মুফতী আবু ওয়াফা মনসুর আহমদ
সাম্প্রতিককালে বস্তুগত উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে জনজীবনের অশান্তি ও ভোগান্তি। না আছে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, না আছে সম্পদের নিরাপত্তা। মানুষ গড়ার কারখানা নামে খ্যাত ইউনিভার্সিটিগুলো যেন একেকটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট। নিয়মিত চলছে অস্ত্রের মহড়া। প্রায়ই ঘটছে খুনের ঘটনা। মারামারি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া তো তাদের নিত্যকর্ম। রাজনীতির অঙ্গন পূর্ণ কলুষিত। প্রতারণা-শঠতা, হিংসা-প্রতিহিংসা, মিথ্যা ও অর্ধসত্য বাণী উচ্চারণ এবং নিজেদের আখের গোছানোর চিন্তাই এখনকার রাজনীতির মূলকথা। সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্তদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নিরীহ মানুষের ফরিয়াদের কণ্ঠ পর্যন্ত রূদ্ধ করে রেখেছে। প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রেই দুর্নীতি চরম পর্যায়ে। নিরীহ মানুষের আইন-আদালতের দ্বারস্থ হওয়াও আজ নির্বিঘ্ন নয়। নারী নির্যাতন বাড়ছে আশংকাজনক হারে। যৌতুকের বলির শিকার হচ্ছে হাজারো গৃহবধূ। পাশ্চাত্যের নষ্ট সভ্যতার আমদানী ও নারীবাদীদের মত্ত প্রচারণা ও উস্কানীতে পূরুষ নির্যাতনের হারও বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। বাড়ছে ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ও ইভটিজিংয়ের প্রবণতা। যেন নারীত্ব মানেই অসহায়ত্ব। কন্যা সন্তানের জনক-জননীদের জেগে থেকেও কত যে দুঃস্বপ্ন দেখতে হচ্ছে এর কোন হিসেব নেই। শ্রমিকেরা পাচ্ছে না তাদের ঘামের মূল্য। কৃষকেরা পাচ্ছে না তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যয্য মূল্য।
এসব সমস্যার ক্রমবৃদ্ধির কারণ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে অনেকেই অনেক কথা লিখছেন, প্রতিকারের বহুবিধ নিস্ফল উপায়ও উল্লেখ করছেন। কিন্তু আমাদের কাছে এসবের কারণ ও প্রতিকার দু’টোই পরিস্কার। মানুষ তার জীবনের পরম লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ভুলে গেছে। আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলে গিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে পড়েছে। এই বেপরোয়া ভোগবাদী জীবনাচারের অশুভ পরিণতিতেই এসব সমস্যার সৃষ্টি ও ক্রমবৃদ্ধি। আখেরাতের জবাবদিহিতার ভয় অন্তরে না থাকলে মানুষ পশুর মতোই স্বেচ্চাচারী ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে আল্লাহর ভয় মানুষকে সংযমী জীবন যাপনে অভ্যস্ত করে।
মানুষের চরিত্রকে সংশোধন করে তাদেরকে সুসংযত জীবনাচারে অভ্যস্থ বানাবার লক্ষ্য নিয়েই যুগে-যুগে নবী-রাসূলগণ দুনিয়াতে আগমন করেছিলেন। বিশ^নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের আগমনের উদ্দেশ্য এভাবে ব্যক্ত করছেন- ‘আমি প্রেরিত হয়েছি মানুষের চরিত্রকে (শুধু সংশোধন নয় বরং) পূর্ণতায় পৌঁছানোর লক্ষ্যে’। বাস্তবিকই তিনি বর্বর যুগের মানুষগুলোর চরিত্রকে বদলে দিয়ে সোনার মানুষে পরিণত করেছিলেন।
নবীগণের এ মহান দায়িত্ব তাদের অবর্তমানে তাদেরই উত্তরাধিকারী উলামাদের স্কন্ধে অর্পিত হয়। সুতরাং উলামায়ে কেরামের এ দায়িত্ব মুখ্য ও অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। একে খাটো করে দেখবার কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এই মাপের যোগ্যতা ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন আলেমের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় সিকি ভাগও নেই। এহেন পরিস্থিতিতে উম্মতের কল্যাণচিন্তায় বিভোর জাতির পরম হিতৈষী প্রবীণ আলেমগণ সদ্য পড়াশোনা সমাপ্তকারী নবীন আলেমদেরকে বিদায়ী নসীহতকালে বলে দেন- ‘তোমরা দ্বীন ও ইলমেদ্বীনের খেদমতেই লেগে থাকবে। এসব ছেড়ে ভিন্ন কিছুতে নিজেদেরকে মশগুল করবে না। কিন্তু ইদানীং এ বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে আলেমরা তাদের ছাত্রদেরকে সংকীর্ণমনা বানিয়ে ফেলেন। তাদের কর্মক্ষেত্রকে মসজিদ মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেন। ২১/৫/১০ইং তারিখের দৈনিক যুগান্তরের ইসলাম ও জীবন পাতায় আব্দুল আউয়াল নামের একজন এ বিষয়টিকে নেহায়েত কটাক্ষপূর্ণ ভাষায় এভাবে উপস্থাপন করেছেন- ‘... তাছাড়া বিদায় বেলা গুরুদের বলে দেয়া চিরচেনা সেই মহৎবাণী তো মাথায় আছেই- তোমরা ফারেগ হওয়ার পর সর্বদা দ্বীনের খেদমতে লেগে থাকবে, যদিও তা কোন মক্তবে হয়। এলেম কবূল হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ঠ। এলেম কবূল হওয়াকে তারা মসজিদ মাদ্রাসার সঙ্গেই খাস করেছেন। যারা সেগুলোতে চাকরী করেন তারা সফলকাম। বাকীরা দোযখের লাকড়ি।’- এই লোকটি কোন ঘরানার তা আমাদের জানা নেই। তবে এতটুকুন কথা সুস্পষ্ট যে, হক্কানী উলামায়ে কেরামের ফিকির ও উম্মতের প্রতি তাদের দরদ-ব্যথা বোঝার মতো যোগ্যতা নিশ্চয় তার নেই। কোন সত্যকে যথার্থরূপে উপলব্ধি করার মতো সাধারণ জ্ঞানটুকু থাকলেও এমন উক্তি তিনি করতে পারতেন না। যেখানে মুসলমান বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য ন্যূনতম যতটুকু এলেম থাকা দরকার, তা থেকেও হাজার-হাজার মুসলমান বঞ্চিত। মাদ্রাসা-মক্তবের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। বহু এলাকা এমন আছে যেখানে কয়েক গ্রাম মিলেও একটি প্রাথমিক স্তরের মাদ্রাসা নেই। যোগ্য শিক্ষকের অভাবে দেশের বহু মাদ্রাসার অবস্থা অতিশয় সংকটাপন্ন। এমতাবস্থায় নবীন আলেমদেরকে তাদের মূল দায়িত্বে অবিচল থাকার উপদেশ দিলে তা অযৌক্তিক হবে কেন? বরং ভিন্ন চিন্তা করাই হবে অযৌক্তিক। বিপুল পরিমাণ জাতীয় অর্থ ব্যয় করে, সর্বোচ্চ ব্যবস্থাপনাসুবিধা ভোগ করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে, তারা যদি চিকিৎসাসেবা ও প্রকৌশলসেবা বাদ দিয়ে মুদি দোকান খুলে বসেন, কিংবা দর্জিগিরি শুরু করে দেন- তাহলে নিশ্চয় তা কোন যুক্তিতেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। আলেমদের ক্ষেত্রে এ যুক্তির অন্যথা হবে কেন? ‘ওয়ারেসে নবী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্য বানাবার লক্ষ্যেই তাদের পেছনে শিক্ষক মহোদয়গণ এক যুগেরও অধিক সময় দিবা-নিশি খেটেছেন। জাতির অর্থ ব্যয় করেছেন। শুধু ফরজ এলেমটুকু শেখাবার জন্য এতো বেশি শ্রম, সময় ও অর্থ ব্যয়ের মোটেও প্রয়োজন ছিল না।
শুধু এক আব্দুল আউয়াল নয়, আজকাল অনেকেই বলে বেড়াচ্ছেন- আলেমরা সমাজের কোন কাজই করছেন না। ওরা অকর্মা, উপার্জন বিমূখ ও পরনির্ভরশীল। আপত্তিকারীদের দৃষ্টিতে জাগতিক উন্নয়নমূলক কাজগুলোই কেবল কাজ। ওলামায়ে কেরাম যা করছেন তা কিছুই নয়। কোন আলেম নিছক উপার্জনমূলক কোন কাজে লেগে গেলে তিনি হয়ে যান সময়ের জ্ঞান সম্পন্ন, যোগ্য ও আদর্শ আলেম। তিনি বেশ বাহাবা কুড়াতে সক্ষম হন। এই শ্রেণীর লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে অনেক নবীন আলেম বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তারা আপন দায়িত্ব পালনে উৎসাহ হারাচ্ছেন। ক্রমশঃ উদ্যমহীন ও হীনমন্য হয়ে পড়ছেন। এলমেদ্বীন ও আলেমেদ্বীনদের প্রতি এহেন অবজ্ঞাপূর্ণ কথা-বার্তায় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হবু আলেমেরা। তাদের অন্তরে হীনমন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে এবং এলমেদ্বীনের প্রতি আগ্রহ-উৎসাহে ভাটা পড়ছে। ফলে পর্যাপ্ত উদ্যোগ-আয়োজনের পরও মাদ্রাসাগুলো থেকে অতীতের মতো যোগ্য আলেম তৈরী হচ্ছে না। আর এর মাশুল গুণতে হচ্ছে সমাজসদস্যদেরকে। অন্তত আমাদের প্রতিটি মসজিদের ইমাম যদি যোগ্যতার দিক থেকে একেকজন সত্যিকার ‘ওয়ারেসে নবী’ হতেন, তাহলে সমাজের বর্তমান চিত্র নিশ্চয় বদলে যেত।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, সকল অত্যাধুনিক বৈষয়িক উপকরণ নিয়ে যদি ‘সমাজদেহ’ তৈরী হয়, তাহলে সেই দেহের প্রাণ হচ্ছে সমাজসদস্যদের ‘খোদাভীরু অন্তর’। প্রাণহীন দেহে পচন ধরে। এই পচন থেকে সমাজদেহকে রক্ষা করার নিমিত্তেই উলামায়ে কেরামের যত মেহনত।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম সমাজে উলামায়ে কেরামের উপস্থিতি ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়েও অধিক জরুরী। কেননা তারা গণমানুষের কেবল সাময়িক সমস্যার সামধান দেন। আর উলামায়ে কেরাম জাতিকে উভয় জাহানের শান্তি-সফলতার পথ প্রদর্শন করেন। তাদের অবর্তমানে দুনিয়ার কিছুটা ক্ষতি হবে। আর উলামায়ে কেরামের অবর্তমানে দুনিয়া-আখেরাত উভয়টা বরবাদ হবে। এতদসত্ত্বেও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের পেশাগত উপার্জনে আপত্তি না থাকলেও উলামায়ে কেরামের পেশাগত ন্যূনতম ভাতা গ্রহণে আপত্তি থাকবে কেন?
কেউ কেউ আবার আরেকটি জটিল প্রশ্ন উত্থাপন করেন- আগেরকার দিনে এলমে দ্বীনের খেদমত করে তো আলেমগণ বিনিময় গ্রহণ করতেন না; বরং উপার্জনের ভিন্ন কোন পন্থা অবলম্বন করতেন। এবং অতিসাধারণভাবে দুনিয়ার জীবন কাটিয়ে দিতেন। এযুগের আলেমদেরকে মাদ্রাসার বেতন-ভাতার উপর নির্ভর করতে হয় কেন? এ প্রশ্নের জবাবও আমাদের কাছে পরিস্কার। অতীতের পরিবেশ-পরিস্থিতি বর্তমানে অবশিষ্ট নেই। সুদূর অতীতে মানুষের স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল, রূহানীশক্তি প্রবল ছিল। কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য বর্তমানের মতো এতোসব মধ্যস্থতাকারী বিদ্যা অর্জনের প্রয়োজন হতো না। সেই সঙ্গে বাড়িতে-বাজারে সর্বত্রই দ্বীনী পরিবেশ বিদ্যমান ছিল। তাই সেযুগে ‘ফুলটাইম’ মাদ্রাসা ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এযুগে প্রয়োজন। বর্তমানে ছাত্রদেরকে মাদ্রাসায় রেখে দিবা-নিশি তদারকি করেও যোগ্য আলেম বানানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণে দায়িত্বশীল শিক্ষকমহোদয়গণকে সারক্ষণ মাদ্রাসার পরিমণ্ডলে আবদ্ধ থাকতে হচ্ছে। অথচ এভাবে আবদ্ধ থাকার ব্যাপারটা পূর্ব যুগের আলেমদের ক্ষেত্রে ছিল না। স্বাভাবিকভাবে উপার্জনের পথ তাদের জন্য উন্মোক্ত ছিল। তদুপরি আলেমগেণের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল তৎকালীন বাদশাদের পক্ষ থেকেও তাদের জন্য শর্তহীন সম্মানী ভাতার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এসব সুবিধার কোনটাই বর্তমান সময়ে নেই। সুতরাং বর্তমান যুগের আলেমদেকে পূর্ব যুগের আলেমদের সঙ্গে মিলাতে গেলে নির্ঘাৎ ভুল হবে।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, উলামায়ে কেরাম অকর্মন্য নন। কোন বৈধ পেশাকে তারা ঘৃণাও করেন না। যাদের সুযোগ আছে তারা চাষাবাদ, পশুপালনসহ সবই করেন। তবে উপার্জনের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন না। সব ছেড়ে উপার্জনে লেগে গেলে অন্যদের চেয়ে নিশ্চয় পিছিয়ে থাকতেন না। কিন্তু তারা দ্বীনের স্বার্থে প্রাচুর্র্যপূর্ণ বিলাসী জীবনের মোহ ত্যাগ করে দ্বীন ও এলমে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করে আছেন। তাদের এ কুরবানীকে দুর্বলতা মনে না করে সম্মান করাই হচ্ছে বিকের দাবী।
পরিশেষে বলবো, উলামায়ে কেরামের এই অসামান্য মেহনত ও কুরবানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি নেতিাবাচক দৃষ্টিভঙ্গির আশু পরিবর্তন জাতির কল্যাণেই একান্ত জরুরী। আল্লাহ পাক সকলকে সুমতি দান করুন। আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১২:১১