somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছেলেটি যেভাবে মেয়ে হয় (গল্প)

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পোড়খাওয়া জীবনটা যে এতো তাড়াতাড়ি রঙিন হয়ে উঠবে, কিছুদিন আগেও কি ভাবতে পেরেছিলো মশিউর?
ভুগছিলো দারুণ হতাশায়, চারদিক ঢেকে যেতে শুর“ করেছে আন্ধা-কালো অন্ধকারে ঠিক তখনই পথের দিশা হয়ে উন্মোচিত হয়েছে অন্য এক জগৎ। অবশ্য এ জগৎ তার কাছে নতুন হলেও অন্য অনেকের কাছে পুরোনো হয়ে গেছে। অনেক আগেই। নতুন হোক আর পুরোনোই হোকÑনামধাম কম না। বিশ্বজুড়েই সুনাম-সুখ্যাতির জোয়ার যে অকারণে নয়, সম্পৃক্ত হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিলো মশিউর।
জিনিসটার নাম ফেসবুক। বলা হয়ে থাকে, এ শতাব্দীতে একজন মানুষ জš§াবে কিন্তু ফেসবুকে তার একটা এ্যাকাউন্ট থাকবে নাÑহতেই পারে না! বাসায় কম্পিউটার এসেছে অনেক আগেই। কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ এসেছে মাসখানেক হলো। তাও বড়ভাইয়ার কল্যাণে। ভাইয়া একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি পেয়েছেন। প্রাইভেট ফার্মের চাকরি মানেই তো গাধার খাটুনি, বসদের চাহিদা ফুলফিল করা; কিন্তু তারপরও যদি মন ভরতো তাদের! কাজটা গবেষণা-জাতীয়, দিনের বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেটেই কাটাতে হয়। কিন্তু তারপরও সব কাজ শেষ হয় না, কিছুটা থেকেই যায়। এই ‘কিছুটা’ থেকে যাওয়া কাজ সারতে ভাইয়া বাসার কম্পিউটারে ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিয়েছেন। অফিস থেকে ফেরার পর মোটামুটি ঘণ্টাদুয়েক রেস্ট নেন তিনি। পত্রিকা পড়েন। কখনোবা ভাবির সাথে মৃদু খুনসুটি অথবা মধুর ঝগড়া করেন। তারপর শুর“ হয় কর্মযজ্ঞ। সে কাজ কখনো কখনো চলে মোটামুটি মাঝরাত পর্যন্ত। সকালে আবার নয়টার মধ্যেই অফিসে দে ছুট। এসময় থেকে সারাদিন ইন্টারনেট সংযোগের ছুটি। যেহেতু ভাইয়া ছাড়া অন্যদের কম্পিউটারে কোনো কাজ থাকে না, নাটক-সিনেমা দেখার দিকেও মনোযোগ নেই বাসার কারো। ভালোই হয়েছে। এই ছুটিটাকে কাজে লাগাতে শুর“ করে মশিউর। একদিন কী মনে করে কম্পিউটার চালু করে। দরকার হয়নি বলে এর আগে ব্যবহার করতো না। অনেকটা সখের বশেই বসা। ইন্টারনেট সম্বন্ধে সে যে জানে না তা নয়, কিন্তু সেভাবে ব্যবহার করেনি। এখন ঘরের ভেতরই যখন আছে, ব্যবহার করবে না কেন! মাস শেষে ব্যবহার করলে বিল যা, না করলেও তো তাই। ইন্টারনেট লাইন চালু করে দুই-তিনটা জাতীয় দৈনিক পড়ার পর মশিউরের মনে হলোÑধুর, ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়ার কী আছে! শুধু শুধু সময় নষ্ট। কী কী করা যায়, আর কী করা উচিৎ ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো ফেসবুকের নাম। সাথেই সাথেই ফেসবুকে একটা এ্যাকাউন্ট খুলে ফেলে সে। এ্যাকাউন্ট খোলা খুব সহজ। ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট খোলার চেয়েও কম ঝক্কি। প্রথম প্রথম তেমন কিছু বুঝতো না। কিন্তু ব্যবহার করতে করতে মাসখানেকের মধ্যেই ‘পাক্কা খেলোয়াড়’ হয়ে উঠলো সে। এখন স্ট্যাটাস দেয়া, চ্যাট করা, বার্তা পাঠানো, পোক করা, ট্যাগ করা, কমেন্ট করাÑসব কাজেই সিদ্ধহ¯— মশিউর। এই করেই চলছিলো। এটা আসলেই ভীষণ রকম নতুন দুনিয়া। ¯^প্নেরও। কীভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেটে যায়, টেরও পাওয়া যায় না। এখানে সবাই সবার বন্ধু। যে বন্ধু না, তাকেও খুব সহজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধু বানিয়ে নেয়া যায়। মশিউরের ফ্রেন্ড লিস্টে তো কমসে কম ১০ জন নায়ক-নায়িকা ও মডেল রয়েছে। যাদের দেশের সবাই এক নামে চেনে। বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোও বড় একটা কাজ। এ এক অলিখিত প্রতিযোগিতা; নিঃশব্দেই যেন সবাইকে চ্যালেঞ্জ জানানোÑদ্যাখো বাছা, আমার কত বন্ধু! বন্ধু বাড়ানোর পাশাপাশি বন্ধুদের রকমারি স্ট্যাটাস পড়া, স্ট্যাটাসের হাজারো রকম মন্তব্য পড়তে এবং মন্তব্য দিতে ভালোই লাগে। এভাবেই দিন-ণগুলো মধুর থেকে মধুরতম হয়ে ওঠে।
নিজেও প্রতিদিন এক বা একাধিক স্ট্যাটাস দেয়। আজ খুব বৃষ্টি হয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজলাম অনেকণ কিংবা আগামীকাল কনসার্টে যাচ্ছি, টিকিট কাটা হয়নি এখনোÑজাতীয় স্ট্যাটাসের কমতি হয়নি কখনো তার। অবশ্য কারোই কমতি হয়নি। স্ট্যাটাসে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই যা মনে আসে তা-ই লেখে। সবাই এ কাজটা করে, তাই সেও পিছিয়ে থাকে না।
মশিউর কিছু একটা নিয়ে ব্য¯— আছে, আনন্দে আছে এটা বাসার মানুষদের সইবে কেন! তারা দ্বিগুণ উৎসাহে শুর“ করলো ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান। সে অনার্স পাস করে বসে আছে। মাস্টার্সে এ্যাডমিশন নেয়ার অপো এখন। কিন্তু পরিবারের সবার দাবিÑভাইয়ার একার পে এতোবড় সংসার টেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। মশিউরও যেন কিছু একটা করে। এই দুর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা অবসর নিয়েছেন দুই বছর হলো। ডাক বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারি ছিলেন, যৎকিঞ্চিত টাকা পেনশন পান। কিন্তু এ টাকায় কিছুই হয় না। তার ওপর আবার এই অসুখ সেই অসুখ বাঁধিয়ে বসে থাকেন প্রায়ই। পেনশনের টাকার সিংহভাগ তার ওষুধ কেনার পেছনেই খরচ হয়। মা আপাদম¯—ক গৃহিণী। বাঙালি মায়েরা ঘরকন্না ছাড়া কবে আর কী করতে পেরেছে! বড়জোর বলতে পারেÑঅমুক ছেলের অমুক চাকরি হলো, তমুকের ছেলে তো বয়সে তোর চেয়েও ছোট, সে এতো ভালো একটা চাকরি পেলে তুই মামুলি একটা চাকরিও পাচ্ছিস না!?
আর আছেন ভাবি। কোনো মানুষ যে এরকম হতে পারে ¯^চে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সারাণ সাজগোজ নিয়ে ব্য¯—। কতণ এ-পোশাক তো কিছুণ পর আরেক পোশাক পরবেন। মুখে এটা-ওটা কত কী মাখানো তার নিত্যদিনের কাজ। কাঁচা হলুদ বাটা, কখনোবা রান্না করার জন্য শশা, সালাদের খিরা গালে ঘষে ঘষে শেষ করে ফেলবেন। এটার নাম নাকি রূপচর্চা। প্রথম প্রথম, যখন নতুন বিয়ে করে এ বাসায় উঠেছেন, সময়ভেদে সবাইকে বলতেনÑদেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে? কিন্তু যেই না সবার বিরক্তিটুকু টের পেলেন, তারপর থেকে আর বলেন না। তাই বলে রূপচর্চা থেমে নেই, একা একাই করেন। সার্বণিক সঙ্গী আয়না। বিভিন্ন পোজ নিয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। দেখে আর নিজে নিজেই মুগ্ধ হোন। মুগ্ধতার ডালপালা এমনই ছড়ায় সে ডালে কখনো-সখনো মশিউরও ধাক্কা খায়। এতে রাগ হয়, জিদ হয় হয় তার। এ দৃশ্য যে-ই দেখবে তারই গা জ্বালা করবে। প্রথম প্রথম মশিউরদেরও করতো। কিন্তু এখন সবার কেমন যেন সয়ে গেছে। রূপসচেতন এ-মহিলা এমএ পাসÑকে বিশ্বাস করবে এসব কর্মকাণ্ড দেখলে বা শুনলে? আসলেই শিা সব মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে না। কেউ কেউ থেকে যায় মূর্খের মূর্খ হয়ে।
মশিউর এখনো ছাত্র, অথচ তাকেই কিনা বলা হয় পরিবারের আয়-রোজগার বাড়ানোর জন্য। কেন, ভাবিকে দেখে না কেউ? তিনি তো পরিপূর্ণভাবে চাকরি করতে সম। বাসায় থেকে থেকে কোন রাজ্যটা উদ্ধার করছেন তিনি। ভাইয়াও বোধহয় চান না, ভাবি চাকরিবাকরি কিছু একটা কর“ক। হয়তো তার মনোগহীনে লুকিয়ে থাকা চাওয়াÑশুয়ে-বসে থেকে, খেয়ে-খেয়ে ভাবি শরীরের মেদ বাড়াক। তাতে পুর“ষ হিসেবে আরাম হবে তার!
এমনটি ভাবে, আবার পরণেই অনুশোচনাদগ্ধ হয়ে জিভে কামড় দেয় মশিউর। ভাইয়া এমন নন, অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা, মার্জিত র“চির ¯^তন্ত্র মানুষ।
চেষ্টা তো মশিউর কম করেনি। সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে সে শুর“ করেছিলো টিউশনি। একটা ছাত্রকে পড়াবে, সপ্তাহ-য় চারদিন। বিনিময়ে পনেরো শ টাকা। কিন্তু প্রথম মাসে যখন সে বেতন হাতে পায়, দেখা গেলো একটা ৫০০ টাকার নোট জাল! গৃহশিককে যারা জাল টাকা গছাবার তালে থাকে, তাদের সাথে আর যাই হোক কোনো সম্পর্ক রাখা যেতে পারে না। মাস ছয়েক পর যা-ও আরেকটা ধরলো কিন্তু তাদের পরিবেশিত না¯—ার মধ্যে পাওয়া যেতে শুর“ হলো চুল, বালি, পাথরকুচিসহ নানা অখাদ্য। একদিন হালুয়া ভেদ করে অ¯ি—ত্ব জানান দিয়ে বেরিয়ে এলো আ¯— একটা তেলাপোকা। সুতরাং সেখানেও পড়ানো হলো না। মাসের বিশদিন পর্যন্ত পড়িয়েছিলো; তারপর কোনো টাকা ছাড়া এবং বিনা নোটিশে টিউশনিটাকে ক্যান্সেল করেছে। দেশের সব মানুষই বোধহয় র“চিহীন বর্বর হয়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে টিউশনির কথা শুনতেও পারে না মশিউর। কেবলই মনে হয়, টিউশনি মানেই উল্টাপাল্টা কিছু। কিন্তু এসব যুক্তি পরিবার মানবে কেন? টিউশনি কি আর মানুষ করছে না! তাদের এক কথা, মশিউর চেষ্টা করছে না। করলেও সেটা লোকদেখানো। সে যে চাকরির জন্য চেষ্টা করেনি বা করছে না, তাও মোটেও নয়। কিন্তু না হলে কী-ইবা করতে পারে। চাকরিদাতাদের ধরে বেঁধে পিটিয়ে তো চাকরি নেয়া যায় না। বাবা-মা যে আচরণ করা শুর“ করেছেন তা রীতিমতো অপমানজনক। ছেলেরা উচ্ছন্নে গেলে অভিভাবকরা যে রকম বিরক্ত হয়, তাদের বিরক্তি আরো বেশি মাত্রার। ভাইয়া সরাসরি কিছু বলেন না, তবে হাবভাবে বোঝা যায় তার অসন্তুষ্টি। আর ভাবি? তার কিছুই বোঝা যায় না; পুরোপুরি ‘নির্দলীয়’ তিনি।
এমন গুমোট পরিস্থিতিতে ফেসবুকের সন্ধান পেয়েছে মশিউর। সুতরাং তার ভালোলাগা, পুলক অন্যদের চেয়ে ¯^ভাবতই আলাদা হবে, বেশিও। নির্ভাবনায় দুটো মুহূর্ত কাটাতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে এই দেশে, এই সময়ের ফেরে পড়া মানুষদের জন্য। আহা, আরো আগে কেন যে ফেসবুকের সন্ধান পায়নি। বাসায়ও কেন নেট আসেনি। মজাটুকু বুঝতে পারলে প্রয়োজনে সাইবার ক্যাফেতে বসে ঘণ্টা হিসেবে ব্রাউজিং করতো। ঘণ্টায় ২০/৩০ টাকায় যদি এমন সব অসাধারণ প্রাপ্তি ঘটে তবে কেন সেদিকে ছুটবে না! হালে মশিউরের কম্পিউটারের সামনে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকায় বকাবাদ্যি, কথা শোনানোর প্রকোপ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কটুকথায় আজকাল তার কিছুই হয় না। বলতে গেলে কানেই ঢোকে না। বাবা-মা বকে বকে কান্ত হন। ভাইয়াও এদ্দিনে জেনে গেছেন মশিউরের ইন্টারনেট আসক্তির কথা। কিন্তু তেমন কিছুই বলেননি কখনো। শুধু ভাবি মাঝে-মধ্যে পাড়া বেড়ানোর মতো ঘর-বেড়াতে আসেন। মশিউরের ফেসবুক সার্ফিং দেখেন নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে। যেন কোনো কিছুতেই তার রা নেই। যা দেখেন, সবকিছুকেই ¯^াভাবিক মনে হয় তার। একদিন মশিউরের ব্রাউজিং দেখে আহাদি কণ্ঠে বললেন, ‘কোন সুন্দরীর দিকে তোমার চোখ পড়েছে গো? যেভাবে একের পর এক ছবি দেখেই যাচ্ছো!’
প্রিয়তি প্রিয়দর্শিনী নামে এক মেয়ের এ্যাকাউন্টের ফটো এ্যালবামে ঢুকেছে মশিউর। রাইট এ্যারো ইউজ করে একের পর ছবি দেখে যাচ্ছে সে। ছবিও এসেছে স্ক্রিনজুড়ে। নামের মতোই মেয়েটি সুন্দরী, সন্দেহ নেই। অবশ্য নামটা সত্য নাকি বানানো কে জানে। মনিটর থেকে চোখ না সরিয়েই মশিউর ভাবির কথার জবাব দেয়Ñ‘খুঁজছি। তবে তোমার মতো সুন্দরী কাউকে এখনো পাইনি।’
শুনে খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠেন ভাবিÑ‘যাহ, আমি আর কী এমন সুন্দরী!’
‘আমি মিথ্যা বলেছি কিনা, তুমি বিপাশা বসুকেই জিজ্ঞেস করে দেখো। অবশ্য কখনো যদি তার দেখা পাও।’
বিপাশা বসু ভাবির প্রিয় নায়িকা। এ তুলনায় ভাবি আরো খুশি হয়ে ওঠেন। খুশির চোটে নিজ হাতেই মশিউরের জন্য চা বানিয়ে আনেন। এখানেই শেষ নয়। খাবার সময় নিজের পাত থেকেই মশিউরের পাতে বিশেষ তরকারিটা একটু তুলে দেন। তারপর তরকারির গুণকীর্তন করেন কিছুণ। মশিউর যে প্রশংসা করেছে, প্রশংসার সুযোগটা নেন ভাবি। পরদিন স্লিভলেস ব­াউজ, আর জর্জেট শাড়ি পরে এসে দাঁড়ান সামনেÑ‘দ্যাখো তো, আমাকে কেমন লাগছে?’
‘সত্য বলবো, না মিথ্যা?’
‘মিথ্যা বলবে কেন, সত্যটাই বলো।’
‘আফ্রোদিতের মতো!’
‘আফ্রোদিতে-টা কে?’
‘গ্রিক পুরাণের একজন দেবী। খুব নামকরা।’
ভাবি চোখ-মুখ কেমন যেন কালো করে ফেলেন। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন রক্তমাংসের সেলিব্রেটি তর“ণীর সাথে তুলনা। কিন্তু তা না হওয়ায় অনেকটা নিঃশব্দেই চলে যান। ক’দিন কাছ ঘেষেন না। ফিরে এসেছে আগের মতোই নৈর্বক্তিক দৃষ্টি। নিরাসক্ত, নির্বিঘœ। ঘর-বেড়াতে ঠিকই আসেন। কিন্তু সেটা ওই বেড়ানোতেই সীমাবদ্ধ। অগ্রসর হয় না। মাঝে-মধ্যে চায়ের পিপাসা অনুভব করলে বলতে মন চায়Ñ‘তোমাকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে ভাবি! বিশ্বাস না হলে আয়না দেখো।’
তখন হয়তো ভাবি খুশিটা চাপা দিয়ে বলতেনÑ‘আজ তোমার চোখ সুন্দর হয়ে গেছে, ভাই।’
মশিউরও পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে বলতোÑ‘না, সত্যি বলছি। আমার চোখের কথা বাদ দাও, তোমার চোখ তো জš§ থেকেই সুন্দর! টানা টানা। আচ্ছা ভাবি, তোমার নাম প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা ক্যাটরিনা কাইফ না হয়ে তামান্না ইয়াসমিন হলো কেন!’
তখন ভাবি হয়তো বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেনÑ‘নামের ওপর কি আর মানুষের নিজের হাত থাকেরে ভাই!’
এই প্রশংসার চোটে মশিউরকে আমড়া কাঠের ঢেঁকি জ্ঞান করা ভাবিও মোটামুটি এক সপ্তাহ নিরূপদ্রবে সার্ভিস দিতেন। সময়মতো একটু চা, ময়লা হয়ে যাওয়া পোশাকটা ধুয়ে দেয়ার কথা বলাসহ তক্কে তক্কে থাকতেন কীভাবে মশিউরের প্রশংসার প্রতিদান দেয়া যায়। প্রশংসা এমন জিনিস, কেউ কাউকে এটা দিলে দাতার প্রতি একটা দায় তৈরি হয়!
কিন্তু বাড়তিটুকু হ্যাপাটুকুর কথা ভেবে আর সে পথে অগ্রসর হয় না মশিউর। তাই বলে কাজও থেমে থাকে না। সে পূর্ণোদ্যমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকে। বন্ধু সংখ্যা বাড়ানো, অল্প সময়ে কমসে কম এক হাজারে উন্নীত করাই তার ব্রত। তাই সে একের পর রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকে। যদিও এ্যাকসেপ্ট হয় বড়জোর ১০ ভাগ। কারণটাও বুঝতে পারে, অন্যরা নিশ্চয়ই তার মতো সারাদিন কম্পিউটারের সামনে বসে থাকে না। এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়, যারা সারাজীবনের জন্য এ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছে আর হাত দেবে না তাতে। প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু যখন, প্রয়োজনীয় জায়গায় বলতে তো পারবেÑআমারও ফেসবুক এ্যাকাউন্ট আছে! ছেলেদের অনায়াসেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারছে মশিউর কিন্তু মেয়েদের বেলায় গেলেই সমস্যা। অবশ্য এটা ঠিক, ছেলেমেয়ে যাকেই পাঠানো হোক, রিকোয়েস্টের মূল্য তেমন একটা পায় না সে। মেয়েদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে তো আরো বড় বৈষম্যে পড়তে হয়! বাংলা ইংরেজি মিলে কত রকম কথা যে অটো সার্ভার যোগান দেয়Ñতুমি কি সত্যি সত্যিই তারে চেনো, সুস্থ ম¯ি—ষ্কে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছো তোÑজাতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় হয় প্রায়ই। চিনি বললেও কাজ হয় না। বাধা অগ্রাহ্য করে সামনের দিকে অগ্রসর হলেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ব­ক। প্রথমে ২ দিন, তারপর ৪, ৭ থেকে শুর“ করে টানা ১ মাস! এর বেশি হলে বোধহয় এ্যাকাউন্ট ব­ক করে দেবে। কিন্তু পরাজয়ে বীর ভীত হবে কেন! যথারীতি মশিউর সুন্দরী মেয়েদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় আর শুনতে হয় ভার্চুয়াল ধমক-
উড় ুড়ঁ শহড়ি ঃযরং ঁংবৎ ঢ়বৎংড়হধষষু? ঞড় ঢ়ৎবাবহঃ সরংঁংব ড়ভ ঋধপবনড়ড়শ, ঃযরং ৎবয়ঁবংঃ পধহহড়ঃ নব ংবহঃ. ঞড় ষবধৎহ সড়ৎব, ঢ়ষবধংব ারংরঃ ঃযব ঐবষঢ় ঈবহঃবৎ. ওভ ুড়ঁ নবষরবাব ুড়ঁ'ৎব ংববরহম ঃযরং সবংংধমব রহ বৎৎড়ৎ, ুড়ঁ পধহ ৎবঢ়ড়ৎঃ ঃযব ঢ়ৎড়নষবস.
এমন নিয়মকে বাড়াবাড়ি মনে হয়। মার্ক জুকারবার্গ কী সব অদ্ভুত নিয়মকানুন চালু রেখেছেন। সে বন্ধু বাড়াতে চাইলে তাতে মার্কের কী? মার্কের গার্ল ফ্রেন্ডের দিকে হাত বাড়িয়েছে নাকি মশিউর! কোনো বাধাই দমাতে পারে না তাকে। নিজের মতোই রিকোয়েস্ট পাঠাতে থাকে। এ এক নিষিদ্ধ নেশা। নিজেকে থামানো যায় না। বেপরোয়া ভাব প্রদর্শনের ফলে পর্যায়ক্রমে ২, ৪, ৭ দিন ও ১ মাসের জন্য মশিউরের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। এসব েেত্র গুনে গুনে সময় পার করতে হয়। কখন নিষিদ্ধকাল শেষ হবে, কখন আবার পাঠানো যাবে। এবার যখন পুরো একমাসের জন্য ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলো, তার মাথায় হাত। কিছু সুন্দরী মেয়ের তালিকা করেছে সে, পর্যায়ক্রমে এদের রিকোয়েস্ট পাঠাবে। কিন্তু তার আগেই নিষিদ্ধ’র খড়গ! বন্ধু না হলে সবার ছবি আপলোড করা যায় না। ইদানীং ছবি আপলোড করার নেশায়ও পেয়েছে তাকে। কয়েক হাজার ছবি ইতোমধ্যে আপলোড করেছে।
আহা, নারী! নারীর মতো রহস্যময় এবং হৃদয় তোলপাড় করা বস্তু পৃথিবীতে আর কী আছে! পৃথিবীর কয়েক কোটি তর“ণী, তাদের উদ্ভিন্ন যৌবন নিয়ে চোখের সামনে, একটা কিকেই চোখ দিয়ে ছুঁয়ে দেয়া যাচ্ছেÑকী চমৎকার ব্যাপার! ধন্যবাদ মার্ক জুকারবার্গ, একটা কাজের মতো কাজ করেছিস বাপ! তর“ণী হৃদয় ছুঁতে না পার“ক, খুব সহজেই মশিউর ছুঁয়ে দিচ্ছে তর“ণী-শরীর। হোক না তা শুধু চোখ দিয়ে, মন দিয়ে। অনুভবের বিষয় হলেও মন্দ তো লাগে না! এটাই বা কম কী।
চাইলে ছবির মানুষটার সাথে সম্পর্ক তো আরো এগিয়ে নেওয়া যায়। সে নিজেও বুঝে উঠতে পারে না, হঠাৎ করে মেয়েদের প্রতি আগ্রহ এমন বৃদ্ধি পেলো কেন। অন্য অনেকের মতো ওরও প্রেম একটা হয়েছে বটে, কিন্তু সেই মেয়ে যে-ই বুঝে ফেলেছে প্রেমিক তার পাত্তিহীন, অমনিই আলগোছে কেটে পড়েছে। মশিউরও আর ভ্র“পে করেনি। কেউ যেতে চাইলে তাকে যেতে দেয়াই উচিৎ। তারচেয়ে এই-ই ভালো। ভার্চুয়াল সুন্দরীরা দুঃখ দেয় না। অর্থবিত্তপ্রতিপত্তি নিয়েও মাথা ঘামায় না। ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ এড়িয়ে এখানে নিপাট গণতন্ত্রের চর্চা চলে...।
কিন্তু ব­ক করে দেয়ায় হঠাৎ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো বন্ধ গেলো, এখন কী করে! কীভাবে কী করা যায় ভাবতে ভাবতে সমাধানও বেরিয়ে এলো। একেবারে সহজ সমাধান, যদিও একটু ইয়ে...! একটা ফেক আইডি খোলা যায়। এদ্দিনে ফেক আইডি সম্পর্কে ভালোই অবগত হয়েছে সে। সাধারণত কোনো সেলিব্রেটি বা মেয়েদের নাম ব্যবহার করে ফেক আইডি খোলা হয়। এ ধরনের কাজ ছেলেরাই করে বেশি। সব ছেলে না, শুধু বিকৃত র“চির ছেলেরা। ফেক আইডির জন্য প্রয়োজনীয় ছবি জোগাড় করতেও তেমন সমস্যা হয় না। ছবি তো পুরো ফেসবুকজুড়েই আছে। এবার পছন্দ করে নামিয়ে নিলেই হলো। যদিও যার ছবি সে কখনো জানবে না অপব্যবহারের কথা। জানলেও কিছু করার থাকে না তার। অতিমাত্রার ফাজিলরা তো যার ছবি ব্যবহার করেছে, উল্টো তাকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।
ভাবনা অনুযায়ী একটা ফেক এ্যাকাউন্ট খুলেও ফেলে মশিউর। এ্যাকাউন্টের নাম দেয় তানিয়া তানজিনা লাবণী। নামটা ইংরেজিতে যেমন রেখেছে আবার ইউনিকোড ব্যবহার করে এর একটা বাংলা ভার্সনও দিয়েছে! তিনটা নাম একত্রে জুড়ে দেয়ায় নতুন একটা নাম সৃষ্টি হয়েছে। ভালোই হবে, এতে আকর্ষণ যেমন বাড়বে, তেমনি নারী পরিচয়টাও আরো শক্তিশালী হবে। শিার জায়গায় লেখা হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান (৩য় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়াও অন্য সেটিংসও এমনভাবে করা হলো, যে কারো সাথে যেন মিলে যায়। এটাও এক ধরনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। ছবি ডাউনলোড করাই ছিলো, এক মেয়ের বিভিন্ন ভঙ্গিমার প্রায় ১০০টা ছবি সে আপলোড করে। একাধিক ছবি থাকার সুবিধা হলো, এতে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে। এটা যে ফেক, কারো বিশ্বাসই হতে চাইবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ফটো এ্যালবামে যখন বাবা-মা-সহ পারিবারিক ছবি, বন্ধুবান্ধবদের সাথে জনপ্রিয় পিকনিক স্পটে তোলা ছবি থাকে তখন তো আর সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকে না। বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন ¯^জনের সাথে ছবি তাকে যেমন সামাজিক হিসেবে পরিচিতি দান করে তেমনি তার প্রতি একটা বিশ্বাস জš§ নেয় খুব সহজেই। মশিউর হচ্ছে সেই সূত্রধর, যে কিনা নির্ভরযোগ্য সব উপাদান ছড়িয়ে দিয়েছে এ্যাকাউন্টে। নকল হয়েও যেন নকল নয় তা। ছবিগুলোও অসাধারণÑডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা, বোঝাই যায়। মেয়েটার ফিগার যেন খাপখোলা তলোয়ার, উদ্ভিন্ন যৌবনার যৌবনতরঙ্গ যেন যাত্রা করতে চায় নতুন কোনো গাঙে, অচেনা কোনো ঘাটে।
নতুন আইডি খোলার পর বেশিরভাগ সময় কাটে এখানটাতেই। যদি নিজ এ্যাকাউন্ট খোলে, স্ট্যাটাস দেয়, কমেন্ট করে আবার বন্ধও করে দেয়। সাইন আউট হয়ে আবার ফেক এ্যাকাউন্টে আসে। বেশ জমে ওঠে খেলা। এখন আর তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট তেমন একটা পাঠাতে হয় না। প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে জমা হয়ে থাকে। প্রতিটা রিকোয়েস্টই সে এ্যাকসেপ্ট করে। উন্নাসিকের মতো বাছাইয়ে যায় না। ছেলেমেয়ে উভয়ই রিকোয়েস্ট পাঠায়। এই একটা দিক ভালো, মেয়েরা মেয়েদের কাছে যেমন নির্ভরযোগ্য, ছেলেদের কাছেও অনেকটা তাই। মশিউর এখন একটা স্ট্যাটাস দিলে অসংখ্য কমেন্ট পড়ে। কখনো সেটা শ’ও ছাড়িয়ে যায়। অথচ তার প্রকৃত এ্যাকাউন্টে কোনো স্ট্যাটাসেই দশটার বেশি কমেন্ট পড়ে না, পড়তো না। নিজ এ্যাকাউন্ট থেকে যাদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে কিন্তু তারা এ্যাকসেপ্ট করেনি এবং যাদের পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছেÑসবাইকে সে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। পলকেই তা এ্যাকসেপ্টও হয়ে যায়। কেন যে আরো আগে সে এই বুদ্ধিটা আবিষ্কার করলো না! ফেসবুকিংয়ের পালে লাগে জোরালো হাওয়া। জীবনটা আসলেই আনন্দময়। আনন্দগুলো নানা বাঁকে লুকিয়ে থাকে, শুধু খুঁজে বের করতে পারলেই হলো। হতাশার মতো কাপুর“ষোচিত অনুভবে মানুষ কেন যে জড়ায়! আরো বেশি সময় মশিউর ফেসবুকে কাটাতে শুর“ করে। বাইরে খুব একটা যায় না। কীইবা সেখানে দেখার-জানার! তারচেয়ে এই-ই ভালো। ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী, হাতের মুঠোয় বিশ্ব। আর বিশ্বটাকে কন্ট্রোল করে মাউস! যেহেতু মাউস হাতের মুঠোতেই থাকে। শুধু ফেসবুক বলেই নয়, ইন্টারনেটে আরো কতকিছু দেখার, জানার আছে। বিশেষ করে গুগল যখন আছে, কোনো কিছুই আজ অসাধ্য বা অবোধ্য নয়। শুধু একটু ইংরেজি জ্ঞান থাকলেই হলো। তাও খুব বেশি না, কাজ চালানোর মতো। কাজ চালানোর মতো জ্ঞান মশিউরের আছে। আগে ভাইয়া অফিস থেকে ফেরার আগেই সে কম্পিউটার ছেড়ে দিতো। যেটা যেভাবে থাকার, ঠিক সেভাবেই রেখে দিতো। ইদানীং ভাইয়া অফিস থেকে ফিরে তাকে সামনে দেখেন। কীভাবে যে সময় চলে যায় টেরও পায় না। সেদিকে নজর থাকলে সময়ের আগেই উঠে যেতো। কেন যে আজকাল ুধা-তৃষ্ণাও পায় না। মা এসে তিন-চারবার ডাকার পর তবেই সে ওঠে। বাকি সময়টা এই অন্তর্বিশ্বে। অন্তর্জালের মায়াজালে সে জড়ায় ভীষণভাবে। এভাবে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা দেখে ভাইয়ার ভ্রæ কুঞ্চিত হয় খানিকটাÑবোঝে মশিউর। তাই জড়োসড়ো হয়ে সাইন আউট দিয়ে সরে আসে। আহা, নিজের যদি একটা কম্পিউটার হতো। নিজের র“মেই থাকতো সারাণ। যেভাবে মন চায়, সেভাবেই ব্যবহার করতো। প্রয়োজনে সারাণ দরজা লক করে রাখতো, যাতে কেউ ডিসটার্ব দিতে না পারে।
তানিয়া তানজিনা লাবণীর চ্যাটর“মটা যা জমে উঠেছে না! মজাই পায় মশিউর। সব শালাই মেয়েদের কাছে নতজানু। নিজের এ্যাকাউন্ট থেকে যাদের দশবার হাই বলে চ্যাটে আহŸান জানালেও রা করতো না, সেই তারাই এখানে এসে একেবারে ভিজে বেড়াল হয়ে বসে থাকে। যদি কখনো তার চ্যাটের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা হয়। কাউকে কখনো হ্যালো বা এধরনের সম্বোধনসূচক কোনো শব্দ লিখলে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে যায়। ভণ্ড যত্তসব! চ্যাটর“মে পঙ্গপালের মতো একে একে জমা হতে থাকে বন্ধুদের আহŸান। একসাথে তিনটা-পাঁচটা-সাতটা। এই করে করে অনেক। তানিয়ার আট হাজার হাজার বন্ধুর মধ্যে শ তিনেক বন্ধু সবসময়ই অনলাইনে থাকে। ব্যক্তি পাল্টায় কিন্তু সংখ্যাটা তেমন একটা হেরফের হয় না। আজকাল সে খুব গোঁয়ার আর ‘প্রতিশোধপরায়ণ’ হয়েছে। কেউ যদি লেখে হাই পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েÑকী?
এতে ভড়কে যায় অনেকেই। সম্বোধনের এমন উত্তর কেউ দেয় না, আশাও করে না। ইউনিকোড থেকে একটা লাইন কপি করে রাখে, যেই সম্ভাষণ জানাতে চায় তাদের বেশিরভাগই ফিরতি উত্তর পায়Ñব্য¯— আছি বাপ, ডিস্টার্ব দিস না। এতে অনেকেই ুব্ধ হয়, কম সংখ্যক মানুষই মজা পায় বা ¯^াভাবিকভাবে নেয়। লাগাতার এটা করে করেই চলছে মশিউর ওরফে তানিয়া। মজাটা তো ভালোই জমে। এমন স্ট্যাটাস দেয় যা পড়ে যে কোনো তর“ণের বুক আনচান করে উঠতে বাধ্যÑখুব বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। মন চাইছে ভিজতে, কিন্তু কার সাথে ভিজবো? কিংবাÑআজকের রাতটা খুব সুন্দর। মাতাল-করা জোছনায় ডুবে গেছে আমাদের ছাদ। একা একা জোছনা দেখতে দেখতে মন খারাপ হয়ে যায়। কে জানে, কাহার তরে! সঙ্গ দিতে ইচ্ছুক অনেকেই কমেন্ট করে। বাজে কমেন্টও কম লোকে করে না। ফেক এ্যাকাউন্টে অনেকে পর্ণো ছবিসহ অশ্লীল কথা লিখে রাখে। কিন্তু তানিয়ার এ্যাকাউন্ট সে সব থেকে মুক্ত। একটা পরিচ্ছন্ন, পরিশীলিত এবং রণশীলতা সবসময়ই প্রকাশ পায়। বিশেষ করে ছবিগুলো তো ভালো কাজ দেয়। প্রতিটা ছবির নিচে আলাদা আলাদাভাবে কয়েক শ মন্তব্য পড়েছে। তার বেশির ভাগই এমনÑতুমি খুব সুন্দর, তুমি খুব সেক্সি। কোনো কমেন্টে সে লাইক দেয় বা পাল্টা কমেন্ট করে, ধন্যবাদ জানায়। আজকাল চ্যাটে বা মেসেজে অনেকেই ফোন নম্বর চায়। তানিয়া মজা করেÑকী হবে ফোন নম্বর দিয়ে? কথা থাকলে বলো, সরাসরিই চলে আসি! ফোন নম্বরের অনুরোধ বেড়েই চলে। ফোন নম্বর পাওয়া মানেই যেন প্রেম করার লাইসেন্স হাতে পাওয়া। ফোন নম্বরের যন্ত্রণা দিন-দিন মহামারীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে যেন। এক পর্যায়ে দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায় মশিউরের মাথায়। সে করে কী, তানিয়ার প্রোফাইলে গিয়ে পাশের বাসার সানি ভাইয়ের নম্বরটা বসিয়ে দেয়। ভালো মজা হবেÑমনে মনে ভাবে। সানি ভাইকে দু চোখে দেখতে পারে না সে। এমন না যে, তিনি মানুষ খারাপ বা মশিউরের সাথে কোনো দ্ব›দ্ব আছে। তারপরও কেন যেন লোকটাকে তার পছন্দ হয় না। যদিও দেখা হলেই তিনি সহাস্যে কুশল বিনিময় করেন। আন্তরিকভাবে এটা-ওটার খোঁজখবর নেন। আশপাশে চায়ের স্টল থাকলে চা খাওয়াতেও ভোলেন না। আজতক মশিউর সানি ভাইয়ের আচরণে এমন কিছু খুঁজে পায়নি যাতে তাকে খারাপ বা অপছন্দের লোক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কিন্তু মানুষের মনের গতিপ্রকৃতি এমনই আশ্চর্য কাকে যে ভালো লাগবে আর কাকে খারাপ লাগবেÑযুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যাই পাওয়া যাবে না।
ফেসবুকে নম্বরটা দেয়ার পর ভুলেই গিয়েছিলো সে। মনে পড়লো মশিউর ভাইকে সামনে পেয়ে। যদি এরমধ্যে কেটে গেছে দিন দশেক। সন্ধ্যার পর ভাইয়া বাসায় ফিরেছে। এসময় বাসায় মশিউরের জর“রি বা অজর“রি কোনো কাজ থাকে না, তাই বাইরে বেরোয়। বাইরে বলতে আশপাশের এলাকা থেকে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে আসা, কখনোবা বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় বসা। দূর থেকেই সানি ভাইকে কেমন যেন উত্তেজিত মনে হলো। ফোনে কাকে যেন ধমকাচ্ছেন। মশিউরের সামনে এসেই ধমকাধমকি বন্ধ করে লাইন কেটে দেন তিনি। যথারীতি হাস্যোজ্জ্বল মুখে সম্ভাষণ জানান মশিউরকেÑ‘কেমন আছো ভাইটি?’
‘এই তো ভালোই। আপনি?’
‘খারাপ থাকার তো কারণ দেখি না! আর খারাপ থেকে লাভই বা কী?’
‘ফোনে কাকে ধমকালেন?’
সানি ভাইয়ের চেহারায় কেমন যেন ইত¯—ত ভাবÑ‘আর বলো না। কোন বদমাশ মেয়ে বা ছেলে তার নিজের এ্যাকাউন্টে আমার ফোন নম্বর দিয়ে বসে আছে। এখন রাতদিন ফোন আসে।’
‘বলেন কী!’
‘হ্যাঁ, রাতের দুইটা-তিনটা বাজেও ফোন আসে। জানতে চায়Ñএটা কি লাবণীর নম্বর?’
‘লাবণীটা কে?’
‘বললাম না, যার নামে এ্যাকাউন্ট।’
‘কিন্তু সেখানে আপনার নম্বর গেলো কীভাবে?’
‘সেই প্রশ্ন তো আমারও। আমি নির্বিরোধী মানুষ। কারো সাতে-পাঁচে নেই। আমার ওপর কেন এই অত্যাচার!’
‘খুব বেশি জ্বালাতন করে?’
‘বেশি মানে! রাতদিন, দিনরাত। সিমটা পাল্টানোর মতো অবস্থা। কিন্তু পাল্টাতে পারছি না। পুরোনো সিম, অনেকেই এই নম্বরটা জানে। তাছাড়া অফিসের অনেক কাজ এই সিমেই হয়। হুট করে পাল্টে ফেললে সবাইকে জানানো যেমন যাবে না, তেমনি সমস্যাও বাড়বে।’
‘যার এ্যাকাউন্টে আপনার নম্বর ব্যবহৃত হচ্ছে তাকে আপনার সমস্যার কথা জানিয়েছেন?’
‘তাকে আমি পাবো কোথায়? কয়েক কোটি ফেসবুক ইউজারের মধ্যে একজনকে খুঁজে পাওয়া কি সম্ভব? এ যে খড়ের গাদায় সুই খোঁজার শামিল।’
‘তারপরও সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন।’
‘সার্চ দিয়ে তাকে খুঁজে পেলেও কী আর হবে? যে শয়তান বা শয়তানী দিয়েছে, জেনে-বুঝে-শুনেই দিয়েছে। সে বোধহয় আমার পরিচিত কেউ হবে।’
‘কীভাবে বুঝলেন?’
‘না বোঝার তো কিছু ...।’ কথা শেষ করার আগেই সানি ভাইয়ের নম্বরে আবার ফোন আসে। পলকেই উত্তেজিত তিনিÑ‘ক্ক্ক্ক্ক্ কী পেয়েছেন আপনারা? চরিত্র ঠিক করতে পারেন না? স্টুপিড কোথাকার...!’
বোঝাই যাচ্ছে সানি ভাই খুব বেশি ত্যক্তি-বিরক্ত। নাহ, বেচারার ওপর বেশি শা¯ি— হয়ে যাচ্ছে। তবে আরো মাসখানেক যাক, তখন না হয় অপছন্দের অন্য কারো নম্বর দেয়া যাবে! একবার ভেবেছে তার ছুটে যাওয়া প্রেমিকা তিথির নম্বর দেবে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওর সিম কমসে কম পাঁচটা। খুব সহজেই সিম পাল্টে ফেলবে। সুতরাং ওর নম্বর দেয়া না দেয়া সমান। নম্বর ব্যবহার করতে হবে এমন মানুষের যার একটাই নম্বর এবং এটা সহসা পাল্টানোর উপায় নেই।
সানি ভাই বিদায় নিয়ে চলে যান। মনে একরাশ পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে মশিউর আপন গন্তব্যের দিকে হাঁটা ধরে। কেমন জব্দ!
এই করে কাজ এবং অকাজে চলছে। মশিউরের জীবন কাটছে নতুন চালু করা পদ্ধতিতে। সেদিনের পর আবার যখন মশিউর ভাইয়ের সাথে দেখা হলো, জানালেন তিনি কান্ত-শ্রান্ত। ফোনের জ্বালায় একটা মিনিট অবসর থাকতে পারছেন না। অফিসে এক কলিগের সাহায্য নিয়ে তিনি তার নম্বর ব্যবহারকারীর এ্যাকাউন্টের হদিস খুঁজে বের করেছেন। যদিও অনেক কষ্টে। সেই এ্যাকাউন্টে মেসেজ পাঠিয়েছেন সানি ভাই, তাকে যেন এ নরকদশা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু এ্যাকাউন্টধারী ফিরতি উত্তরে লিখেছেÑতার কিছুই করার নেই। যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে। খুব বেশি অসুবিধা হলে যেন তিনি সিমটা পাল্টে ফেলেন। নতুন ব্যবহার করা সিমটার নম্বর যেন জানানো হয়। না জানালে অনুসন্ধান করে সানি ভাইয়ের নম্বর বের করে ফেসবুকে দেয়া তো হবেই; কথা না শোনার সাজা হিসেবে তার ছোটবোন মিলা, যে কিনা এবার এইচএসসি দিয়েছে তার নম্বরটাও ছড়িয়ে দেয়া হবে। এসব কেচ্ছাকাহিনী বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন সানি ভাই। কান্নায় মশিউর চমকে ওঠে। আহা, বেচারা! কিন্তু কই, এরকম কোনো মেসেজ তো সে পায়নি। উত্তরও সে দেয়নি। তাহলে কে দিলো উত্তর, মেসেজই বা কোথায় এলো? তাহলে কি অন্য কোনো এ্যাকাউন্ট...? কিন্তু সানি ভাই তো ভুল দেখার লোক নন, আজেবাজে কথাও বলেন না তিনি। তার ওপর বেচারা এমন বিপর্য¯—। পরদিন সকালেই মশিউর আঁতিপাতি করে খোঁজে সানি ভাইয়ের মেসেজ। না, কোথাও নেই। দয়াপরবশ হয়ে সে সানি ভাইয়ের নম্বরটা বাদ দিয়ে দেয়। তার বদলে বসায় বন্ধু রিমনের নম্বর। রিমন তার কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়েছে প্রায় ২ বছর আগে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ৫টা টাকাও পরিশোধ করেনি। করবে বলেও মনে হচ্ছে না। যদিও ইতোমধ্যে তার ভালো একটা চাকরি হয়েছে, রাজনীতিক মামার জোরে। চাকরি হলে কী হবে, খাসলত কি আর কোথাও যায়!
মশিউর ঘুণারেও কি ভাবতে পেরেছিলো, এই ছোট কাজটা করতে গিয়ে তাকে কত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে!
চ্যাটর“মে যথারীতি শ খানেক বন্ধু। এদের অনেকে আজও ব্যাকুল, বন্ধু তানিয়া যদি একটু জবাব দেয়, একটু প্রসন্ন হয়। যথারীতি তানিয়া সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই চলেছে। সেই পুরোনো ভড়ংÑকপি-পেস্ট। মানুষকে উপো করার মাঝে যে এতো আনন্দ, হেনস্থা করার মধ্যে যে নিবিড় আত্মতৃপ্তি আগে কখনো এভাবে অনুভব করেনি। অবশ্য এসব অপমান গায়ে মাখছে কম বন্ধুই, তারা ফিরতি মেসেজ দিতে ছাড়ে না। আজকে তো এক বন্ধু এমন নাছোড়বান্দার মতো ধরেছে যে, ঘণ্টা দুয়েক পিছু লেগেই আছে। কিছুণ পরপর এটা-সেটা-ওটা বলছে। বাধ্য হয়ে তানিয়া মাঝে-মধ্যে কিছু একটা বলে দায়মুক্ত হচ্ছে। পিছু তাকানোর সময় তার কই। কিন্তু সেই লোক অরিজিনাল মাস্টার গাম! এক পর্যায়ে মনোযোগ প্রত্যাশী বন্ধুটি লিখলোÑতোমাকে একটা লিঙ্ক দিচ্ছি। কিক করো। আমি নিশ্চিত, তুমি এটা দেখার পর তুমি কমসে কম এক মাস আনন্দানুভূতিতে বুঁদ থাকবে। তানিয়া দেখবে না, দেখবে না করেও শেষপর্যন্ত কাঁঠালের আঠার পিড়াপীড়িতেই হোক, আর কৌতূহলেই হোক লিঙ্কটাতে কিক করে। পলকেই ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। স্থির চিত্র। একটা সর“ নদী, দুই পাড়ে সবুজ ঘাস। সুন্দর লোকেশনÑবোঝা যায়, বিদেশ। একই নদীর ২টা ছবি দিয়ে রাখা হয়েছে, পাশাপাশি। তবে কি এটা কুইজের মতোÑএকটা থেকে আরেকটার পার্থক্য খুঁজে বের করতে হবে? তানিয়া গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো পার্থক্য বা অসঙ্গতি চোখে পড়ে না। কিন্তু ওই লোক যে বললো মজার, দেখলে ভুলতে পারবে না! সে আরো ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করে, ব্যাপারটা আসলেই কী। এই দেখতে দেখতে কিছুণ পরই নদী সরে গিয়ে ভয়ঙ্কর-দর্শন এক ডাইনি পর্দাজুড়ে জায়গা করে নিলো। তার সারা শরীর লাল, যেন আগুনের তৈরি। অবশ্য সারা শরীর মানে বুক পর্যন্ত। স্ত্রিনে তার বুক পর্যন্তই দেখা যাচ্ছে। চেহারা বলতে কিছু নেই, কঙ্কালের ছাপ সুস্পষ্ট। চোখের পলকেই সেটি বিকট হা, ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে ধেয়ে এলো যেন। দেখেই ভয় পেলো তানিয়া, আর গর্জন শুনে তো গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেলো যেন। এটা হয়তো হরর ফিল্মের কোনো দৃশ্য, অথবা বিকৃত র“চির কেউ বিশেষভাবে বানিয়েছে। সবসময় সুন্দর সুন্দর ছবি দেখতে অভ্য¯— সে, কখনো হরর ফিল্মও দেখেনি। এসব অবা¯—ব জিনিস দেখার কোনো যুক্তিই খুঁজে পায়নি বলে। এখন যখন তার দিকেই তেড়ে এলো মূর্তিমান বিভীষিকা, ভয়ে-আতঙ্কে সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। এ কী দেখছে সে! ভয়াল গর্জন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। যেন কম্পিউটারকে বার্স্ট করে দেবে, এমন শব্দ। বুকে ধুকপুকানির সাথে সাথে সারা শরীর এমনভাবে কাঁপতে লাগলো যে, মাউসের একটা কিকেই যে এটা বন্ধ করা যায় সে শক্তিটুকুও যেন শরীরে অবশিষ্ট নেই। এদিকে পর্দাজুড়ে তাণ্ডব চলছে তো চলছেই। তাণ্ডবে মনে হচ্ছে, সে চলে এসেছে অন্য কোনো পৃথিবীতে। বা¯—বের পৃথিবীতে এমনটি ঘটে না, ঘটতে পারে না। কোনো সংবেদনশীল মানুষের চোখ সইতে পারে না এমন দৃশ্য। দাপাদাপি চলছেই চলছেই চলছেই, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কাঁপাকাঁপি। সইতে না পেরে, একসময় আর্তচিৎকার দিয়ে চেয়ার থেকে উল্টে পড়লো সে। জ্ঞান হারালো সাথে সাথে। অ¯^াভাবিক শব্দে ছুটে এলেন মা। ছেলেকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে, পর্দায় নারকীয় তাণ্ডবে তিনিও গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারালেন। পলকের মধ্যে। এবার এলেন বাবা এবং ভাবি। বাবা নিজে ফিট হলেন না ঠিকই, কিন্তু হায় হায়, এসব কী, এটা কোন কেয়ামতের আলামত বলতে বলতে বাড়ি মাথায় করে তুললেন। সেই সাথে শুর“ হলো হেঁচকি-তোলা কান্না। মূর্ছা যাওয়ার কথা ভাবিরই সবার আগে, কিন্তু একমাত্র তিনিই রইলেন স্থির। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলেন। যেই-না বুঝলেন সমস্যাটা কম্পিউটার-সৃষ্ট, মেইন সুইচটাই অফ করে দিলেন তিনি। কম্পিউটারের দিকে এগোতে সাহস করলেন না। তখনো জান্তব শব্দ বেজেই চলেছে। অবশ্য ভাবি কম্পিউটারে হাত দেয়ার সাহস করলেও খুব একটা লাভ হতো না, তিনি কম্পিউটার বোঝেন না বললেই সই। কিন্তু মেইন সুইচ অফ করে দেয়ার ফলে শুর“ হলো অদৃশ্য শব্দ, সামান্য কিছু সময়ের ব্যবধানের পরপরই সে শব্দ চলতে থাকে। শব্দটা কোত্থেকে হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছেÑকিছুই বুঝতে পারলেন না ভাবি। এটা ভয়ঙ্কর কোনো কিছুর আলামত নয়তো! দিশমিশ না পেয়ে ভাবলেন, মেইন সুইচ ঠিকঠাকভাবে বন্ধ হয়নি। হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে ফেললেন মেইন সুইচে ঢোকা তার দুটি। পাওয়ার। কিন্তু শব্দ বন্ধ তো হলোই না, উল্টো ছিঁড়ে ফেলা তারের এক মাথার সাথে অন্য মাথা হালকাভাবে লেগে ছোটখাটো একটা শর্ট সার্কিট হয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আলো ছড়ালো। সেই সাথে কিছুটা শব্দও। অবশ্য শব্দ বা স্পার্ক বেশিণ থাকলো না, কিন্তু বিপদজনক বস্তু হয়ে থেকেই গেলো। ভাবি যে শব্দটার হদিস করতে পারলেন না, সেটা আসলে ইউপিএস-সৃষ্ট। ভাইয়াই বললেন, বোঝালেন পরে। ভাবির ফোন পেয়ে অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি সামলাতে তাকে অফিস থেকে ছুটে আসতে হলো। একটা পরিবারের সবকিছু তোলপাড়, লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে শুনলে কেই বা স্থির থাকতে পারে। পরিবারের সদস্যরা যখন বিপদের সম্মুখীন। সেদিন আর অফিসে গেলেন না ভাইয়া। বাসায় ডাক্তার ডেকে, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এনে দিনে দিনে সব সমস্যার সমাধান করা হলো। এ ঘটনার পর ভাইয়া মশিউরের কম্পিউটার ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। মশিউর সানন্দেই মেনে নিলো তা। কিন্তু মেনে নিলে কী হবে, সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা তার পিছু ছাড়লো না। প্রায় প্রতিদিনই মাঝরাতে দুঃ¯^প্নটা সে দেখে। রক্ত হিম করা ধাতব গর্জন তুলে এগিয়ে আসছে সেই ভয়াল মূর্তি। তার নগ্ন করোটি, মুখাবয়বজুড়ে ক্রূরতা। জান্তব রাগ। আর্তচিৎকার দিয়ে জেগে ওঠে সে। চিৎকার শুনতে পেয়ে মা এগিয়ে আসেন। মাথায় বুলিয়ে দেন, নানা রকম সাš—¡নার বাণী আওড়ান। কিন্তু যে রাতে দুঃ¯^প্ন দেখে, সে রাতে আর ঘুম আসে না। মূর্তিমান বিভীষিকা কেবলই তাড়া করে। কিছুদিন পর যুক্ত হয় নতুন উপসর্গÑহাজার হাজার কিলবিলে সাপ এগিয়ে আসে যেন তার দিকে। বিভিন্ন সাইজের হরেক রঙের সাপ। সবাই যেন প্রস্তুত ছোবল দিতে। কে জানে, কেন মশিউরের ওপর তাদের এতো রাগ, কেনই বা তারা এতো হিংস্রতা দেখায়। প্রকোপ কমার কোনো লণ দেখা না দেয়ায় বাবা তাকে নিয়ে যান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেয়ে মোটামুটি দুই মাসের মাথায়ই ‘আরোগ্য’ লাভ করে মশিউর।
তারপর আরো দুইমাস সে নিষ্কর্মা থাকে। সেই দুঃসহ ¯^প্ন-স্মৃতি প্রায় মুছে গেছে বললেই চলে। এই সময়ে সে দুই তিন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছে। একটা জায়গায় হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। মোটামুটি ৯০ পার্সেন্ট নিশ্চিত। এখন শুধু অপো। অপোর প্রহর আর কাটে না। পড়াশোনাও নাই, সময়ও পাথরের মতো চেপে থাকে বুকের ওপর। কোথাও যেতে চায় না, কাটতেও চায় না। বন্ধুদের সাথে বেহুদা আড্ডা দিয়ে, এদিক-সেদিক ঘুরে আর কতণই বা থাকা যায়। দুঃসহ নিঃসঙ্গতায় কাবু হতে থাকে সে। বাসা আছে আগের মতোই, কোনো পরিবর্তন নেই। মা-র নিঃশব্দ ঘরকন্না, বাবার নতুন নতুন ব্যামো আর ভাবির রূপচর্চার নতুন নতুন আবিষ্কার। ভাইয়াও আগের মতো নিস্পৃহ, নিরাসক্ত। মানুষটা বোধহয় দিনে দিনে যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু এসে যায় না। সবকিছুতেই নির্বিকার; যেন সাধুসন্ত!
গুটিগুটি পায়ে সাহস করে একদিন ঠিকই মশিউর বসে যায় নেটের সামনে। তার প্রিয় ফেসবুক কেমন আছে, জানতে হবে! টানা চার মাস বসেনি সে নেটে। বাহ্, এই চার মাসে ৩২৫৭টি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে জমা হয়েছে! অবশ্য তার নিজের নয়, রিকোয়েস্টগুলো এসেছে তানিয়া তানজিনা লাবণীর এ্যাকাউন্টে। নিজের এ্যাকাউন্টে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের সংখ্যা ৫! এগুলো এ্যাকসেপ্ট করতেও তো দুই-তিনদিন লেগে যাবে! টানা। একসময় মশিউর শুর“ও করে দেয়। আবার ফিরে যায় আগের জীবনে। মাঝখানের দুঃসহ ঘটনাটি তার মেমোরি থেকে অনেকটা ডিলিট হয়ে গেছে। যতদিন না চাকরিতে যোগদান না করছে, কিছু একটা নিয়ে ব্য¯— না হচ্ছে অন্তত ততদিন তো ফেসবুকের সঙ্গ নিতেই পারে! আবার শুর“ হয় পূর্ণোদ্যমে ফেসবুকিং। বিশেষ করে চ্যাট। ছেলেদের নিয়ে খেলতে এতো ভালো লাগে! এদের মের“দণ্ড বলতে কিছু নেই। কোনো মেয়ের বন্ধু হতে পারলেই হলো, তারা নেমে পড়বে জয় করতে! মেসেজ দিয়ে কত রকম কথা যে বলে। যেন এরচেয়ে জর“রি কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই। আজকাল নিজের এ্যাকাউন্টে মশিউর ঢোকে না বললেই চলে। সব মজা যখন এখানটায়, শুধু শুধু নিজ এ্যাকউন্ট খুলে সময় নষ্ট করার মানে আছে!
আনন্দ-উত্তেজনায় কেটে যায় দিন। ভাইয়া কিছু বলেন না, আগের মতোই সহনশীল, সংবেদী। বোধহয় নিষেধাজ্ঞা জারির কথা ভুলে গেছেন। কিন্তু দিনগুলো আনন্দে থাকলো না বুঝি। কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ মশিউর নিজের বুকে চাপ-চাপ ব্যথা অনুভব করতে থাকে। ব্যথাটা তীব্র নয় বলে কাউকে বলে না, এমনকি ডাক্তারের পরামর্শও নেয় না। বুকে ব্যথা যে কোনো কারণে হতে পারে। কিন্তু তারও কিছুদিন পর অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করলো বুক গজাচ্ছে তার। মেয়েদের মতো। বিভ্রান্ত সে, বুঝে উঠতে পারে না আসলে কী হতে যাচ্ছে। কিন্তু পনেরোদিন পর যখন ¯—নদ্বয় সুপারির আকার ধারণ করে সে আর স্থির থাকতে পারে না। বোঝাই যাচ্ছে ওগুলো এবার নারকেলের আকার ধারণ করার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু কাকে বলবে এ কথা, কে বিশ্বাস করবে? কেনই বা এমন হবে! সবচেয়ে বড় কথা সবাই হেসে এটাকে চাউর দেবে চারদিকে। তখন সমাজে ভদ্রভাবে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিৎ। নিজেকে নিয়ে মুষড়ে পড়া মশিউর সিদ্ধান্তে আসতে পারে না, ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিৎ হবে কি হবে না। ডাক্তার আবার বক্রদৃষ্টিতে তাকাবেন না তো? রাতে বাসায় ফিরে বউ, কোনো বন্ধুবান্ধবের সাথে রসাত্মক মন্তব্যও কি করবেন নাÑজানো, আজ এক পুর“ষ রোগীর দেখা পেয়েছি; যার মেয়েদের মতো ¯—ন গজাচ্ছে!
মশিউরের ধারণাই ঠিক, ¯—ন দুটি দিনদিন বড় হচ্ছে, বেড়ে উঠছে। কিন্তু এগুলো যদি আরো বড় হয়, সে শার্ট পরবে কীভাবে, আর কীভাবেই আড়াল করবে অবাঞ্ছিত মাংসপিÊকে?
এসব সমস্যার কথা ভেবে যখন পেরেশান, এসময়ই এক সকালে সে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করেÑতার পুর“ষাঙ্গ বলে কিছু নেই, সেখানে রিপে­স হয়েছে যোনি। ব-দ্বীপ আকৃতির, মসৃণ-নিটোল। ভয়ে মশিউরের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। কী হচ্ছে এসব? কী কী, এসব কী! তবে কি সে পুর“ষ থেকে নারীতে রূপাš—রিত হচ্ছে সে? কিন্তু তার চেহারা, চালচলন সবই তো পুর“ষালি শুধু শুধু বুক এবং নি¤œাঙ্গে ‘চিহ্ন’ পাল্টে গেছে। কেন এমন হচ্ছে, কী করবে এখন, কীই বা করা উচিৎ ভেবে ভেবে দিশেহারা হয় মশিউর। দিশেহারা হতে থাকে...। হতেই থাকে...!

৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×