এক সময় মানুষের মনে বিশ্বাস ছিল বিধাতা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে আরেকটি মানুষ সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই কথা জনস্মমুখে আলোচনা করতে গেলে হয়ত দাঙ্গার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা আজ এই কথাটিকেই প্রশ্নবিধ্য করেছে। আপনি কি এই ব্যাপারে ভাবতে পারেন? হ্যা সত্যি, এই প্রশ্নকে নাড়া দিয়েছে যে শব্দটি সেটি হচ্ছে 'ক্লোনিং'।
ক্লোনিং শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে যার অর্থ গাছের একটি শাখা থেকে আরেকটি শাখা উৎপন্ন হওয়া। আর এই ধারনাটি মানুষ এবং অন্যান্য প্রানীর ক্ষেত্রেও মেডিকেল বিদ্যায় নিয়ে আসা হয় গত শতাব্দিতে। মানব ক্লোনিং যে প্রক্রিয়ায় করা হয়ে থাকে তাতে বলা হয় রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং। ক্লোন শব্দটি প্রথম বৃটিশ বিজ্ঞানী হে বি এস হালডন ১৯৬৩ সালে ব্যবহার করেন। এবং তিনিই প্রথম অযৌন প্রক্রিয়ায় একটি প্রানী দেহ থেকে আরেকটি প্রানীদেহ সৃষ্টির কথা ভাবেন। জীবকোষ থেকে নিউক্লিয়াস নিয়ে, তা ডিম্বাণুর সাথে নিষিক্তকরণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ অযৌন প্রক্রিয়ার উত্পভন্ন হুবহু আরেক জীব হোল ক্লোনিঙের মূল বিষয়। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম ১৮৮৫ সালে ফেইবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউসম্যাস মানুষের উপর ক্লোনিং গবেষণা শুরু করেন। আধুনিক বিজ্ঞানে এটি একটি অতি যুগান্তকারি ফর্মুলা যা জৈবিক বিজ্ঞানের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ রূপে বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে।
এবার আসা যাক কি করে ক্লোনিং করা হয় সেই ব্যাপারে। ক্লোনিং করার উপায়টি যদিয় খুবি জটিল তা আপনাদেরকে আমি এখন সহজ ভাষায় ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি। গবেষকরা অনেক বছর পার করেছেন এর সফল সূচনা করার জন্য যদিও তারা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ত্রুটিহীনসফলতা পান নি। রিপ্রোডাক্টিভ ক্লোনিং বা মানব ক্লোনিং প্রকৃয়ায় তৈরীকৃত প্রানীর DNA হুবহু তার মাতৃ প্রানীর DNA র মতই হয়। আর এর জন্য ডিম্বানুর DNA বহনকারি নিউক্লিয়াসকে অন্য একটি প্রানীর DNA দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে হয়। তারপর এই ডিম্বানুটি কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে একটি পরিপুর্ন দেহকোষে পরিণত হওয়ার জন্য গবেষনাগারে রেখে দেয়া হয়, অথবা এটিকে কোন নারীর জরায়ুতেও প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে পরিক্ষা চলাকালীন সময়ে ওই কোষটির ডি এন এ এর উপর বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে ক্লোন মানবটির মানবিক এবং শারীরিক বৈশিষ্টকে কাস্টমাইজ করে নিতে পারেন। যেটা হচ্ছে ক্লোনিং এর সবচেয়ে বড় গুণ। এভাবেই ক্লোনিং সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
এবার আসা যাক একটি সফল ক্লোনিং এর গল্প নিয়ে। আপনারা সবাই নিশ্চই বিখ্যাত গাইকা 'ডলি পারটনের' নাম শুনেছেন? আর এই বিখ্যাত গাইকার নামানুসারেই রাখা হয়েছিল বিশ্বের সর্বপ্রথম ক্লোন ভেড়ার নাম। এই প্রানীটি ছিল একটি ভেড়া। ১৯৯৬ সালের জুলাইতে স্কটিস গবেষক ডাঃ আয়ান উইলমুট সফলভাবে একটি ভেড়ার স্তনবৃন্ত থেকে সংগৃহীত কোষ অন্য একটি ভেড়ার ডিম্বানুতে প্রতিস্থাপন করেন যার ফলে নতুন প্রজাতির একটি ভেড়া সৃষ্টি হয় এবং এর নাম রাখা হয় 'ডলি'। সব চেয়ে দৃষ্টি দেয়ার মত বিষয় হচ্ছে এই ভেড়াটি ক্লোনিং করতে ডাঃ আয়ান উইলমুটকে ২৭৬ বার বিফল হতে হয় এবং সবগুলো ক্লোনই তখন মারা যায়। এবং এই পরিক্ষার সফলতার মাধ্যমে ইতিহাসে প্রথম ক্লোন বিপ্লবের সূচনা ঘটে। এই প্রানীটির জন্মের কথা প্রথম বিশ্বের কাছে প্রকাশ করা হয় প্রানীটির জন্মের ৭ মাস পর ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ক্লোন ভেড়া ডলি ৬ বছর বেঁচে থাকার পর আর্থাইটিস রোগে আক্রান্ত হয় এবং সবশেষে ২০০৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি মারা যায়। ডলি শুধুমাত্র যে একটি ক্লোন ভেড়া ছিল তা নয় এটি ছিল গোটা দুনিয়ার ক্লোন বিজ্ঞানীদের প্রেরনা। তারা এই ডলির মধ্য দিয়েই সফল ক্লোন মানবের সপ্ন দেখেছিল।
প্রথম ক্লোন ভেড়া 'ডলি' সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা আরো বেশি ব্যাস্ত হয়ে পড়েন ক্লোন গবেষণায় যাকে বলে আদা জল খেয়ে নামা। তারা আস্তে আস্তে অন্যান্য প্রানীর মাঝে ক্লোনিং প্র্যাক্টিস করা শুরু করে। ডলি জন্ম হওয়ার পর আরো একটি সফল ভেড়ার ক্লোনিং করা হয়েছিল যার নাম 'ডলি' নামের সূত্র ধরে রাখা হয় 'পলি'। আর এই পলিকে তৈরিতে যে প্রানীটির কোষ ব্যবহার করা হয় তার নাম শুনলে আপনি রিতিমত চমকে উঠবেন। এই প্রানিটি ক্লোনিঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছিল মানুষের কোষ এবং তা সফলভাবে ব্যবহার করা হয়। আরেকটি ক্লোনের জন্ম হয় ১৪ফেব্রুয়ারিতেই তবে সেটা ছিল ২০০২ সালে। এটি ছিল একটি বিড়াল। এর নাম দেয়া হয়েছিল ডাবল সি অর্থাৎ কার্বন কপি। এটি বেশিদিন বাচঁতে পারে নি। ঐ সালের ২২ ডিসেম্বর মারা যায় বিড়ালটি। এ ছাড়াও মজার ব্যাপার হল একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রানী ম্যামথ এর দেহের অক্ষত অংশ থেকে নেয়া জীন থেকে ক্লোনিং এর মাধ্যমে এই প্রানীটিকে পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
এখন আসা যাক ক্লোনিং এর সফলতার হার সম্পর্কে। ক্লোনিং সফলভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হলেও একটি প্রানীর ক্লোনিং যে নিশ্চিতভাবে সফল করা যাবে এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক। আগেও আলোচনা করেছি যে ক্লোন ভেড়া ডলিকে জন্ম দেয়ার সময় ২৭৬ বার বিফল হতে হয়েছে এবং প্রতি বারই একটি করে ভ্রুন নষ্ট হয়ে যায়। তাই এই ক্ষেত্রে সফলতার হার খুবি ক্ষীণ। বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা যায় মানব ক্লোনিং এর ক্ষেত্রে সফলতার হার মাত্র ০.১-৩%।
এতক্ষন কত কথা বলা হল অথচ প্রথম ক্লোন মানব কে ছিল তাই বলা হল না। পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানবক্লোন শিশুটি হল কন্যা । এর নাম দেয়া হয় ইভ। এর জন্ম হয় ২৬ ডিসেম্বর, ২০০২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানব গবেষনা কেন্দ্র ক্লোনেইড সংস্থা কতৃক সৃষ্ট এই ক্লোনের মা হল আমেরিকান এক মহিলা যার বয়স ছিল ৩১ বছর। ক্লোনটিকে রেইলিয়ান নামের একটি ক্ষুদ্র ধর্মগোষ্ঠীর অধিনে জন্মানো হয়। মজার ব্যাপার হল শিশুটির মা একজন আমেরিকান হলেও কোন দেশে এবং কোথায় এর জন্ম এটি আজো জানা যায় নি। ধারনা করা হয় এই শিশুটি আমেরিকার বাইরে তৃতীয় বিশ্বের এমন কোন দেশে জন্মানো হয়েছে যেখানে মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ করা হয়নি। ক্লোনটির সর্বপ্রথম তৈরিকৃত প্রতঙ্গ টি ছিল নাক। এই কন্যাশিশুটি সিজারিয়ান সেকশন অপরেশনের মাধ্যমে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়। শিশুটি জন্মের সময় ওজন ছিল ৭ পাউন্ড যা একটি সাধারন শিশুর ওজনের সমান ছিল। গোপন সূত্রে আরো জানা যায় যে এই শিশুটির মা বাচ্চাটিকে ক্লোন করার জন্য খুবি উৎসাহী ছিলেন কারন তার স্বামী সন্তান সন্ম দানে অপারগ ছিলেন। ব্রিগিট বোয়াসিলিয়ে, একজন রসায়নবিদ যিনি ক্লোনেড সংস্থাটির সিইও তিনি জানান ক্লোন শিশুটি খুবি স্বাস্থ্যবতী এবং তার বাবা মা তাকে নিয়ে খুবি সন্তুষ্ট।
এতক্ষন আলোচনা করা হল মানব ক্লোনিং এর গুনগান নিয়ে। এই ক্লোনিং সফলভাবে প্রয়োগ করা গেলে মানুষ যেমন লাভবান হবে তেমনি মানব নৈতিকতার অবক্ষয় হবে বলে পৃথিবীর অনেক মানুষই এর বিরোধিতা করে। প্রথম ক্লোন মানব ইভ এর জন্মের খবর প্রকাশের পর পরই গোটা বিশ্ব বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। লাখ লাখ মানুষ Clone=cruelity ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। মানব ক্লোনিং নৈতিকতা বিরোধী কিনা এটি ক্লোনিং এর পথে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। একটি ভেড়া তৈরিতে যদি ২৭৬ বার বিফল হতে হয় তাহলে মানব ক্লোনিং করতে অসংখ্যবার বিফল হতে হবে। প্রতিটি বার নস্ট হয়ে যাওয়া প্রানীভ্রুনের মৃত্যুর দায়ভার কে নেবে? সে আসলে কার শরীরের অংশ সেটা খুজে পাওয়াটা আরেকটি বড় ব্যাপার। ক্লোন মানবটির বয়স হবে ঠিক তত যা তার উতস মানবটির সমান। তাহলে কি ক্লোন মানব তার শৈশব, কৈশর সকল প্রকার জীবনের আনন্দ, অনুভূতি থেকে বঞ্চিত হবে? এসব অনুভূতি থেকে যদি একজন মানুষ বঞ্চিত হয়ে পড়ে তাহলে এক পর্যায়ে সে বিষাদে আক্রান্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা তার বংশ, পিতৃপরিচয়, সংস্কৃতি কি হবে তা খুজে বের কতা সত্যই খুবি কঠিন ব্যাপার হবে। আরেকটি কথা হল ক্লোন মানব কখনও তার উতস মানবটির সন্তান বলে বিবেচিত হতে পারে না। সে হবে তার ভাই অথবা বোন। এই বিষয়টি কি সত্যি স্পর্শকাতর নয়? তার উতস মানবটিকে সে কিভাবে নেবে সেটাও খুব বড় বিবেচনার বিষয়। এছাড়া ক্লোন মানবদের জীনোম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে কাজ করেনা, ফলে ক্যন্সার ছাড়াও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সাধারন যৌন প্রজননের ক্ষেত্রে বাবা মা দুজনের দেহ থেকেই ডিএনএ সন্তানের দেহে ট্রান্সফার হয়, এবং কেবলমাত্র একটি জীন ই কার্যকর থাকে।কিন্তু যেহেতু ক্লোন মানবের ক্ষেত্রে জীন শুধু একজনের কাছ থেকেই আসে সেহেতু তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হয়। ক্লোন মানব নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয় হচ্ছে ধর্ম। পৃথিবীর মোটামুটি সকল প্রধান ধর্মীয় নেতারা ক্লোনিংকে মোটেও ভাল চোখে নিচ্ছেন না। তাদের মতে এটি পুরোপুরি মানুষের বংশ ধারা এবং স্বাভাবিক বিবর্তনের পরিপন্থী। এ সকল বিষয়কে সামনে রেখে ক্লোনিং খুবি খুবি বিতর্কিত এবং স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে এখনো পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে গণ্য হয়ে আসছে।
ক্লোনিং এর মাধ্যমে মানব উতপাদন এর নৈতিক দিক বিবেচনা করে জাতিসংঘ ১২ ডিসেম্বর ২০০১ সালে সাধারন পরিসদের বৈঠকে একটি বিল উত্থাপন করে। সেখানে মানব ক্লোন গবেষণা নিষিদ্ধ করার পক্ষে ৮৪টি দেশ, বিপক্ষে ৩৪টি দেশ এবং ৩৭ টি দেশ নিরপেক্ষ ভোট দেয়। এভাবে ক্লোনিং নিষিদ্ধ আইন পাশ করা হয়। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় মানব ক্লোনিং নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।
এখন জানা যাক এই ক্লোন মানব বা কৃত্রিম উপায়ে তৈরি মানব পৃথিবীর বুকে মুক্তভাবে কি আসলেই ঘুরে বেড়াতে পারবে কিনা এই প্রশ্ন। মার্কিন চিকিৎসক পানাইওটিস জাভোস বলছেন, কয়েক বছরের মধ্যেই এ বিতর্কের অবসান হবে। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ইনডিপেনডেন্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেন ১৪টি মানব ভ্রূণ তিনি ক্লোন করেছেন। এর মধ্যে ১১টি ভ্রূণ চারজন নারীর গর্ভাশয়ে ইতিমধ্যে প্রতিস্থাপন হয়েছে। তবে এদের কেউই গর্ভবতী হননি। ক্লোন শিশু জন্মদানের বিষয়ে তারা বেশ আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষাটি আপাতত সফল হয়নি। জাভোস জোর দিয়ে বলেন ত্বকের কোষ থেকে ক্লোন শিশু তৈরির ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম অধ্যায়। এ ছাড়া ওই চার নারী কেন গর্ভবতী হননি তাও তাদের জানা বলে তিনি জানান। তাই বলা যায় তাদের চেষ্টাকে আরও জোরদার করতে পারলে দু-এক বছরের মধ্যেই প্রথমবারের মতো ক্লোন শিশু জন্ম নেবে বলে তিনি জানিয়েছেন। সাইপ্রাস বংশোদ্ভুত মার্কিন নাগরিক জাভোস মধ্যপ্রাচ্যে গোপন কোনো স্থানে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশে মানব ক্লোন নিয়ে গবেষণা নিষিদ্ধ। তবে তিনি ইতিমধ্যে তিনজন মৃত মানুষের ভ্রূণের ক্লোনও করেছেন। এদের মধ্যে ১০ বছরের একটি শিশু ছিল। কাডি নামের এ শিশুটি যুক্তরাষ্ট্রে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল। শিশুটির রক্তের কোষ বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করে জাভোসের কাছে পাঠানো হয়েছিল। বন্ধ্যত্ব দুরীকরণের চিকিৎসায় নিয়োজিত মূলধারার বিশেষজ্ঞরা জাভোসের এসব দাবির প্রতিবাদ জানান। ক্লোনের কৌশলটি নিরাপদ কি না তা নিয়ে এসব বিশেষজ্ঞ প্রশ্ন তুলেন। ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের লর্ড উইনসটন বলেনছেন জাভোসের দাবির বিজ্ঞানভিত্তিক কোনো প্রমাণ তারা খুজে পান নি। তবে জাভোস জানান মানব ক্লোনবিরোধী নীতির কারণে কয়েকটি বিজ্ঞান সাময়িকী তার গবেষণা প্রবন্ধ ছাপাতে রাজি হয়নি। এ ছাড়াও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জন গার্ডন আশা ব্যাক্ত করেছেন যে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে আমরা পরিপূর্ণ ক্লোন মানবকে আমাদের পৃথিবীতে ঘুরে ফিরতে দেখতে পাব। তিনি গত শতাব্দির ৫০ দশকে একটি ব্যাং এর ক্লোন করেছিলেন। এবং ১৯৯৬ সালে সফল ভেড়ার ক্লোন 'ডলি' উদ্ভাবনের পর তিনি এই আশা ব্যাক্ত করেন।
যদিও মানব ক্লোনিং নিয়ে বিশ্বের নেতৃবর্গ এবং ধর্মীয় নেতাদের মাঝে খুব বেশি বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায় তবুও বিশেষজ্ঞগন ভিন্নমত প্রকাশ করেন। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার জন গার্ডন বলেন যদিও টেস্টটিউব বেবির জন্মের কারনে প্রথম দিকে মানুষের মাঝে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তবুও পরবর্তীতে মানুষ এটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। তেমনি একটি পর্যায়ে মানুষ মানব ক্লোনকেও স্বাভাবিকভাবে গ্রহন করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। দুর্ঘটনায় হারানো প্রিয়জনের শূন্যস্থান পূরনে, বন্ধত্য দূরীকরণে, এছাড়াও সমাজের উপকারি ব্যাক্তিদের ফিরে পেতে মানুষ ভবিষ্যতে ক্লোনিংকে মেনে নেবে মানুষ এটাই বিজ্ঞানীদের আশা। এবং আশা করা যায় এই ক্লোনকে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর সর্বময় এবং বৃহৎ মঙ্গল বয়ে আনা যাবে।
এখন আমরা দেখি ক্লোন মানব যদি সত্যি তৈরি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে তাদের আত্নীয়তার সম্পর্ক কেমন হবে। এটি সত্যি একটি বারনিং কুয়েশ্চেন। কারন যে মানুষটির শরীর থেকে কোষ নিয়ে ক্লোন করা হবে তার সাথে ক্লোন মানবটির কখনই সম্পর্ক বাবা সন্তানের হবে না। যদিও ব্যাপারটি আমাদের সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু তবুও এটাই সত্য যে এই দুইজনের সম্পর্ক হবে জেনেটিক ভাই-ভাই অথবা ভাই-বোন। এ ক্ষেত্রে মানুষটির অভিভাবক কে হবে, ভরন পোষণের দায়িত্ব কার থাকবে, মানুষটি তার নিজ পিতৃ-মাতৃহীন পরিচয় কিভাবে গ্রহন করবে এসব প্রশ্ন রয়েই যায়। পৃথিবীর সকল বুদ্ধিজীবিগনই একমত পোষণ করেন যে মানব ক্লোনিং চিরচারিত সকল পারিপারিক বন্ধনকে ছিন্ন করে। একারনে আমাদের প্রশ্ন থেকেই যায় মানব ক্লোন কি তাহলে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্কগুলোর উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে?
ক্লোন সম্পর্কে মানুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রশ্নটি হচ্ছে ক্লোন মানবটি কি তার সোর্স মানুষটির হুবহু হবে অথবা কার্বন কপি হবে? অনেকেই বলে থাকেন ক্লোন মানে হচ্ছে একজন মানুষের কপি করা আরেকজন মানুষ। কথাটি কি সত্যি যৌক্তিক? ক্লোন যেহেতু জিন রিপ্লেস্মেন্ট এর মাধ্যমে করা হয় তাহলে দেখা যাক সাধারনত আমাদের জেনেটিক সম্পর্কগুলো কেমন হয়। আমরা সাধারনত আমাদের পরিবারের কাছের মানুষ বা রক্তের সম্পর্কের লোকদের সাথে জেনেটিক মিল বহন করি। আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি, নানা-নানি ইত্যাদির সাথে আমাদের জেনেটিক মিল খুজে পাওয়া যায়। তাদের সাথে জেনেটিক মিল থাকা মানে আমাদের গায়ের রং, দেহের গঠন, কথা বলার ভঙ্গি, চালচলন ইত্যাদিতে আমরা আমাদের জেনেটিকালি সিমিলার লোকগুলোর সাথে মিল খুজে পাই। কিন্তু তাই বলে কি আমাদের চিন্তা-ভাবনা, কথা-বার্তা, আচার-আচরন হুবহু এক হয়? না, এটা হয় না। আমরা একি পরিবারে বাবা-ছেলে, ভাই-বোন ইত্যাদি একেকজনের একেক মত দেখি। তাদের মাঝে অনেকসময় ধর্মীয়, রাজনৈতিক অনেক প্রকার মতপার্থক্য দেখা দেয়। সুতরাং জিন একি রকম হলেও ক্লোনিং-এ আমরা মানুষের মস্তিষ্ককে কপি করতে পারছি না। তাই ক্লোন মানবটি তার চারদিকে সমাজে এবং পরিবেশে যা যা লক্ষ্য করবে তার উপর ভিত্তি করে নিজের মতামত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে। এবং সে দেখতে প্রায় আগের মানুষটির মত হলেও ঐ মানুষটির কপি হবেন এটা ভাবার কোন কারন নেই। একজন ক্লোন মানব তার মানুষিক বৈশিষ্টে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হবে।
বিজ্ঞান কখনও থেমে থাকেনা তেমনি ক্লোনিং এর ভবিষ্যৎ থেমে থাকবে এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। ক্লোনিং এর মাধ্যমেই দুনিয়ার অনেক বড় বড় অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। যদি বিজ্ঞানীদের আশা সত্যে প্রমানিত হয় তাহলে আমরা আগামী ৫০ বছরের মাঝেই ক্লোন মানব দেখতে পাব এবং এটি হবে এই পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন একটি অধ্যায় এর সূচনা। তখন হয়তো মানুষের প্রিয় কোন ব্যাক্তিকে আর হারানোর ভয় থাকবে না, ফিরে পাব পৃথিবীর ইতিহাসে অমর ব্যাক্তিদের আবার আমাদের মাঝে, পৃথিবীর কোন মা-ই আর সন্তানহীন অবস্থায় জীবন কাটাবেন না। আর এই ব্যাপারগুলোকে আমাদের দেখতে হবে আর উদার দৃষ্টিতে, মানব সমাজের মঙ্গলবার্তা হিসেবে। তবেই মূলত ক্লোন প্রকৌশলের সফলতা আসবে। এখন শুধুই আমাদের ভবিশ্যত পানে চেয়ে থাকার পালা। -মোঃ ইজাজ মাহমুদ