somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতীত, আমি ভবিষ্যৎ তোমায় ধিক্কার জানাই

০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন ২২০০, ২রা নভেম্বর। গ্লোবাল সময় ২১৪০ মিনিট।

বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক হাইপেসিয়া এওয়ার্ড বিজয়ী বিজ্ঞানী প্রজ্ঞা তার পরবর্তী প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। সূর্য উঠতে মাত্র প্রায় দুঘণ্টা বাকি। প্রজ্ঞার কাজ প্রায় শেষের দিকে, প্রাপ্তির ক্ষুধা যেন তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সমাধান মিলেও মিলছে না। বিরক্ত হয়ে সামনে থাকা ভাসমান হোভারবোর্ডটা লাথি দিলো। সেটা পুরো রুম ঘুরে গতি কমে আবার প্রজ্ঞার সামনে এসেই থেমে গেল।

প্রজ্ঞাঃ পেয়েছি !! “ক্রোধ”। এটাই তো বাকি ছিল। এখন কাজ করবে।

কম্পিউটার স্কিনে কয়েক কোটি লাইন কোডের নিচে কার্সন আপনাআপনি চলে গেল। প্রজ্ঞা চিন্তা করছে আর হাজার হাজার নতুন কোডের লাইন যুক্ত হচ্ছে। প্রজ্ঞা চেয়ারে বসে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে স্কিনের উপর। ভাসমান চেয়ার প্রজ্ঞার অস্বাভাবিক হার্টবিট লক্ষ করে প্রজ্ঞাকে সাবধান করছে। কিন্তু প্রজ্ঞার চোখ স্কিনের দিকেই। তার চেয়ার স্কিনের আরও সামনে চলে আসলো। কোড লেখা শেষ। প্রজ্ঞা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো,

“সিমিউলেশন চালু কর”

“প্রজ্ঞা, মনে হচ্ছে নতুন কোডগুলো কাজে লেগেছে। তোমার প্রোগ্রামটি প্রায় ৭০০ পেটাবাইটের। সিমুলেসন চালু করতে একটু সময় লাগবে। তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য কিছু বানাতে পারি, সময় কাটানোর জন্য। ” কম্পিউটার থেকে আওয়াজ আসলো প্রজ্ঞার ব্যাক্তিগত কৃত্তিম বুদ্ধিমান অ্যাসিস্ট্যান্ট ধ্রুব-র কাছ থেকে।

“ধন্যবাদ, ধ্রুব। আমার মনে হয় অপেক্ষাকেই আমি একটু উপভোগ করতে চাই।”

কিছুক্ষণ পড় স্কিনে লেখা উঠলো সিমিউলেশন সমাপ্ত, “সরকার” চরিত্র এখন সক্রিয়। রুমের হলোগ্রামটি চালু হয়ে গেল। প্রজ্ঞা এখন সিমুলেশনকে দেখছে। মধ্য বয়স্ক একজন লোক একটি কাঠের চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। পড়নে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের কোন রাজার মত জামা, মাথা উঁচু করে চারিদিকে ঘুরে তাকাচ্ছে; যেন কোন ধারনাই নেই সে কোথায় আছে।

“স্বাগত, সরকার। আপনি কি আমার কথা শুনতে পারছেন?” প্রজ্ঞা জিগ্যেস করলো।
“ আমি কোথায় ? কে আপনি” সরকার উত্তর দিলেন
“ প্রথম প্রশ্নের উত্তরটি আপনার কল্পনার বাইরে। আপনার যুগে সেটা কেউ অনুধাবন করতে পারার কথা না। দ্বিতীয় প্রশ্নটাও হয়তো আপনাকে সন্তুষ্ট করবে না। আমার নাম প্রজ্ঞা। আমি আপনাকে তৈরি...”
(সরকার প্রজ্ঞাকে থামিয়ে কথা বললো )
“ প্রজ্ঞা?! এ কেমন নাম? আপনার জাত কি ? আপনি নারী না পুরুষ? কিছুই তো বুঝা যাচ্ছে না। অদ্ভুত ব্যাপার, যত্তসব”

প্রজ্ঞা, মনে মনে ভাবছে “যাক! ক্রোধের প্রোগ্রামটা ঠিক মত কাজ করছে।

“আমি যেটা বলছিলাম, আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো আপনার হজম হবে না। আপনাকে বানানো হয়েছেই সেই যুগের মানুষের চিন্তাধারাকে জানার জন্য। তবে হ্যাঁ, আমি একজন নারী। আশা করি এটা বুঝতে পারবেন।”

“নারী! এত বড় অপমান আমার সাথে ! এক নারীর সাথে আমার কথা বলা লাগছে!! আপনার অভিভাবক কোথায়? আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না।”

“আমি এখন যে যুগে আছি যেখানে পূর্ণ বয়স্ক নারীর অভিভাবক সে নিজেই।”

“কি বর্বরতা! আর কি বাকি আছে ? মেয়েদের সমান সম্পত্তি দেয়া ? নেতৃত্ব দেয়া? হাতে হাতিয়ার তুলে দিয়ে সুরক্ষার কাজ করানো ?”

“হ্যাঁ। হ্যাঁ। এবং হ্যাঁ। যদিও এখন আর সুরক্ষার কাজের জন্য নারীপুরুষ কারোরই দরকার পড়ে না। মেশিনই আমাদের এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে মুক্তি দিয়েছে। তবে মেয়েরা ছেলেদের মত সমাজের যেকোন সিদ্ধান্তে অন্য লিঙ্গের মতই সমান সুযোগ ও অধিকার চর্চা করে।”

“সমান অধিকার ! হাহাহা! হাসালেন। আপনি কি উম্মাদ ! নারীর কাজ হচ্ছে শুধুই সংসার দেখা, তার পুরুষকে খুশি রাখা আর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা। তাদের এর বাইরে নিয়ে আসলে সমাজে নৈরাজ্য আর ধ্বংসই নিয়ে আসবে। হ্যাঁ নারীদের আমরা সিংহাসনে বসিয়েছি, ক্ষমতাবাদদের কাছের মানুষদের সম্মান দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু সেটা শুধুই ক্ষমতাকে ধরে রাখার জন্য, শ্রেণীসমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু বাস্তবে তাদের যোগ্যতা তাদের শরীর দিয়ে পুরুষকে প্রশান্ত করার মধ্য দিয়েই শেষ হয় । ”

“ইস! যদি বর্বর অতীতকে ভবিষ্যতের এক ঝলক দেখাতে পারতাম।
সরকার, বদ্ধ ও রক্ষণশীল সমাজগুলো ধীরে ধীরে সেকেলে হয়ে সমাজে টিকে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে। অর্ধেক জনসংখ্যাকে ঘরে বসিয়ে রেখে সমাজ শুধু যে সিদ্ধান্তের সময় বৈষম্য করেছিল তা না, সাথে সাথে অগ্রগতিতেও বিরাট ব্যবধান তৈরি করেছে। শেষ শতাব্দীতে নারীরা আর প্রগতিশীল পুরুষরা বিদ্রোহ করে সেসব সমাজকে বিলুপ্ত করেছে। যদিও আদর্শের লড়াই বিলুপ্ত হয় না, কিন্তু যখন সমাজ ধীরে ধীরে শিক্ষার সমাজ সুযোগ পেতে শুরু করলো আর জরাজীর্ণ শোষণকারী আদর্শগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেল। প্রথমে রিফর্ম এর নামে এরপর একেবারেই গোঁড়া থেকে ঝেড়ে ফেলার নামে।”

“বলতে হবে। এক নারী হয়ে এত গভীর গভীর কথা বলছো ! কল্পনাতীত।”

“এমনই হয় যখন শিক্ষা আর সুযোগ সবার কাছে থাকে।”

“যাই হোক, নারীজাত নারীজাতই। হাজার বছরেও তাদের পুরুষের সমান হওয়ার সম্ভব না।”

“ইতিহাসই সাক্ষ্য, সরকার সাহেব। আফসোস আপনাদের ক্ষমতালোভ আর হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা ভয়নির্ভর সভ্যতা খুব দেরি করে দিল সব কিছুকে। কিন্তু বিলুপ্তির পরিণতি অবধাবিতই ছিল। কারো শরীরের পার্থক্য আছে বলে তো আর তার মালিক হওয়া যায় না। থাকতে পারে না। ”

“প্রজ্ঞা, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন দাসদের কথা? তারা আছে বলেই সভ্যতার এত উন্নতি হয়েছে। মানুষ বড় বড় মহাআশ্চর্য বানিয়েছে, সুবিশাল ইমারত বানিয়েছে। ক্রীতদাসদের পিঠে চাবুকের দাগ যতদিন কাচা থাকবে, একটা সাম্রাজ্য ততদিন বৃহৎ আর মহান থাকবে।”

“সরকার সাহেব; কোন সুউচ্চ ইমারত, কোন বিশাল মানব আশ্চর্য আমাদের মানবিকতার ঊর্ধ্বে না। কেমন লাগতো যখন আপনি সারাজীবন চাবুকের আঘাত পেতে পেতে কাজ করছেন আর আপনার সম্রাট আপনাকে আঘাত করাকেই গৌরব মনে করতো ?”

(সরকার ব্রু কুচি করে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে, এরপর চেয়ারে আরও পিঠ হেলিয়ে উত্তর দিলো)

“সমাজ এভাবেই চলে, প্রজ্ঞা। হ্যাঁ, আমি সৌভাগ্যবান যে আমি এক সম্রাজ্ঞীর পেটে জন্ম নিয়েছি। কোন দাসীর পেটে না। আমি স্বীকার করি যে আমার মেনে নিতে কষ্ট হত ক্রীতদাস হলে; এই প্রশ্নটা আপনি প্রথম করেননি। কিন্তু সমাজ এভাবেই চলে। একজন ব্যাক্তি দাস কেনা থেকে বিরত থাকলে দাসপ্রথা বন্ধ হবে না। তাছাড়া আপনি কি কল্পনা করেছেন এমন একটা সমাজ যেখানে কেউ দাস থাকবে না? কেউ কারো কথা শুনবে না? ক্ষমতা ভেঙ্গে সমাজে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। বিশ্ব আর কখনো উঠে দাঁড়াবে পারবে না।শুধুশুধু কি আমাদের পণ্ডিতরা দাসপ্রথা নিয়ে সমর্থন করে? আমি চাইলে মুচলেকা দিতে পারি। যেদিন দাস থাকবে না, সেদিন সভ্যতাও থাকবে না।”

“সরকার সাহেব, দাস প্রথার বিলুপ্তি হয়েছে শতাব্দী পেরিয়ে গিয়েছে। পৃথিবী শুধু মানবতার রক্ষাই করেনি; সাথে সাথে অকল্পনীয় নতুন আশ্চর্য নিয়ে এসেছে। আমরা অন্য গ্রহে গিয়েছি, সেখানে বসবাসও করছি; হাজারো দুরারোগ্যকে আমরা নিরাময় করেছি; পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কয়েক মিনিটে পৌঁছে যাওয়ার ক্ষমতা পেয়েছি। এটা এক দাসহীন সমাজের গল্প”

“হাহাহা। আমাকে কি বোকা পেয়েছেন? মিথ্যা গল্প বলে কোন কিছুর প্রমাণ হয় না। আচ্ছা আপনার জাতটা কি বলুন তো। আমার মনে হয় আপনি বিজাতি চক্রান্ত করছেন এখানে। আপনি বেশ মজা করতে পারেন, যদিও আমার মতের সাথে মিল নেই। আপনি আমার দরবারে একবার গল্প শুনাবেন। ন্যায়বিচারের কারণে আপনার এই স্পর্ধার জন্য বাঘের খাঁচায় পুড়ে আপনাকে মারা হবে; কিন্তু তার আগে আমার মন্ত্রীসভায় একটু মনোরঞ্জন হয়ে যাবে। হাহহাহহা। এরপর কি বলবেন? প্রাণীদের অধিকারের কথা? তাদের খাঁচায় রেখেছি কেন? হাহাহাহা”

“প্রাণীদের অপ্রয়োজনীয় অত্যাচার করা, যন্ত্রণা দেয়া, শোষণ-পীড়া দেয়া নৈতিকতা বহির্ভূত। আমাদের যুগে এটা নিষিদ্ধ, যদি না কেউ অতি প্রতিকুল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য করে।”

“ও আচ্ছা। জীব হত্যা মহাপাপ !? জাত বুঝিয়ে দিলেন। জত্তসব। তীর ধনুক দিয়ে হরিণ মেরে সেটা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার যে কি মজা সেটা কখনো বুঝবেন না। আত্নাকে কষ্ট দেয়ার কোন মানে নাই, প্রজ্ঞা সাহেবা। এটা জগতের নিয়ম। মাটির সারে বৃক্ষ বেড়ে উঠে তার পাতা হরিণ খায়, সেই হরিণ আমি খাই, আমার দেহও আবার উদ্ভিদের খাবারের যোগান দিবে। এটাই নিয়ম, এটাই জীবনচক্র। তাহলে বাঘ, ভাল্লুককে শাঁক খাওয়ানো শুরু করেন। হাহাহা”

“ব্যাপারটা পাপপুণ্যের না। প্রাণীদের নির্দিষ্ট অনুভূতি আছে। সেটা মানুষের মত না, তবে তাদের যে যে অনুভূতিগুলো আছে সে সে অনুভূতির প্রতি মান রাখাটায় জরুরি। কারণ আমি অন্য প্রাণী হয়ে জন্মালে আশা করতাম মানুষ যেন আমাকে অপ্রয়োজনে অত্যাচার না করে। আর প্রাণীদের অত্যাচার না করে, হত্যা না করেও আমরা আমাদের সকল চাহিদা পূরণ করতে পারি, সুস্বাদু খাবারও পেতে পারি। এটা জেনে তাদের হত্যা করাটা পৈশাচিক বটে। আর বাঘ বা ভাল্লুকের শারীরবৃত্তীয় ক্ষমতার কারণে তারা বাধ্য মাংস খেতে। কিন্তু আমরা না, আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও বিকল্প ব্যবস্থা আছে নুন্যতম নিষ্ঠুরতা করে বেচে থাকার। মানুষ এইসব থেকে বিরত থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয় না, বরং এটা চালিয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তার মাসুল আজ ২০০ বছর পরেও দিতে হচ্ছে। তাই জেনে শুনে যারা এইসব বাদ দেই নি তাদের এই যুগে সবচেয়ে বেশি ধিক্কার জানানো হয়। ”

“প্রজ্ঞা, আপনার উভয়মুখি চিন্তায় আমার হাসি পাচ্ছে। তাহলে উদ্ভিদ বাদ দিচ্ছেন কেন ? তারা কি দোষ করেছে তাদের কি বাচার অধিকার নেই?”

“আজ থেকে ২০০ বছর আগে যখন প্রথম এই চিন্তাধারা সুগঠিতভাবে শুরু হয়েছিল তখন প্রথমে প্রাণীদের অবস্থার পরিবর্তনের সংগ্রামই ছিল মুখ্য। কারণ চাহিদা মেটানোর জন্য উদ্ভিজ খাবার অনিবার্য ছিল। কিন্তু উদ্ভিজ খাবারের মাধ্যমে চাহিদা পূরণ করলে কম জীবের ক্ষয় হয়, কম জমির অপচয় হয়, কম পরিবেশ নষ্ট হয়; কম স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। ধীরে ধীরে কৃত্তিম খাবার আসার সাথে সাথে আমরা উদ্ভিদের শরণাপন্ন হওয়ার ধীরে ধীরে কমাতে শুরু করলাম। প্রায় ৪০-৫০ বছর ধরে এখন আর কোন জীব নাশ করা হয় না আমাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য। আমাদের খাবার এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সুস্বাদু, সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর ও পরিবশসম্মত। এইসবই হয়েছে কারণ ২০০ বছর আগে মানুষরা সমাজের স্বাভাবিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে মানবতার জন্য লড়াই করেছে। তখন তো নিষ্ঠুরতাই ছিল সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তাদের সাহসিকতা, ধৈর্যকে বিশ্ব আজও উদযাপন করে।”

“আপনি থামুন! থামুন! আর শুনবো না। আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার হাতে এখন তরবারি থাকলে আপনার শিরচ্ছেদ করে দিতাম। আমি পরওয়া করি না আপনি স্বজাতি না কুজাতি; উম্মাদ না সুস্থ, প্রবঞ্চক নাকি সত্যবাদী, নারী নাকি পুরুষ। আমার স্বাচ্ছন্দ্যের আদর্শকে, আমার আত্নার শান্তির চিন্তাধারাকে আপনি তিরস্কার করছেন। এর পরিণাম আপনি পাবেন।”

কম্পিউটার স্কিনে Error Message আসছে। প্রোগ্রাম ওভারলোড করছে। হলোগ্রাফের সামান্য ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। কিন্তু প্রজ্ঞা গভীরভাবে ডুবে গিয়েছে তার সিমুলেশনে। সে আরও শুনাতে, আরও বলতে চায়।

হঠাৎ হলগ্রাফ বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পড় চালু হল। প্রজ্ঞা অবাক। সরকার আর বসে নেই, সে প্রজ্ঞার থেকে ৩ ফুট দুরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বড় বড় চোখে ক্রোধ দেখতে পাচ্ছে প্রজ্ঞা। তার চেহারা লাল হয়ে আছে। যেন এত অবজ্ঞা কেউ কখনো তাকে করেনি। সে দাঁত চিবিয়ে জিগ্যেস করলো,
“কেন জিগ্যেস করছন আমাকে ? কি চাও ?”

কম্পিউটার থেকে আওয়াজ আসলো ধ্রুবর,
“প্রজ্ঞা। আমি দুঃখিত কিন্তু মনে হচ্ছে সিমুলেশনটি অতিরিক্ত প্রসেসিং শক্তি ব্যয় করছে। এই গতিতে বৃদ্ধি পেলে প্রোগ্রাম খুব শীঘ্রই কাজ করা বন্ধ করে দিবে।”

“একটু অপেক্ষা কর, ধ্রুব। আমি আরেকটু দেখবো”

প্রজ্ঞা আরেকটু সামনে গেল, সরকারের চোখের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকালো, এরপর বললো,

“ ছোট বেলা থেকে ইতিহাসের প্রতি ছিল আমার তীব্র আগ্রহ। আমি এমন যুগে জন্ম হয়েছিল যখন সভ্যতার অধিকাংশ নিপীড়ন, বৈষম্য, অত্যাচার, শোষণ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যখন অতীতের মানুষের অন্ধ-আস্থা, অহংকার, নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অন্যকে মূল্য না দেয়ার এমনকি অবর্ণনীয় অত্যাচার মেনে নিয়ে সেটাকে যথার্থ ও নিয়ম চলে গর্ববোধ করতো। এমন ন্যাকারজনক কাজ আমি যে পড়েছি আমার ইচ্ছা করতো অতীতে গিয়ে সেসব মানুষদের ধিক্কার দিয়ে আসতে। যাদের গড্ডালিকায় গা ভাসানোর জন্য আমরা হাজার বছর পিছিয়ে আছি।কিন্তু হায় পদার্থবিজ্ঞানের বাস্তবতা! আমি পারিনি, পারছি না। তাই আমি আপনাকে বানিয়েছি। কারন আমি অতীতের এক ক্ষমতাধরকে বুঝাতে চেয়েছি যে তারা কতটা ভুল ছিল, কতটা অনিষ্টকারী ছিল। তাদের প্রতিটা হাসির মধ্যে কতটা মূর্খতা, অহংবোধ, আত্নরতি ছিল। তারা ভেবেছে তাদের একার অমঙ্গলজনক কর্ম সমাজে কোন পার্থক্য আনবে না। কিন্তু এমন মানুষ যখন সমাজ ভর্তি ছিল, তখনই আমরা বিপর্যয়ে পড়ি। আমরা ইতিহাসে প্রথমবার অস্তিত্ব সংকটে পড়ি, দেড় শত বছর আগে; এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। হ্যাঁ, আজ আর বৈশ্বিক উষ্ণতার ভয় নেই; আজ আর কোন মানুষের উপর অনাধিকার চর্চা করা হয় না, কোন প্রাণীকে অবর্ণনীয় অপ্রয়োজনীয় শোষণ করা হয় না। এখনো অনেক পথ বাকি কিন্তু মানবতার জয় হচ্ছে। যাদের নিয়ে ঠাট্টা করে তোমরা বলেছিলে ‘এই জগত কখনো বদলাবে না’ আজকে তাদের নাম স্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। আর তোমাদের নাম হয়তো ইতিহাসে নেই, আর থাকলেও ধিক্কারের সাথেই বলা হয়। কাল যারা মানুষকে মানুষ মনে করে নাই; তাদের ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে, শিকল দিয়ে বেধে চাবুক দিয়ে প্রহার করেছে তারা সমাজে যত বেশিই থাকুক না কেন আজকে তাদেরই উত্তরসূরি তাদের সমাধিতে যেতে লজ্জা পায়। যারা স্বাদের জন্য প্রাণীদের অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতাকে মেনে দিয়েছিল; তাদের প্রানিভোজী বলে তাদেরকে মদ্যপায়ী, ধর্ষকের মতই ধিক্কার দেয়া হয়। হয়তো আমাদের ঘৃণিত পূর্বপুরুষরা কখনো কল্পনাও করে নাই গড্ডালিকা প্রবাদে গা ভাসিয়া আর স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিবেককে চুপ করিয়ে থাকার জন্য তাদের এই পরিনাম হবে।তাই আমি আপনাকে বানিয়েছি, সরকার; কারণ অতীতের সকল দুর্বল, ভীত, মূর্খ, লোভিদের আপনার মাধ্যমে ধিক্কার জানাতে চাই। আমি ধিক্কার জানাই।”

সরকার নিস্পলক তাকিয়ে আছে প্রজ্ঞার দিকে। এমন কথার মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। সে এক কদম সামনে আসলো; আর হাত পা শক্ত; যেন ধৈর্যের সব বাধ অতিক্রম করেছে প্রজ্ঞা। এমন সময় হলগ্রাফ বন্ধ হয়ে গেল। প্রজ্ঞা দ্রুত চারদিকে তাকালো। যেন আর ইচ্ছা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।
“ধ্রুব, কি হয়েছে?”
“সিস্টেম ওভারলোড হয়েছে। আমার মনে হয় এই প্রোগ্রাম প্রস্তুত ছিল না এমন ইনপুটের জন্য।”

প্রজ্ঞা দীর্ঘশ্বাস দিলো। দরজা খুলে বারান্দায় গেল।
সকাল হয়ে গিয়েছে।
ভোরের প্রথম আলো প্রজ্ঞার মুখে এসে লাগছে।

“প্রজ্ঞা, তোমার একটু বিশ্রাম নেয়া উচিত।”

“হ্যাঁ, ধ্রুব। শুধু এই সকালের আলোর অপেক্ষায় ছিলাম।”
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×