্তোষ, জাতিশোষণ, বঞ্চণা ও সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই। এই লড়াইয়ে পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে যারা মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল তারাও ধর্মের দোহাই দিয়েছিল।
কিন্তু, এতকিছুর পরেও যখন রাষ্ট্রের চরিত্র এবং ধর্ম প্রসঙ্গ আলোচনায় আসি, তখন আমাদের ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং শিক্ষিত সাধারন নাগরিক শ্রেণীর একটা বিশাল অংশ বিভিন্ন যুক্তি নিয়ে হাজির হয়। বিশেষত তারা বলে- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইবেল হাতে শপথ করে রাষ।ট্রীয় কার্যভার গ্রহণ করে, জার্মানীর শক্তিশালী অন্যতম রাজনৈতিক দল ক্রিশিটার ডিমোক্রেটিক পার্টি, ইংল্যন্ডের অধিপতি গির্জারও রক্ষাকর্তা... ... ... ইত্যাদি, ইত্যাদি!
শিক্ষিত এবং ধর্মব্যবসায়ী দলের যে কাউকেই (মডারেট ইসলামিস্ট বলে যারা নিজেদের পরিচয় দেয়) বুঝানো খুবই কষ্টকর যে- মানুষের চিন্তায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মত আধুনিক (‘আধুনিকতা’র ব্যাখ্যা পরবর্তী অংশে আসছে) চেতনার শুরুই হয়েছে যখন ইউরোপে রেঁনেসা আসল । পেত্রাক ভাল্লা এবং দ্যা ভিঞ্চিসহ অনেকের চিন্তাধারাই তৎকালীন গির্জাতন্ত্র এবং স্কলাসটিক ধ্যানধারনার মূলে কুঠরাঘাত করেছিল। ফলে ইউরোপের যেসকল রাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে মানবতাবাদী ও জনকল্যানকর চরিত্র আজকে আমরা দেখতে পাই-তা মূলত সেদিনের সেক্যুলার-আধুনিক চিন্তাধারার ফলাফল ও কার্যধারাবাহিকতা। এই সত্যটুকু অনেকে বোঝেন না, আবার অনেক শিক্ষিতজন বোঝেও না বোঝার ভান করেন।
অথচ, আমরা ইচ্ছামত রাষ্ট্রের চরিত্রে ধর্মকে ব্যবহার করছি। এর ফলে একদিকে যেমন ধর্ম তার কল্যানকর চরিত্র থেকে বিচ্যূত হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্ম রক্ষার নামে আমরা মূলত ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ কে প্রশ্রয় দিচ্ছি।
সাংবিধানিক সেক্যুলার রাষ্ট্র (ভারত) সর্ম্পকে ড. আহমদ শরীফই নির্ভয় ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, - “ মধ্যযুগীয় বিশ্বাস-সংস্কার পুষ্ট সাংবিধানিকরা জেনে বুঝেই সেক্যুলারিজমের ব্যাখ্যায় গোঁজামিলের আশ্রয় নিয়েছেন, দূকূল রক্ষার জন্য। তাঁদের সেক্যুলারিজম হচ্ছে বাস্তবে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি সমদর্শিতা। ” / (ভারতে-বাঙলাদেশে মৌলবাদ ও এর রূপ স্বরূপ)
এখনো বাংলাদেশের একটা চিন্তাশীল মহল এভাবেই সেক্যুলারিজমকে চালিয়ে দিতে চান। বিশেষত ভোটের রাজনীতিতে দুকূল রক্ষার জন্যই। এর ফলাফলও হয় বেশ তিক্ত। গোজামিল দেয়া সেক্যুলারিজম কখনো কোন দেশেই সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। ভারতের সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দু অধ্যষিত অঞ্চলে যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলমানদের গো-হত্যায় বাঁধা আসে, দাঙ্গা বাধেঁ; তেমনি একইভাবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গাপূজায় মোল্লাতন্ত্রের হামলা ও লুঠপাত থেমে থাকে নি।
বাংলাদেশে দুজন সামরিক শাসকই রাজনীতিতে ধর্মের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কারণ, তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে ক্ষমতা পাননি, বরং ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ফলে সাধারন ধর্মভীরু বাঙালী জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয়তা পাবার উপায় হিসাবে তারা ৭২’ এর সংবিধানের মূলচরিত্রটিই পাল্টে দিয়েছিল। আর বর্তমান ক্ষমতাশীল আওয়ামী সরকারও দুকূল রক্ষা করতে গিয়ে রাতারাতি মূল চরিত্রে ফিরে যেতে পারেনি বটে, তবে ভবিষ্যৎ এর জন্য একটা দ্বারোন্মোচন করতে চেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মোল্লাতন্ত্রকে হঠাতে না পারলে সেই আশাও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে।
প্রতিটি বিষয়কে একমাত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বহুমাত্রিক চিন্তায় মনোসংযোগের অভিপ্রায় দেখিয়েছিলেন ড. আহমদ শরীফ। এ কারণেই যুক্তি দিয়েই ধর্মপ্রাণ ও আস্তিকদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
“শাস্ত্রমানা মানুষমাত্রই স্বধর্মকে সত্য ও সর্বশ্রেষ্ঠ বলে জানে ও মানে। সেজন্য প্রত্যেক আস্তিক মানুষ ভিন্নধর্ম ভুল বা মিথ্যা বলে জানে, অবজ্ঞেয় ও পরিহাস্য বলেওভাবে। বাঙলায় তথা ভারতেও হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টানের মধ্যেই নয় শুধু, স্বধর্মীয় বৃহৎ কাঠামোর মধ্যেও বিভিন্ন উপমত, সম্প্রদায় এবং অচারও তেমনি অবজ্ঞা-উপহাস পায় ভিন্ন মতের ও আচারের দলের কাছে।” / (বিচ্ছিন্নতার ও সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব সম্বন্ধে বাঙলার ইতিহাসের কিছু সূত্রের প্রয়োগ)
বাঙালী হিন্দু সমাজের জাত প্রথার কথা কারো অজানা নয়। বলাই বাহুল্য, এখন হিন্দু সমাজও এই জগণ্য আচারগুলো থেকে মুক্তি পেতে চাইছে। আমার বন্ধুমহলে এমন দুজন আছে, যারা বাক্ষèণের স্নতান কিন্তু আধুনিক শিক্ষিত এবং উদারনৈতিক মনোভাবের অধীকারী। ফলে সহজেই অনুমান করা যায়, রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের সংস্কারচিন্তা বৃথা যায়নি। পরিবর্তনের ছোয়াঁ এসেছে হিন্দুসমাজে।
অপরদিকে অনেক মুসলমানকে বলতে শুনবেন, ‘কাদিয়ানীরা ইসলামের শত্র“, তাদের ধবংস করুন’। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেই চট্টগ্রামের চকবাজারে অবস্থিত কাদিয়ানী মসজিদে অনেকবার হামলা হতে দেখেছি। গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকেই শিয়ারা যখন মোহররম উৎসবে নিজের শরীরে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে, তখনো সুন্নী মুসলমানরা এটাকে উপহাস করে, বিদ্রুপ করে।
বাংলাদেশে ধর্মীব্যবসায়ী যেসব রাজনৈতিক দলের অনেক শিক্ষিত জনের কাছে আমি একটি প্রশ্নই করেছিলাম-
১. যদি বাংলাদেশে কোনভাবে ধর্মীয় রাজনীতির উত্থাণের পথ ধরে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামী শাসণ ব্যবস্থা চালুর সুযোগ তৈরি হয়, তবে ইসলাম ধর্মাম্বলবী ছাড়া অন্যরা ইসলামি শরীয়তের বিধান অনুসারে শাসিত হতে রাজি হবেন কি না?
বিষয়টাতে আরো পরিস্কার করা যেতে পারে। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক পথ ধরে ধর্মভিত্তিক এবং ধর্মব্যবসায়ী দল যদি ক্ষমতা লাভ করে, তবে সেক্ষেত্রে তারা শরীয়ত মোতাবেক আইন ও শাসন চালু করতে গিয়ে অন্যধর্মম্বলবীদের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা জোড় করে চাপিয়ে দেবেন কি না? এই প্রশ্নটি চলে আসে , কারণ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন হিন্দু বা আদিবাসী যদি তাদের ইসলামী শাসন মানতে অস্বীকৃতি জানায় তবে তারা কি করবেন কিংবা রাষ্ট্র তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করবে?
দু:খের বিষয় আমি আজো সেই প্রশ্নের উত্তর পাই নি। প্রশ্নটি নতুন করে ঘুরপাক খাচ্ছিল মিশরে মুরসীর বিজয়ের পর। আমাদের দেশের ধর্ম ব্যবসয়ী দলের যেসব সদস্যরা এটাকে বিশাল বিজয় বলে উল্লাস করেছিলেন, এ বিজয়ের সূত্র ধরে বাংলাদেশেও এরকম বিজয়ের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন- তারা আজ ভাল করেই অনুধাবন করেত সক্ষম হয়েছেন সে আশা এত সহজে বাস্তবায়িত হবার নয়। অন্তত বাংলাদেশে নয়, যে দেশের বীর সন্তানেরা ৭১’ এ একটি মন্ত্রে দিক্ষিত হয়েছিল-
“বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার হিন্দু/ বাংলার খ্রিস্টান/ বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী”
সবশেষে, ড. আহমদ শরীফের মত করেই বলি-
‘ অনধিকার চর্চা থেকে বিরত থাকা, অপরকে স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেয়া, মানুষ মাত্রেরই মৌল অধিকার স্বীকার করে নেয় প্রভৃতিতে শুধু সাম্প্রদায়িকতা, দ্রোহ, অসন্তোষ, আন্দোলন, সংগ্রাম বন্ধ হবে না। প্রতি রাষ্ট্রেই যদি ব্যক্তিজীবনে মর্যাদা, স্বাতন্ত্র ও স্বাধীকার, সামাজিক জীবনে সমক্ষমতা, সাম্য ও স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক জীবনে সর্বপ্রকার শাস্ত্রিক বা অন্য প্রকার অদৃশ্য বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা-ভয়-ভক্তি-ভরসা-মুক্ত-যুক্তিনিষ্ঠা ও মুক্ত মন-বুদ্ধি-মননযোগে কল্যাণকে ও সুন্দরকে বরণে আগ্রহ, আর্থিক জীবনে যোগ্যতানুসারে সমসুযোগ ও সুবিচার, রাষ্ট্রীক জীবনে নাগরিক মাত্রেরই সমধিকারও সমনাগরিকত্ব এবং ব্যক্তিরও নাগরিক হিসাবে দায়িত্বচেতনা ও অধিকারবোধ অবাধে স্বীকৃত ও সুনিশ্চিত হয় তা হলেই কেবল নির্বিরোধে সহাবস্থান সম্ভব।’
উপরের অংশটুকু আরো একবার মনোযোগ দিয়ে পড়লে দেখতে পাবেন- এর মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের ’স্বপ্নের বাংলাদেশ’ লুকিয়ে আছে যে দেশের জন্য একদিন আমরা লড়াই করেছিলাম। আমার কাছে এটাই -এক নদী রক্তের ইতিহাস আর স্বপ্নের বাংলাদেশের মডেল ।
উৎসর্গ
১. বন্ধু সুব্রত শুভ
-যার ইহজাগতিক চিন্তার পরিধি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
২. দু:খদিনের বন্ধু কবি আলিম হায়দার
- যার কবিতায় আমার না বলা কথামালা খুঁজে পাই ।