“মুখে তারা যাই বলুক, রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় পরস্পরের মিত্র হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়, কেননা দু’য়ের উদ্দেশ্য পরস্পর বিরোধী। রাষ্ট্রের উচিত কায়েমী স্বার্থকে পাহাড়া দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য সেই স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করা। এই দুই পরস্পর বিরোধী স্বার্থ মিলবে কি করে? মিলবে কেন? ”- (চৌধুরী: ২০০৬)
প্রতিবারের মত এবারও আমরা ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করব। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এবছর স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করার সুবাদে এটুকু বলতে পারি- বিগত বছরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়কে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
সরলরৈখিকভাবে বলতে গেলে- ১/১১ অসাংবিধানিক সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকদের দ্বিধাবিভক্তি, ক্ষমতার পালাবদল, বন্ধ থাকা ডাকসুকে সচল করার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শিক্ষক সমিতি নির্বাচন থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রচারণা, এবং সর্বশেষ শাহবাগ আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়াপ্রদানসহ অনেককিছুই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
বলাই বাহুল্য, সরকার যেমন রাষ্টযন্ত্রের একটি শক্তিশালী অংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ও তেমনি। জনগণের কর ও বিভিন্নখাতের বরাদ্ধ দিয়ে রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি সচল রাখতে আনুক’ল্য্য প্রদান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ও তেমনি দক্ষ ও শিক্ষিত জনবল রাষ্ট্রকে সরবরাহ করে । ফলে রাষ্ট্রের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ম্পকটা পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরতার। সমস্যাটা হল- সরকারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ম্পকটা যেমনটি হওয়ার কথা ছিল, প্রকৃতই তেমনটি নেই। কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের কর্তত্ববাদী আচরণের সমালোচনা করবে, গণতন্ত্রের চর্চা করবে, কিন্তু আদৌ করতে পারছে কি?
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারনাটির সাথেই জড়িয়ে আছে -জ্ঞানচর্চা, বুদ্ধিবৃত্তি, দেশপ্রেম-চেতনা, এমন অসংখ্য উপাদান, সর্বোপরি স্বায়ত্তশাসন। এই স্বায়ত্তশাসন কখনোই অপব্যবহার করবার জন্য নয়, বরং এটাকে কায়েমী স্বার্থের বিরোদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারার নিশ্চয়তা হিসাবে দেখা যেতে পারে। পরিতাপের বিষয় হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সরকারের সর্ম্পক এখন পোষ্য-পোষকের সর্ম্পক। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিক বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য কিছুই আমরা আর দেখতে পাচ্ছি না।
‘গণতন্ত্রায়ণে উচ্চশিক্ষা’-শিরোনামেও আমরা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই আমাদেরকে ‘গণতন্ত্র’ সংজ্ঞায়ন করতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় তার চর্চা স্বয়ং শিক্ষকরা করতে পারছেন কিনা সেটা নিয়ে সংশয় আছে, শিক্ষার্থীদের কথা বাদ দিলাম। জাতিগতভাবে আমাদেরকে এই উপলব্ধিটুকু ধারন করতে হবে যে, গণতন্ত্র চর্চা মানে শুধু নির্বাচন নয়। বলতে আপত্তি নেই, শিক্ষক - শিক্ষার্থী উভয় মহলে গণতন্ত্র চর্চার প্রধান জুজু সরকার, প্রথম নিষেধাজ্ঞাও আসে সরকার থেকে। ফলে বলার অপেক্ষা রাখে না- বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসের সঙ্গে সরকার সরাসরি জড়িত।
গবেষকগণ বলেছেন, সন্ত্রাসের শুরু সেই মোনেম খানের আমল থেকেই। পরিতাপের বিষয় হল, মোনেম খানরা চলে গেলেও তাঁদের হুকুমতগুলো রয়ে যায়, যার দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় আজ আমরা এমন একটা সংকটময় মুহুর্তের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এটাকে দীর্ঘদিন চলতে দেয়া যাবে না। এই দুষ্টুচক্র আমাদেরকেই ভাঙতে হবে।
এতসব সংকটের মধ্যেও আমি নি:সংকোচে ঘোষণা করতে পারি, আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে পেরে আমি অসামান্য আনন্দিত, গর্বিত। যুগে যুগে স্বাধীনতা, সংগ্রাম, সত্য-সুন্দও ও ন্যায়ের পক্ষে এই প্রতিষ্ঠানের ভুমিকা ও ইতিহাস চির অম্লান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন যেমন হয়েছে, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনেও এই প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি অন্যায়, অসত্য ও বৈষম্যের বিরোদ্ধে এখনো এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই সবার আগে প্রতিবাদ জানায়।
যে প্রতিষ্ঠানটি অন্যায়, অসত্য ও বৈষম্যেও বিরোদ্ধে লড়াই করে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিতে পেরেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানটি জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সত্য ও সুন্দরের পথে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে যাবে এমনটাই আমাদেও প্রত্যাশা।
এই প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুভ হোক, প্রত্যেক দেশপ্রেমিককে সঙ্গে নিয়েই। শুভ জন্মদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক: শিক্ষর্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।