somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উন্নয়নে বিকল্প মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা: প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ৯:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



পুথিঁগত সংজ্ঞায়নের দিকে মনোনিবেশ না করে,’উন্নয়ন’- বলতে ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভাবনা তোলে আনার চেষ্টা করেছিলাম সংক্ষিপ্ত পরিসরে। যাদের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই ’উন্নয়ন’ বলতে মোটাদাগে দারিদ্র, ক্ষুধা, শিক্ষা, জেন্ডার, টেকসই পরিবেশ, মৌলিক চাহিদা নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি সর্ম্পকে ইতিবাচক অগ্রগতিকে চিহ্নিত করেছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় হল, জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)-২০০০ এ উল্লেখিত বিষয়সমূহের সাথে সাধারন শিক্ষার্থীদের মতামতের বিশেষ মিল লক্ষ্য করা গেছে।

এক্ষেত্রে দুটি বিষয় প্রতিয়মান হয়। এক. গণমাধ্যম বিগত ১২ বছরে ’উন্নয়ন’ বলতে এই বিষয়গুলোকে নতুন নতুন ভাবে পুরুৎপাদনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মননে একটা সমরূপী ধারনা তৈরি করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। দুই. বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এই বিষয়গুলোকে প্রধান সমস্যরূপে বিবেচনা করছে এবং এসব সমস্যা থেকে মুক্তিকে ‘উন্নয়ন’ হিসাবে চিহ্নিত করছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘উন্নয়ন’-পপঞ্চকে সংজ্ঞায়নের চেয়ে অনুধাবন সহজতর। সম্প্রতি ‘উন্নয়ন’ নিয়ে জাতিসংঘের যে সংস্থাগুলো বিশ্বব্যাপি কাজ করছে তারাও পপঞ্চটির সংজ্ঞায়ন জটিলতায় ভূগছে বলে বোধ করি।

আমি মনে করি, ‘উন্নয়ন’ পপঞ্চটির মূলনকঁশা লুকিয়ে আছে ‘বৈষম্য -নিরসন’ বা ‘সাম্য-প্রতিষ্ঠা ’ শব্দযুগলের মধ্যে। উপরোল্লিখিত প্রতিটি বিষয়কে সামগ্রিক বিবেচনায় এই শব্দযুগল দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব। এবং এটাও সত্যি যে, সমাজে বৈষম্য আছে বলেই ক্ষুধা, দারিদ্র প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অবশ্য ‘উন্নয়ন’ পপঞ্চের সাথে ‘বৈষম্য’ বা ‘সাম্য’ শব্দগুলোর গভীর সর্ম্পক থাকলেও উন্নয়নকামী এনজিওগোষ্ঠী এ শব্দগুলোকে স্বজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। কারণ, শব্দ দুইটি যতটা না আক্ষরিক তার চেয়েও অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক।
কিন্তু জাতিসংঘ বা মূলধারার গণমাধ্যম, প্রত্যেকেই শব্দযুগলকে পাশকাটিয়ে উন্নয়নের নামে বিশ্বব্যাপী যে মডেল উপস্থাপন করছে তাকে ‘উন্নয়ন বাণিজ্য’ নামে আমি অভিহিত করতে চাই। আমার এহেন বক্তব্যের কারণ পরবর্তী আলোচনায় স্পষ্ট হবে বলে আশা করি।

এবার ‘বিকল্প গণমাধ্যম’ প্রসঙ্গে আসা যাক। বলা হচ্ছে- সাংবাদিকতা পেশা বিকাশের শুরু থেকেই বিকল্প মাধ্যমের অস্তিত্ব ছিল। যুক্তরাজ্যের মিডিয়ার বিবর্তন আলোচনা করতে গিয়ে জেমস কারান ও জাঁ সেটন এর বর্ণনায় আমরা ‘রেডিক্যাল প্রেস’ বা এক ধরনের শ্রমজীবী শ্রেনীর প্রেস সর্ম্পকে জেনেছি যাকে গবেষকদ্বয় বিকল্প গণমাধ্যম হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। বিকল্প গণমাধ্যমের চরিত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে বিষয়গলো আমার নজরে এসেছে সেগুলো হল-১.বিকল্প গণমাধ্যম সমাজ পরিবর্তনের জন্য ওকালতি করে। ২. বিকল্প গণমাধ্যম মুনাফামুখী নয় ৩. এটি সমাজের বিদ্যমান শক্তি কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। ৪. এটি সমাজের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে মতাদর্শ উৎপাদনের বিপরীতে শ্রমজীবী বা সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষে সমবেত কন্ঠস্বররূপে কাজ করে।

ড. ফাহমিদুল হকের আলোচনায় এরকম কিছু বিকল্প মাধ্যমের উদাহরণ (যেমন: ইন্ডিমিডিয়া, জিনেট ইত্যাদি) আমরা লক্ষ্য করেছি। তিনি মনে করেন, সেই অর্থে বাংলাদেশে নামসবর্স্ব কিছু বাম মতাদর্শিক সংবাদপত্র (যেমন: ভ্যানগার্ড) ছাড়া কোন বিকল্প মাধ্যম এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
ড, ফাহমিদ তার আলোচনায় ‘বিকল্প মাধ্যম’কে বোঝানোর জন্য সাইবার স্পেস এর দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন। তবে আমি একটু ভিন্ন মত পোষণ করি। কোন পোস্টার, পথনাটক, যাত্রা, পালা গান কিংবা পুতুল নাচের মতো লোকজ মাধ্যমসমূহ যদি উপরোক্ত বৈশিষ্ঠাবলী ধারন করে, তবে এসব মাধ্যমকেও আমি বিকল্প মাধ্যমের অন্তভূক্ত করতে আগ্রহী। কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ইন্টারনেট নির্ভর সাইবার স্পেসের বিকল্প মাধ্যমে আমাদের তৃণমূল মানুষের ব্যবহার -তুষ্টি ও অভিগমন সন্তোষজনক নয়। অথচ এসব লোকজ মাধ্যম তুলনামূলক সহজেই সকলের কাছে পৌছাতে পারে। ফলে আমি মনে করি, বিকল্প মাধ্যম সর্ম্পকিত আলোচনায় এসব লোকজ মাধ্যমকে পাশকাটানোর সুযোগ নেই। বরঞ্চ এসব লোকজ মাধ্যম ইন্টারনেট নির্ভর বিকল্প মাধ্যমের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ও সহজ অভিগম্য।

এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ৯০’ পরবর্তী দশকে ইন্টারনেটে নয়া মাধ্যম জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং এটি তুলনামূলকভাবে বেশি প্রযুক্তি নির্ভর। আমি মনে করি, বিকল্প গণমাধ্যম এবং নয়া মাধ্যমকে এক করে দেখার সুযোগ নেই বরং নয়া মাধ্যমের একটি অংশ হল বিকল্প মাধ্যম ।

আবার, ইন্টারনেট নির্ভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহকে যদি বিকল্প মাধ্যম হিসাবে ধরেই নিই, তবে সেক্ষেত্রে- এসব মাধ্যমের মুনাফামুখিতার প্রশ্নটি চলে আসে। কারণ বর্তমানে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে বিজ্ঞাপনের আধিক্য ও বিজ্ঞাপন রূপে এনিমেশন ভেলকি খুব সহজেই চোখে পড়ে। ফলে সেই অর্থে এসব মাধ্যমকে জেমস কারান ও জাঁ সেটন এর বৈশিষ্টে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। কিন্তু তারপরেও মূলধারার গণমাধ্যমে যে সংবাদগুলো শ্রেণীপক্ষপাতের কারণে আসতে পারছে না, সাইবার পরিসরে আমরা সেসব সংবাদের জনপরিসর (ঢ়ঁনষরপ ংঢ়যবৎব)লক্ষ্য করছি। এমনকি বিজ্ঞাপন নির্ভর অনলাইন পত্রিকাগুলোতেও নতুনত্ব আনা হয়েছে। এসব অনলাইন পত্রিকাকে যদিও সেই অর্থে বিকল্পমাধ্যম বিবেচনা করা মোটেও উচিত নয়, তথাপি এসব মাধ্যমে সম্প্রতি পাঠকের মতামত প্রদানের সুযোগ রয়েছে।

অর্থাৎ মূলধারার মাধ্যমের ( প্রিন্ট মিডিয়া ও অনলাইন) একটি অংশ আবার চারিত্রিক দিক থেকে কিছুটা হলেও বিকল্প মাধ্যমকে অনুসরণ করছে। উদাহরণস্বরূপ- প্রিন্ট মিডিয়ার চিঠি-কলাম অংশ ও অনলাইন পত্রিকার পাঠক মতামত অংশকে বিবেচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এখন একজন পাঠক চাইলেই প্রথম আলোর অন-লাইন সংবাদের নীচের অংশে সংবাদটিকে সমর্থন না করার পক্ষে তার মতামত তুলে ধরে যথেষ্ঠ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে পারেন। ফলে এসব মাধ্যমে সকলের মত প্রকাশের সুযোগ তৈরি হচ্ছে এবং এটি সমাজের শক্তিকাঠামো ভাঙ্গার জন্যও এক ধরনের ভূমিকা রাখছে।

যে প্রশ্নটি আগে থেকেই ছিল এবং এখনো আছে- ইন্টারনেট নির্ভর এই মাধ্যম কত শতাংশ মানুষের হাতে পৌঁছেছে? সমাজের শ্রমজীবী গোষ্ঠীর হাতে এটি এখনো পৌছায়নি। ফলে ইন্টারনির্ভর এসব মাধ্যমে শ্রমজীবীদের কথা সরাসরি আসছে না বরং তাদের কথা সাইবার পরিসরে বিনির্মাণ (ফবপড়হংঃৎঁপঃবফ ঢ়ৎড়ষবঃধৎরধঃ াড়রপব)করা হচ্ছে।

সাইবার পরিসরে বিকল্প মাধ্যম সমাজের উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তা মূল্যায়ন করতে গেলে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের শ্রেণীটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন বলে মনে করি।। জরিপে বলা আছে, বাংলাদেশে ১% এরও কম বা ১% এর কাছাকাছি মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা ভোগ করে। ফলে স্বভাবতই বোঝা যায়, এই আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান আমাদের সমাজে মোটেও শ্রেণীনিরপেক্ষ নয়। অর্থাৎ এসব বিকল্প মাধ্যমের লেখক, পাঠক ও মতামত প্রদানকারী কেউই সেই শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে না বস্তুত যাদের উন্নয়ন এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরী। ফলে আমরা যারা সাইবার পরিসরে উন্নয়নের ধোঁয়া তুলছি, তাদের বোঝা উচিত এটা একটা বিচ্ছিন্ন জনপরিসর (ধষরবহধঃবফ ঢ়ঁনষরপ ংঢ়যবৎব)।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে - “যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই”। সাইবার পরিসরে বিকল্প মাধ্যমের সাহায্যে বাংলাদেশের উন্নয়ন অনেকাই এই প্রবাদের সাথে প্রাসঙ্গিক। উদাহরণ দিয়ে বিষয়ট্ াপরিস্কার করা যেতে পারে। আমাদের দেশে যখন ‘তথ্য অধিকার আইন’ খসড়াটি মতামত জরিপের জন্য অনলাইনে ঝুলানো হয়েছিল, তখন দেশে ইন্টারন্টে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ০.৫ শতাংশ। এবং এ খসড়া প্রণয়নকারী গোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ ছিল সমাজের নামীদামী এনজিও-এলিট শ্রেণীর প্রতিনিধি। অথচ খসড়াটি করা হয়েছিল সমাজের সাধারণ নাগরিকদের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তাহলে যাদের জন্য উন্নয়ন, তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোন বিষয়কে কি অদৌ উন্নয়ন বলা উচিত? বলার অপেক্ষা রাখে না , ইন্টারনেট নির্ভর বিকল্প মাধ্যম ঠিক এই জায়গাটিতেই ব্যার্থ হয়। এ মাধ্যম জনগণের সাথে নীতি নির্ধারকদের মধ্যকার বিচ্ছিন্নতা ঘোছাতে পারে না।

বিকল্প মাধ্যমের মারফতে উন্নয়ন অনেক রকম হতে পারে। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই , বিকল্প মাধ্যম সমাজের ক্ষুদ্র একটা শ্রেণীর (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী শ্রেণী) মানসিকতার পরিবর্তন করছে। অনেকে বলে থাকেন, বিকল্প মাধ্যম সীমান্ত হত্যা, টিপাইমুখ বাধঁ, দূর্নীতিসহ নানান সামাজিক সমস্যায় জনমত গঠনে ভূমিকা রাখছে, সচেতন করে তোলছে। কিন্তু আমি বিষয়টাকে একটু ভিন্নভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি। আমার প্রশ্ন হল- এসব সচেতনতা কি আদৌ নীতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য কোন ভুমিকা রাখতে পেরেছে?

বিষয়টাকে আরো পরিষ্কার করা যেতে পারে। পদ্মা সেতু দূর্নীতি মামলা, সমাজের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আবাল বক্তব্য, ড. ইউনুস বির্তক এসব নিয়ে আমাদের ফেইসবুক, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমত ঝড় উঠেছিল। কিন্তু একটু গভীরভাবে অনুধাবন করলেই বোঝা যায়- সাইবার স্পেসে এসব বির্তকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য যতটা না সামাজিক উন্নয়ন, তার চেয়ে অধিক মাত্রায় রাজনৈতিক। এখন যারা সামাজিক উন্নয়ন নিয়ে সরকারের সমালোচনায় সাইবার স্পেসে সোচ্চার, তারাই আবার বিরোধী দলে গেলে ঘুমিয়ে পড়বেন। দেশে দারিদ্র বিমোচন হল কি হলনা, কতটুকু হল, সেটা এদের প্রধান মাথাব্যাথা নয়; বরং তাদের আলোচনা ড. ইউনুসকে সম্মানিত বা অসম্মানিত করার পক্ষে তাদের শক্ত অবস্থান ব্যাখ্যা করা। গ্রামীন মানুষের কতটুকু উন্নয়ন হল তা নিয়ে এদের ভ্রুক্ষেপ নেই। এর মাধ্যমে উন্নয়নে বিকল্প মাধ্যমের ব্যার্থতার চিত্রই ফুটে উঠে।

গনমাধ্যম বিশেষজ্ঞ এলিজাবেথ নুয়েলম্যান এর ‘নীরবতা কুন্ডলী’ (ঝঢ়রৎধষ ড়ভ ঝরষবহপব) আমাদের সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা বিকল্প মাধ্যমেও ক্রিয়াশীল। বিএনপি-আওয়ামী মতাদর্শীদের বিরোদ্ধ অবস্থান, আস্তিক-নাস্তিক অশালীন গালাগাল, ডান-বাম বিরোধ, মুজিব-জিয়া বির্তক এসবের ভিড়ে চাপা পড়ে যাচ্ছে উন্নয়ন ইস্যুসমূহ। ফলে উন্নয়নে বিকল্প মাধ্যমের ভুমিকা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

যে সীমাবব্ধতার কথা না বললেই নয়, উন্নয়ন ও বিকল্প মাধ্যমকে অর্থনীতির কার্য-কারণ (পধঁংব-বভভবপঃ) সর্ম্পক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যে বিষয়টা প্রতীয়মান হয় তার সারকথা দাড়ায়- ‘ উন্নয়নের জন্য বিকল্প মাধ্যম, বিকল্প মাধ্যমের জন্য উন্নয়ন নয়’। ফলে বিকল্প মাধ্যম ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে ধরে নেবার আদৌ কোন যৌক্তিকতা নেই।

সাম্প্রতিক আরব বসন্তকে অনেকে নয়া মাধ্যমের অনবদ্য অবদান বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু, আমি মনে করি, আমরা যখনই আরব বসন্তের কৃতিত্ব একজন বীর খালিদ সাঈদ বা শত-সহস্র গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুসগুলোকে না দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম/নয়া মাধ্যকে মূল কৃতিত্ব দিই, তখন প্রকৃতঅর্থে তা সেইসব গণতন্ত্রকামী মানুষগুলোর অবদানকে তাচ্ছিল্য করার শামিল। মানতে আপত্তি নেই, তথ্য প্রযুক্তির অবদান ছিল এ আন্দোলনে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি তাহরির স্কোয়ারে ভিড় না করত, তবে ‘আরব বসন্ত’ হয়ত কোনদিনও পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলত না।
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি মানতেই হয়, আরব বসন্ত ছিল মূলত লক্ষ লক্ষ গণতন্ত্রকামী মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভের বিস্ফোরণ। লেখক রণেশ দাসগুপ্ত তাঁর লেখায় মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ ও ঐতিহাসিক দ্বান্ধিক বস্তুবাদ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এরকম ‘পুঞ্জিভূত ক্ষোভের মহা বিস্ফোরণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। আরব বসন্তে বিকল্প মাধ্যম অনেকগুলো চালিকাশক্তির একটি হিসাবে আন্দোলনকে বেগবান হতে সাহায্য করেছিল মাত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও তাই প্রমাণিত হয় যদিও ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় সাইবার স্পেসের ব্যবহার ছিলনা; তাই বিকল্প মাধ্যমের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু দীর্ঘ দিনের শোষণ-বঞ্জনা থেকে মুক্তির চেয়ে বড় আর কোন উন্নয়ন আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। ফলে উন্নয়নের জন্য মানুষের প্রবল ইচ্ছা শক্তিই প্রধান, বিকল্প মাধ্যম নয়।

উন্নয়ন প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন এর কথা না বললেই নয়। সেন সরাসরি উন্নয়নের কথা বলছেন না, বলছেন- ‘স্বক্ষমতা ও উন্নয়ন’। উন্নয়ন/নির্ভরতা স্কুলের গবেষকদের মত তিনি কোন পক্ষে সরাসরি অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। সেন বলছেন- ‘ব্যক্তিক সৃজণশীলতার পরিপূর্ণ বিকাশই উন্নয়ন’। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেনের বক্তব্যের সাথে একমত। কারণ, যে ব্যক্তি জমিতে ফসল ফলিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র নিরসণে নিজেকে নিয়োজিত করবেন, তিনি যদি কৃষিকাজে আনন্দ না পান, তবে এ কাজে উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফলে উন্নয়নের জন্য উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিক সৃজনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ, বিকল্প মাধ্যম এক্ষেত্রে মূখ্য নয়। বিকল্প মাধ্যম উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরতে পারে মাত্র, কিন্তু সরাসরি উন্নয়ন কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখতে পারে না।

বাংলাদেশের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণের জন্য একটা উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘মাটি ও মানুষ’-এর মত অনুষ্ঠানগুলোতে অধিক ফলনের জন্য হাইব্রিড বীজ-সার ব্যবহারে কৃষকদের ‘প্ররোচিত’ করা হচ্ছে। বাস্তবে এসব বীজ থেকে অধিক ফলন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ক্রেতারা এসব জাতের চাল কিনছে না। ফলে কৃষক চালের বাজার হারাচ্ছে এবং আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অনেকে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-স্লোগানধারী মূলধারার গণমাধ্যমটির চারিত্র হল - ‘হৃদয়ে বাণিজ্য’। ফলে এই চ্যানেলে প্রকৃত চিত্র কখনোই তোলে ধরা হয় না। এক্ষেত্রে বিকল্প মাধ্যম শক্তিশালী ভুমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। কিন্তু, আবার প্রশ্ন আসে- কৃষকের কাছে কি বিকল্প মাধ্যম পৌছাতে পেরেছে?

ধরুন, কৃষকের কাছে ভ্যানগার্ডের মত কিছু বাম মতাদর্শিক পত্রিকা পৌছাল। এক্ষেত্রে দুটি সমস্যা দেখা যেতে পারে। এক. উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদেরকে বিকল্প মাধ্যমটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে। দুই. আমাদের দেশের বাম মতাদর্শিক সংগঠনগুলো তাদের দু:বোধ্য শব্দ চয়নের (যেমন- পরাশক্তি, ঔপনিবেশিক শক্তি, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইত্যাদি শব্দসমূহ দেশের সাধারণ উন্নয়নকামী মানুষের কাছে দু:বোধ্য বলে বিবেচনা করছি) চর্চা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে না পারায়, সাধারণ মানুষকে তারা উন্নয়নের অর্থ বোঝাতে ব্যার্থ হতে পারে।

অর্থাৎ, নিত্য পরিবর্তনশীল জ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে দরকার নিত্য পরিবর্তনশীল দক্ষতার। ফলে বিকল্প মাধ্যম ব্যবহারকারীদের যোগাযোগ দক্ষতা, উন্নয়নের ক্ষেত্রে মাধ্যমটির চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশে এখন সেলুলার ফোন কোম্পানিগুলোর মারফতে গ্রামে গঞ্জে ইন্টারনেট সেবা পৌছে যাচ্ছে। কিন্তু, এই সেবা আদৌ উন্নয়নে ভূমিকা রাকতে পারছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সাথে পরিবর্তনশীল দক্ষতার অভাবের সাথে সাথে এখন যে বিষয়টিকে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তা হল- নৈতিকতা। প্রযুক্তি নিজে নৈতিকতা বোঝে না।
ব্যবহারকারীর নৈতিকতা বোধ বা চেতনা নিয়েই আমার প্রশ্ন। গ্রামের উন্নয়নকামী যুব সম্প্রদায় যদি ইন্টারনেটে উন্নয়ন সংবাদ না দেখে, স্বদেশী/ ভিনদেশী সাংস্কৃতিক পণ্য আসক্তিতে নিমজ্জিত হয়, তবে উন্নয়নের সম্ভাবনা ও হ্রাস পাবে।
প্রশ্ন আসা স্বভাবিক, বিকল্প মাধ্যম উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখতে পারছে না কেন? আমি মনে করি, অন্যতম কারণ- সুনির্দিষ্ঠ সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির অভাব।
সম্প্রতি সাতক্ষিরায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাটি মূলধারার গণমাধ্যমে স্থান পায়নি। কিন্তু, ইউটিউব ও ফেসবুকে দউরফ ডব হড়ঃ ঝরহম ণড়ঁৎ ঘধঃরড়হধষ অহঃযবস’ শিরোনামে একটি ভিডিওচিত্র সকলের দৃষ্টি আকষর্ণ করে। মূলধারার গণমাধ্যম বিষয়টি কাজটি পাশকাটিয়ে গেলেও সাইবার স্পেসে আমরা প্রকৃত ঘটনা দেখেছি। এইটি বিকল্প মাধ্যমের সম্ভাবনা বটে। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হল, ভিডিওচিত্রটি প্রকাশের পরদিনই ইউটিউবে আর পাওয়া যায়নি। বিকল্প মাধ্যমের সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যপদ্ধতির সীমাবদ্ধতা এ বিষয় থেকে থেকেই অনুধাবন করা যায়।
বিকল্প মাধ্যমের আরো একটি সীমাবদ্ধতা হল- দীর্ঘমেয়াদ অভাব (অষঃবৎহধঃরাব সবফরধ ফড়বংহ’ঃ ঃযরহশ ভড়ৎ ষড়হম ঃবৎস ংঁংঃধরহধনরষরঃু)। যেকোন উন্নয়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আবশ্যক। গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে উন্নয়নের জন্য যারা কাজ করছেন, তারা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর চিন্তা করেন প্রকল্প প্রণয়ণ করেন এবং মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। বিকল্প মাধ্যমেও একই চিত্র । ঘটনার রেশ শেষ হতে না হতেই নতুন ঘটনার সূত্রপাত, আর আমাদের বিকল্প মাধ্যমও দৃষ্টিগুরিয়ে নেয়। ফলে টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা বিঘিœত হয়।
ধরা যাক, উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে মাতৃদুগ্ধ পান সচেতনতা প্রকল্পের অধিনে ৫ বছর কাজ করবে কোন এনজিও। তারা এজন্য গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য মোটা অংকের ফেলোশীপ ঘোষণা করে। এরপর নিজেদের মত করে সাংবাদিকদের ট্রেনিং দেয় এবং সংবাদ প্রণয়ণ সংক্রান্ত একটা দিক নির্দেশনা দেয়। এখানেই মূলত শূভঙ্করের ফাঁকি। প্রকল্প কতটুকু সার্থক হল, সেসব বিবেচনা না করেই ৫-১০ টা রির্পোট করেই বলা হচ্ছে- প্রকল্প বাস্তবায়ন সফল। বাস্তবচিত্র ভিন্ন। তাহলে মূলধারার গণমাধ্যম যেখানে পৌছাতে পারছে না, সেখানে বিকল্প মাধ্যম উন্নয়নের জন্য কাজ করবে; বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টা খানিকটা আকাশকুসুম কল্পনা। অšতত এইসব গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিকল্প মাধ্যম তেমন কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না।


আমার আলোচনার শুরুতেই আমি বলেছি, কোন পোস্টার, পথনাটক, যাত্রা, পালা গান কিংবা পুতুল নাচের মতো লোকজ মাধ্যমসমূহ যদি উপরোক্ত বৈশিষ্ঠাবলী (বিকল্প মাধ্যমের বৈশিষ্ট) ধারন করে, তবে এসব মাধ্যমকেও আমি বিকল্প মাধ্যমের অন্তভূক্ত করতে আগ্রহী। কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, ইন্টারনেট নির্ভর সাইবার স্পেসের বিকল্প মাধ্যমে আমাদের তৃণমূল মানুষের ব্যবহার -তুষ্টি ও অভিগমন সন্তোষজনক নয়। অথচ এসব লোকজ মাধ্যম তুলনামূলক সহজেই সকলের কাছে পৌছাতে পারে।
লোকজ মাধ্যমকে আমি বিকল্প মাধ্যম বলতে পারি কি না? আমি মনে করি- অবশ্যই। লোাকজ বা বিকল্প, যে নামেই ডাকা হোক না কেন-নামে কি বা আসে যায়। উপরোল্লিখিত- উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে মাতৃদুগ্ধ পান সচেতনতা প্রকল্পটির ক্ষেত্রে লোকজ মাধ্যমের ব্যবহার নি:সন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এখনো পালা গান, যাত্রা, পুতুল নাঁচ পছন্দ করে। এ মাধ্যমের আধেয়তে যদি উন্নয়ন ইস্য ডুকিয়ে দিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় মানুষের কাছে তা পৌছে দেয়া যায়, তবে উন্নয়ন অনেকখানি সম্ভব হতে পারে।
প্রয়াত তারেক মাসুদের অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম ‘মাটির ময়না’ চলচ্চিত্রে এরকম একটি পালা গানে হাজার বছরের গ্রাম বাংলার চিত্র আমরা দেখেছি। গানের আধেয় ছির- ‘অসাম্প্রদায়িকতা, নারী-পুরুষ সর্ম্পক ও পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি’। ভার্জিনিয়া ওলফ বা মেরী ওলস্টোনক্র্যফট এর লেখা পড়েই যে সকলকে পুরুষতান্ত্রিক রাজনীতি ও নারীর অধিকার বুঝতে হবে এমনটি আমি মানতে নারাজ। আমাদের শিক্ষিত নারী সমাজের কতজনই বা রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ গলদকরণ করেছেন- আমি সন্দিহান! আমি মনে করি, এক্ষেত্রে কাঙালিনী সুফিয়ার সার্থকতা বরঞ্চ কিঞ্চিৎ বেশি। তার সহজ সরল গানের কথা, মাটির সুর খুব সহজেই আমার দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীতে আকৃষ্ট করতে পারে। কাঙালীনীর গানের কলি যদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য ওকালতি করে, সমাজের শক্তি কাঠামো ভাঙার জন্য মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করে- তবে তার গানকে আমি বিকল্প মাধ্যম বলব না কেন? এই বিবেচনায় নিম্নবর্গের কন্ঠস্বরও (ঝঁনধষঃবৎহ াড়রপব) শক্তিশালী বিকল্প মাধ্যম বলে আমি মনে করি।

কিন্তু মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। নিম্নবর্গের এই কন্ঠস্বর কি আদৌ সমাজের শক্তিশৃঙ্খল ভাঙতে পারে? তাদের কন্ঠস্বর কখনোই রাজা বাদশাদের নীতি নির্ধারণে নুন্যতমও গুরুত্ব পায় না। ফলে ধষঃবৎহধঃরাব সবফরধ বা ংঁনধষঃবৎহ াড়রপব যে নামেই বলি না কেন, কোনটিই সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে নয়।
পোস্টারের আধেয় যদি সমাজ পরিবর্তনের জন্য ওকালতি করে, মুনাফামুখী উদ্দেশ্য না থাকে, তবে পোস্টারকে বিকল্প মাধ্যম ধরা যেতে পারে। কিন্তু পোস্টারের ক্ষেত্রে এক ধরনের বড় সীমাবদ্ধতা কাজ করবে। উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠী পোস্টারের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হলে যোগাযোগ বিঘিœত হবে। কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্রের ক্ষেত্রেও একই প্রতিবন্ধকতা।

আবার ধরুন, পুতুন নাচের মাধ্যমে আপনি মা ও শিশুর পরিচর্যা বিষয়টি তুলে ধরবেন। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, সীমাবদ্ধতা রয়েই যায়। উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠী পুতুল নাঁচকে শুধুই বিনোদন হিসাবে নিচ্ছে। তারা পুতুল নাঁচ দেখে বিষয়টি সর্ম্পকে অবগত হয়ে মা ও শিশুর পরিচর্যা, পুষ্টি এসব বিষয়ে সচেতন হবে এমনটি ভাবা দুরুহ। ফলে পুতুল নাঁচের মত লোকজ মাধ্যমকে যদি উন্নয়নের জন্য বিকল্প মাধ্যম বিবেচনা করি, তথাপি এক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা কাজ করছে।


আমার বিক্ষিপ্ত আলোচনাকে যদি সাজাতে চেষ্টা করি, তবে মূলসুরটি এমন দাড়ায় যে- ‘উন্নয়নের জন্যই বিকল্প মাধ্যম, বিকল্প মাধ্যমের জন্য উন্নয়ন নয়’। ‘উন্নয়ন’ শব্দটিকে সংজ্ঞায়নের চেয়ে চেনা বা অনুধাবন সহজতর এবং শব্দটি অবশ্যই রাজনৈতিক। ‘উন্নয়ন’ শব্দটি নিজেই নিজের চরিত্রকে লুকিয়ে রাখতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, বয়স্ক শিক্ষা চালুর মাধ্যমে গ্রামীন উন্নয়নের নামে আসলে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতকরণের ব্যর্থতাকে লুকাতে চায়। আর বিকল্প মাধ্যমের বৈশিষ্ঠ বিবেচনা করলে, বাংলাদেশে সেই অর্থে তেমন কোন শক্তিশালী বিকল্প মাধ্যম নেই বললেই চলে। আমাদের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বিকল্প মাধ্যম আলোচনায় সাইবার স্পেস, ইন্টারনেট ও কিছুসংক্যক মতাদর্শিক বুলেটিনকে চিহ্নিত করলেও আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে বেশ কিছু লোকজ মাধ্যমকেও বিকল্প মাধ্যমের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি এবং উন্নয়নে এদের সীমাবদ্ধতার অংশটুকু চিহ্নিত করার প্রয়াস পেয়েছি। ইন্টারনেটের সাথে উন্নয়নকামী মানুষের বিচ্ছিন্নতা এবং সাইবার পরিসরে ১% ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের বিছিন্ন জনপরিসরকে আমি সীমাবদ্ধতা হিসাবে চিহ্নিক করতে চেয়েছি। সাইবার পরিসরে উন্নয়নের নামে আস্তিক-নাস্তিক গালাগাল, মুজিব-জিয়া নিয়ে প্রধান দুই দল কেন্দ্রিক বির্তকের কারণে উন্নয়ন ইস্যূগুলো ‘নীরবতার কুন্ডলী’র মত চাপা পড়ে যাচ্ছে যা বিকল্প মাধ্যমের সম্ভাবনার পথে অন্তরায় হিসাবে আমি মনে করি। সাইবার স্পেসে যে সাইটগুলো চারিত্রিক দিক থেতেত কিছুটা হলেও বিকল্প মাধ্যমকে সমর্থন করে, সেই সব সাইটেও চলে গেইট কিপিং। একারণে, সাতক্ষিরার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত ঘটনাগুলো কিছুদিনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার যারা প্রকৃত অর্থে সাধারন মানুষের হয়ে কথা বলতে চায়, তাদের শব্দ চয়নের দু:বোধ্যতা তাদেরকে উন্নয়নকামী জনগোষ্ঠী থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কাঙালীনী সুফিয়ার মত নিম্নবর্গের কন্ঠস্বরকেও যদি সামাজিক উন্নয়নের জন্য বিকল্প মাধ্যম হিসাবে ধরে নিই, তবে সেক্ষেত্রে এসব কন্ঠস্বর কখনোই প্রাচীর ভেদ করে নীতি নির্ধারকদের কাছে পৌছায় না। একইভাবে বৈষ্যমের বিরোদ্ধে সাইবার স্পেসের প্রতিবাদও নীতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে না। পুতুল নাচেঁর মত বিকল্প মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নের আধেয় থাকলেও তা মানুষ শুধুই বিনোদন হিসাবে গ্রহণ করে, সচেতন হবার উদ্দেশ্যে নয়। ফলে লোকজ মাধ্যমগুলোর বিকল্প মাধ্যম হয়ে ওঠার সম্ভাবনার পথে এটাও একটা প্রধান সীমাব্ধতা বলে আমি মনে করি। সর্বোপরি, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বিকল্প মাধ্যমগুলোর কার্য-কারণ সর্ম্পক, নির্দিষ্ট সাংগঠনিক ভিত্তির অভাব, দীর্ঘ মেয়াদে উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাব ইত্যাদি বিষয়াবলীকে উন্নয়নে বিকল্প মাধ্যমের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করে আমি আমার বক্তব্যকে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×