শিবাজী মারা যাওয়ার পর অল্পকিছু ঝুটঝামেলার পরে সিংহাসনে বসলেন শম্ভুজী। কিছু বছর পর তিনি বন্দী হলেন মুঘলদের হাতে। তাকে বলা হল ধর্মান্তরিত হতে। তিনি হলেন না। ফলে চল্লিশ দিন ধরে প্রবল অত্যাচার করে তাঁকে হত্যা করা হল। খুব সম্ভবত সেই আমলে প্রচলিত এমন কোনো অত্যাচার ছিলো না যা এইকদিনে তাঁর উপরে করা হয়নি। এমনকি হত্যার পরেও তাঁর বিচ্ছিন্ন মাথার ভেতরে খড় গুঁজে দাক্ষিণাত্যের সমস্ত বড় বড় শহরে প্রদর্শন করা হয়েছিল নানা বাজনা বাজাতে বাজাতে। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় ঔরঙ্গজেব শিবাজীর থেকেও শম্ভুজীকে ভয় পেতেন বেশী। শিবাজির মৃত্যুর খবরে স্বস্তি পাওয়া মুঘলরা কীভাবে আরও আরো বেশী ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিল শম্ভুজীর শাসনে‚ এক মারাঠি কবির কবিতায় -
//বেমওসম তেওহার মানে যব খওফ শিবা কা উতর গয়া‚
আনজান উয়ো ইস বাত সে থী কী‚ গাও বসা নেহী‚ বিখর গয়া।
সও কৌরব একঠঠা হুয়া‚ অব শকুনী কী চাল খেলেঙ্গে‚
পর শান্ত শিব কো না ঝেল পায়া‚ ও শিব তাণ্ডব কেয়া ঝেলেঙ্গে?//
অবশ্যই এখানে শান্ত শিব মানে শিবাজীর কথা আর শিব তান্ডব বলতে শম্ভুজীর কথা বলা হয়েছে। ইনফ্যাক্ট মুঘলরা কম পরাজিত বা বিদ্রোহী রাজাকে হত্যা করেনি। কিন্তু শম্ভুজীর মতো অত্যাচার আর কাউকেই করেনি। এর থেকেই বোঝা যায় যে শম্ভুজীকে নিয়ে ওরা ঠিক কেমন আতঙ্কে থাকত।
জীবনে শম্ভুজী একেবারে সদাশিব ছিলেন না। কম বেশী ভুল তিনি অবশ্যই করেছেন। তবে সেইসব কিছুই নিমেষে ক্ষমা করে দেওয়া যায় প্রবল অত্যাচারের মুখেও হিন্দু ধর্ম ত্যাগ না করা আর অবশেষ জীবন পর্যন্ত দিয়েও হিন্দুধর্মের সম্মান বজায় রাখার কারণে।
যাইহোক‚ শম্ভুজীর পর রাজা হলেন শিবাজির অপর পুত্র রাজারাম। এই ভদ্রলোক মানসিক ও শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। যুদ্ধ বা রাজনীতি - কোনোটাই তার দ্বারা সম্ভব ছিলো না। ফলে তিনি যেটা করলেন তা হল মূল শাসনকেন্দ্র আরো দক্ষিণে সরিয়ে নিলেন আর শাসনভার গিয়ে পরল মন্ত্রী সেনাপতিদের উপরে। আর রাজারাম যা করলেন তা হল গণহারে সবাইকে প্রাদেশিক শাসক - সেনাপতি - সর্দার বানাতে শুরু করলেন। কেউ একজন তার কাছে গিয়ে আনুগত্য জানালেই তিনি তার কাঙ্খিত পদ দিয়ে দিতেন।
আর এতে ভালো খারাপ দুটোই হল।
খারাপ টা আগে বলি। এর ফলে মারাঠা সাম্রাজ্য ফেডারেশন এর চেহারা নিলো। বিষয়টা এমন দাঁড়াল যে ছত্রপতিকে ( আসলে পেশোয়াকে) ট্যাক্স দিলেই সে নিজের এলাকায় স্বাধীন। কোনো কেন্দ্রীয় শাসন - রাষ্ট্রচিন্তা ইত্যাদি গড়ে ওঠেনি মারাঠাদের ভেতর! যে যার মতো ব্যক্তস্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। যে সমস্যা শেষ দিন পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যকে ফাঁপড়া করে দিয়েছে। এমনকি স্বার্থ নিয়ে সঙ্ঘাত বাঁধায় এক আঞ্চলিক শাসক খোদ পেশোয়াকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিয়েছে - এমন ঘটনাও ঘটেছে।
আর ভালো দিক যেটা ছিলো তা হল স্থানীয় শাসকরা শাসন ক্ষমতা পেয়ে যাওয়ায় মন প্রাণ দিয়ে লড়াই করত। কারন স্বাভাবিক‚ যেটা তার নিজের ব্যক্তিগত এলাকা - সেটা বাঁচানোর জন্যে তারা লড়বে না? ইনফ্যাক্ট সেই পরিস্থিতিতে এর থেকে ভালো উপায় সম্ভবত আর কিছু ছিলো না।
ফলে রাজারাম বা তার পরবর্তী সময়ে দেখা গেল পুরো দাক্ষিণাত্য মারাঠা গেরিলাতে ভরে গেছে। শিবাজি বা শম্ভুজীর আমলে মুঘলরা জানত যে কাকে মারতে পারলে মারাঠারা দমে যাবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই রাজা। যেদিকে তাকাও সেদিকেই মারাঠা সর্দাররা লড়াই করছে স্বরাজ্য বাঁচানোর জন্যে। কাকে ছেড়ে কাকে ধরবে সেটা ঠিক করতেই মুঘলদের মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা হয়ে গিয়েছিল।
চারিদিকে থেকে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ পেতে পেতে মুঘলরা এমন আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল যে কোথাও ডালে ডালে আওয়াজ হলেই মারাঠা আসছে ভেবে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যেত।
তা এমনই এক অবস্থায় ১৭০০ সালের ১ লা অক্টোবরের কথা। একটা অভিযান শেষে মুঘলরা বিশ্রাম নিচ্ছে। এমন সময় হঠাত্ বৃষ্টি নামল। জলধারা বয়ে চলল পাহাড়ি পথে। এমনই এক ছোট জলধারা মুঘল শিবিরের উপর লাগতেই সবাই ভাবল যে মারাঠারা আক্রমণ করেছে। ফলে তাড়াহুড়ো করে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পরে গেল ঔরঙ্গজেব। সরে গেল ডান হাঁটুর হাড়। আর সারাজীবন সেটা ঠিক করা যায়নি। জীবনের শেষ সাত বছর বেচারাকে খুড়িয়েই হাঁটতে হয়েছে।
আর ঔরঙ্গজেবের চাটুকারেরা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত যে খোঁড়া হয়ে যাওয়াতে দুঃখের কিছু নেই। এটা তার পূর্বপুরুষ তৈমুর লংয়ের ঐতিহ্য!
(অনুপ্রেরণা : সৌভিক দত্ত)