আফ্রিকার এল ডোরাডো
আশা করি, এল ডোরাডোর কথা মোটামুটি সকলেরই জানা আছে। আমাজন বনের গহীনে লুকিয়ে থাকা আগাগোড়া স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো, হিরে-জহরত-মণি-মাণিক্যে ভরা এক শহর, যুগে যুগে যার ডাকে দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা মরণপণ করে ছুটে গিয়েছে।
স্থানের সাথে সাথে কিংবদন্তীও রূপ পালটায়। আফ্রিকার কথাই ধরা যাক, এখানেও এমন এক অসীম সম্পদ, অতুলনীয় ঐশ্বর্যের কাহিনী মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। আফ্রিকার লোককাহিনী, পালা-গান জুড়ে এই কাহিনী বহুল প্রচলিত। এমন এক গোপন জায়গা, যেখানে যুগের পর যুগ ধরে হাতিরা নিজেদের অন্তিম সময়ে এসে উপস্থিত হয় ও এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করে। হাতিদের গোরস্থান।
কিংবদন্তী বলে
ঝাঁক বেধে চলা পালে থাকা কোনও হাতি আগের থেকেই বুঝতে পারে তার শেষ সময় সমাগত। তখন সে তার আপনজনদের কষ্ট না দিয়ে, হাতির পালের চলার গতিতে বা যাত্রাপথে বাঁধার সৃষ্টি না করে আলগোছে সরে পড়ে। মন্দ্র পদক্ষেপে পৌঁছে যায় নিজেদের সেই গোরস্থানে যেখানে তাদের অজানা সংখ্যক ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষেরা এভাবেই একসময় এসে উপস্থিত হয়েছিল। সেখানে সে নীরবে, একাকী অপেক্ষায় থাকে মহাপ্রস্থানের।
একসময় মৃত্যুর করাল থাবা থেকে রেহাই পায়না স্থলভাগের দানবীয় প্রাণীটিও। সেখানে এসে নীরবে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া আরেকটি হাতিতে পরিণত হয় সে। হাজারো আইভরির মাঝে স্থান পায় তার সদ্য প্রাণ-হারানো দেহের জাঁকালো দন্ত-দ্বয়। এই কিংবদন্তীর শুরু কোথায় কিংবা কবে তার কোন লিখিত দলিল পাওয়া যায় না। তবে রাজসিক, রহস্যময় এবং বুদ্ধিমান প্রাণী বলে হাতিদের যে সুনাম যুগে যুগে ছড়িয়েছে আফ্রিকার প্রান্তরে, সেটাই যে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এই কিংবদন্তী গড়ে ওঠাতে তা বলাই বাহুল্য। সেই সাথে আধিভৌতিক শক্তির প্রভাবকেও কেউ কেউ এর কারণ বলেছেন।
ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে
এই লুকিয়ে থাকা গোরস্থানের খোঁজ হাজারো-লাখো শিকারি, আফ্রিকার আদিবাসী কিংবা আধুনিক গবেষকেরা করেছেন। যেই খুঁজে পাবে হাতিদের এই কিংবদন্তীতে বিবৃত গোরস্থান, বিনা আয়াসেই তার হাতের মুঠোয় চলে আসবে হাজার-হাজার হাতির দাঁত, মহামূল্যবান আইভরি; খোলা বা চোরাবাজারে যার মূল্যমান ঐ ব্যক্তিকে বর্তমান পৃথিবীর সবচাইতে ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করবে। অসংখ্য শিকারি, অভিযাত্রী সেই লোভে নিজের জীবনের লম্বা সময় জুড়ে এই কিংবদন্তীর পিছনে ছুটে চলে। অনেকে এমনকি মৃতপ্রায় বৃদ্ধ হাতির পিছু নিয়ে থাকে। একই হাতির পালকে অনুসরণ করে চলে বছরের পর বছর। কিন্তু, দেখা যায় তাদের একই গোলাকার পথ ধরে, বছরের পর বছর অন্ধের মত ঘুরিয়ে চলেছে সেই হাতিরা।
এখন পর্যন্ত তাদের থেকে পাওয়া কাহিনীগুলো শুধুমাত্র বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, কিংবদন্তীর অসারতা প্রমাণ করেছে। এখন পর্যন্ত কোনও সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় নি এই গল্পের পেছনে। অনেক লোক সেই অভিযান থেকে আর কখনো ফিরেও আসতে পারে না, হারিয়ে যায় আফ্রিকার গহীন অরণ্যে। প্রচলিত আছে, হাতিদের মধ্যে একধরনের ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় কাজ করে যা তাদের বুঝতে সাহায্য করে- 'পিছু নিয়েছে শিকারি।' তাই নিজেদের গোরস্থানে না গিয়ে, হাতিরা সেই শিকারিকে ভুল পথে নিয়ে যায় স্বেচ্ছায়। এমনও শোনা যায়, একধরনের অতীন্দ্রিয় শক্তি সবসময় রক্ষা করে চলে মানুষের হাতের নাগাল থেকে হাতিদের গোরস্থানকে। সেখানে লুকিয়ে আছে এমন এক জাদুর বই যা পৃথিবীর সকল যুদ্ধ, সকল ব্যাধির সমাধান দিতে পারে। কিন্তু, সেই সমাধান হাতে পাওয়া অত সহজ হলে তো কথাই ছিল না।
যখন নামে আঁধার
হাতিরাও আমাদের মতই অভ্যাসের দাস। এক প্রজন্ম নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে একই পথ অনুসরণ করে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পথ-পরিক্রমায় রত থাকে তারা। এই পথ চলার গতি কিন্তু কম না। কাজেই রোগাক্রান্ত, ক্লান্ত, বুড়ো কিংবা কোনও লড়াইয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হাতিরা সেই চলার তালের সাথে হাটতে না পেরে সরে গিয়ে নিজেদের পছন্দসই জায়গা বেছে নেয়। না না, গোরস্থান নয়। এমন কোন জায়গা- যেখানে কাছাকাছির মধ্যেই পানি আছে, খাবার আছে, আরামদায়ক বিশ্রামের সুব্যবস্থা আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বুড়ো হাতিদের দাঁত ক্ষয় হয়ে আসে, হয়ে যায় ভঙ্গুর। তখন নরম ঘাস-লতা-পাতার খোঁজে জলাভূমির কাছাকাছি নিজেদের আবাসস্থল গড়ে নেয় সেসব হাতিরা। মৃত্যু না, বাঁচার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এমন জায়গা বেছে নেয়া।
কিন্তু, দেখা গেল পানি একসময় শুকিয়ে গেলো গরমের প্রভাবে, খাবার ফুরিয়ে এলো, অন্য প্রাণীদের সাথে জায়গা-জমি সংক্রান্ত বিবাদে জড়িয়ে পড়তে হলো; অথবা আসলেই শেষ যাত্রার ডাক চলে এলো। কখনো কখনো পুষ্টির অভাবে দেহে গ্লুকোজের আধিক্য ঘটে, ফলে কোমায় চলে যায় হাতিরা আর এভাবেই একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। তখন একটা নির্দিষ্ট জায়গায় অনেকগুলো হাতির মৃতদেহ একত্রে পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু এমন নয় যে পরবর্তীতে অন্যান্য হাতিরা তাদের মস্তিষ্কের জিপিএস ব্যবহার করে সেই জায়গা খুঁজে বের করে মারা যেতে আসবে। অন্তত এই দুই হাজার বিশ সাল পর্যন্ত এমন কোন সুবিশাল গোরস্থানের খোঁজ কেউ পায় নি। অনেকসময় হাতিরা তাদের পাল থেকে দূরে সরে যায়, শুধুমাত্র নিজেদের আপনজনদের মনঃকষ্টের কারণ হওয়া থেকে পালাতে। কারণ, মৃত হাতিকে ঘিরে তার আপনজনদের সপ্তাহ-দুই ধরে দাঁড়িয়ে থেকে শোক পালন করতেও দেখা গেছে। বিখ্যাত অনেক শিকারি সেই দৃশ্যকে নিজেদের দেখা সবচাইতে আবেগময়, মর্মান্তিক দৃশ্যের মর্যাদা দিয়েছেন। আবার হাতিরা চায় নির্জন জায়গা খুঁজে বের করতে তাদের মৃত্যু-সময়ের জন্য। এটাও একটা ভূমিকা রেখেছে এই কিংবদন্তীর সৃষ্টিতে।
সত্যর খোঁজে
অবশ্য, কিংবদন্তীর কথা ছেড়ে হাতির গোরস্থান ধারণার পেছনে বাস্তব সূত্র খোঁজা শুরু করলে দুটো কারণ সবার আগে চোখে পড়ে। তার মধ্যে একটা হলো প্রাকৃতিক কারণ। আফ্রিকার চিরকালীন দুঃখ-গাঁথার অংশ, খরা। যার কবলে পড়ে অনেক সময় পালকে পাল হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। পানির আধার শুকিয়ে গেলে বা খাদ্যের উৎস যখন ফুরিয়ে যায়- হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া আরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ 'দুর্ভিক্ষ' তখন নির্দিষ্ট স্থান জুড়ে অসংখ্য হাতিদের মৃত্যুতে বড়ো ভূমিকা রাখে। আবার অন্যরকম প্রাকৃতিক কারণও রয়েছে। যেমন - লবণাক্তটা। অনেকেই ভুরু কুঁচকে ফেলেছেন, মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। কেনিয়ার লেক রুডলফের কাছে এরকম এক দঙ্গল হাতির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। পরে গবেষণা থেকে জানা যায় এই হাতির পাল নিজেদের অজ্ঞাতসারেই প্রচণ্ড লবণাক্ত এই হ্রদে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণ করতে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিল। দ্বিতীয় কারণটা, মানবসৃষ্ট। এই ঘটনা পশ্চিম আফ্রিকার। পুরো পশ্চিম আফ্রিকা জুড়েই তখন যুদ্ধের দামামা বাজছে। ছোট ছোট বিপ্লবী দল, সরকার, বিদেশী জান্তাদের মধ্যে বহুমুখী সংঘর্ষ। এর মধ্যে এক দল আরেক দলকে কৌশলগত ভাবে পর্যদুস্ত করতে বিশাল এলাকার মধ্যে থাকা একমাত্র বিশুদ্ধ পানির উৎসে বিষ মিশিয়ে দিল। কিন্তু, সেই বিষ খেয়ে মানুষের আগেই মরে সাফ হয়ে গেল অসংখ্য জন্তু-জানোয়ার, যাদের মধ্যে প্রচুর সংখ্যক হাতিও ছিল।
পোচিং ও পোচার
মানবসৃষ্ট আরেকটা কারণের কথা ভুললে চলবে না, 'পোচিং'। লোভ, সীমাহীন লোভ; মানুষদের অমানুষ করে তুলতে বিশাল ভূমিকা রাখে। সেই লোভই কিছুসংখ্যক মানুষকে করে তোলে পোচার। বিলুপ্তপ্রায় গণ্ডারের শিং এর মতন, হাতির দাঁতও এক মহার্ঘ্য বস্তু তাদের কাছে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের দেশীয় প্রবাদই আছে, মরা হাতি লাখ টাকা। আর জ্যান্ত হাতি দিয়ে পোচারদের কাজই বা কি। তাদের তো চাই ঐ ঝকঝকে, ধবধবে সাদা, বিশাল দাঁত দুটোকে। ২০১২ সালের কথা। সুদান থেকে একদল পোচার সীমান্ত পার হয়ে প্রবেশ করল ক্যামেরুনের বিখ্যাত বুবা নজিদা ন্যাশনাল পার্কে। তাদের সাঁড়াশি আক্রমণে প্রাণ হারালো, একটি-দুটি নয়, তিনশর উপরে হাতি। একই কাণ্ড ঘটেছিল জিম্বাবুয়ের হোয়াঙ্গে ন্যাশনাল পার্কে। এবার পোচারেরা আরও নিকৃষ্টতার পরিচয় দিয়ে সায়ানাইড প্রয়োগে হত্যা করল প্রায় চল্লিশটির মতন হাতিকে। এই বিশাল সংখ্যক হাতিদের মৃত্যু, সেই কিংবদন্তীর গোরস্থানকেও বুঝি ম্লান করে দেয় তুলনায়। আমরা ছাড়া আর কে পারে এতটা নিচুতে নামতে? দিনকে দিন পৃথিবীতে বেড়ে চলছে আইভরির চাহিদা। তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে পোচারদের সংখ্যা ও নিত্য নতুন উপায়ে হাতি-নিধন। প্রতি বছর হাজারো হাতি প্রাণ হারায় পোচারদের জন্য। জঙ্গল-রক্ষীরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলছে প্রযুক্তির সহায়তায় ও নিজেদের শ্রম দিয়ে এই বিশালাকার প্রাণীদের রক্ষা করতে। কিন্তু, পোচারদের কুটিলতার কাছে প্রায়ই হার মানতে হয় তাদের। পায়ে হেঁটে, গাড়িতে চড়ে, জিপিএস ট্র্যাকারের মাধ্যমে কিংবা রেডিও-কলার দিয়ে হাতিদের উপর নজর রাখা হয়, তাও পোচারদের হাত থেকে মুক্তি নেই।
রহস্যময় ঐরাবত
কিংবদন্তীর সাথে যুক্ত থাকে আবার উপ-কিংবদন্তী। এখানেও তাই। কথিত আছে, এভাবে হাতিরা নিজেদের মৃত্যু একটা নির্দিষ্ট গোরস্থানেই ঘটায় যাতে তাদের বংশধরেরা পরবর্তীতে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আসতে পারে এই গোরস্থানে। তাহলে, যদি গোরস্থানের দাবীটাই ভুয়া হয়; তবে কি এই ফিরে আসার-শ্রদ্ধা জানানোর কাহিনীও মিথ্যা? মোটেও না। এখানে অবশ্য ভিন্নমত আছে। মানুষ ছাড়া হয়তো হাতিই একমাত্র প্রাণী যারা নিজেদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য শোক-শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। হাতিরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের মৃতদেহের অবশিষ্ট হাড়গোড়ের সামনে এসে সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে।
দেখা যায়, পূর্ববর্তী কোন হাতির হাড়ের পাশে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাতির পাল- তাকিয়ে আছে, কি যেন ভাবছে। চোখের কোণে অশ্রুও দেখা যায় তাদের, আলতো করে শুঁড় দিয়ে স্পর্শ করে হাড়গুলোকে, অনেকসময় তুলে নিয়ে সাথে করে দূর-দূরান্তে নিয়ে যায় কিংবা কখনো কখনো নিজেদের মত করে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়, সাজায়। নিজেদের পূর্বপুরুষ, এমনকি একই পালের সদস্য না হলেও, শুধুমাত্র স্বজাতির হাড়ের সামনে এসেও হাতিদের এই তীব্র অনুভূতির প্রকাশ দেখা যায়। অবশ্য, বিশেষজ্ঞদের মতে হাতিদের মস্তিষ্কের আকার অন্য দশরকম প্রাণীর চাইতে অনেক বড়, সেরিব্রাল কর্টেক্স-এর এই বৃহৎ আকারের কারণে স্মৃতি, আবেগ ও অনুভূতির পরিমাণ হাতিদের মধ্যে তুলনামূলক বেশিই পরিলক্ষিত হয়।
তবে, ব্যাপারটা এমন না যে, তারা ঐ গোরস্থানে পৌঁছানোর জন্য লম্বা পথ পারি দিয়েছে। তাদের নিয়মিত চলার পথের খুব কাছে-ধারে যদি নিজেদের পূর্বপুরুষদের দেহাবশেষ থাকে তবে সেখানে গিয়ে হাতিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় যেন নিঃশব্দে বলছে, "যেভাবে নিজেদের শক্তি-মদ-মত্ত পায়ে পৃথিবীর ধুলোয় নিজেদের পদচিহ্ন রেখে গেছ, সেভাবে আমিও হেঁটে চলছি তোমার দেখানো পথ ধরে হে পূর্বজ।"
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৩:২৮