হুমায়ূন আহমেদটা ফট করে মরে গিয়ে আমার মত সস্তা, বাজারী বই পাঠকদের বড় বিপদে ফেলে দিয়ে গেছে! বুঝতেই পারছেন যে আমি উচ্চমার্গীয় কোন পাঠক না, শুধুমাত্র মনের আনন্দের জন্যই পড়ি। দূর্মূল্যের বাজারে সস্তায় ভাল বই দেবার প্রতিশ্রুতি দীর্ঘদিন পালন করার পর আমার প্রিয় সেবা প্রকাশনীও নিয়েছে পুঁজিবাদী চেহারা! ভাল লাগছিলনা কিছুই। ল্যাপটপের সবগুলো মুভিই দেখা হয়ে গেছে, অনেকগুলো একাধিকবার। ঘরে নতুন কোন বইও নেই যে পড়ার চেষ্টা করব। আজকাল নতুন কোন বই আর কেনা হয় না। বাধ্য হয়ে তাই পুরনো বইয়ের শরণ নিতে বহুদিনের অগোছাল, ধূলোজমা লাইব্রেরীটার দিকেই হাত বাড়ালাম।কিন্ত অজান্তেই হাতে হুমায়ূনর হিমুর বদলে উঠে এল রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা। তিন গোয়েন্দা! আমার কৈশোরের প্রথম ভালবাসা, শুধই কি আমার? একটা সময় ভাবতাম কোনদিনও তিন গোয়েন্দাকে ছাড়তে পারবনা! কিন্তু তিন গোয়েন্দাই যে আমাকে ছেড়ে চলে গেল! কোন ক্লাসে পড়ি তখন, ঠিক মনে নেই। হঠাৎ করেই আমার সবচেয়ে প্রিয় তিন বন্ধু কিশোর, মুসা আর রবিন সাইকেল চালানো ছেড়ে দিয়ে চালানো শুরু করল গাড়ি.... ফোক্সওয়াগন, জেলপি, হোন্ডা একর্ড। এবং কিছুদিন পরই প্লেন!... সেসনা টু সিটার! এখনো মনে আছে, অভিমানে আমার প্রিয় সাইকেলটায় তালা মেরে রেখেছিলাম বহুদিন! কিন্ত তিন গোয়েন্দাকে তো ছাড়তে পারব না। তাই সান্তনা খুজলাম এই ভেবে যে আমিও তো বড় হচ্ছি; কদিন পরে আমিও চালাব বিমান, নিদেনপক্ষে চারচাকা! আমাকে সে সময়টুকুও দিলনা আমার প্রিয় বন্ধুরা! তাঁরা বিমান ছেঁড়ে উঠে পড়ল স্পেসশিপে! মেনে নিলাম তবুও। প্রানের বন্ধুদের কি এত সহজে ছাড়া যায়! কিন্তু আর পারলাম না তখন, যখন রবিন ঢুকে পড়ল মাছের পেটে, মুসা হয়ে গেল মৌমাছি আর কিশোর.........! ভূত প্রেত, ডাইনি জাদুকর আর যাবতীয় অলৌকিকতায় যার অন্ধ অবিশ্বাস ছিল, সেই কিশোর পাশা যাদুর গাছে চড়ে জিনাকে সাথে নিয়ে অতীত ভবিষ্যত করে বেড়াতে লাগল! আমি বর্তমানের মানুষ, অতীতে ভবিষ্যতে ঘুরে বেড়ানো আমার কাজ না! (তবুও মাঝে মাঝেই যাই, জাফর ইকবাল, আসিমভ কিংবা আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে, নিতান্ত খারাপ লাগেনা!) কাজেই তিন গোয়েন্দা কে বিদায় বলতে হল, ......................., নাকি ওরাই আমাকে বিদায় করে দিল! আমার মত শত সহস্র স্বপ্নাতুর কিশোর কিশোরীকে! কেন এমন হল? ভেবে কূল কিনারা পাইনি। অভিমান হয়েছে রকিবদার উপরে, সেবার উপরে। অনেক পরে কিছু কিছু জানলাম। কিছু সেবার বইয়ের আলোচনা বিভাগ থেকে, কিছু ইন্টারনেট ঘেটে আর কিছুটা সেবা প্রকাশনীতে লেখালেখির সাথে জড়িত কয়েকজনের কাছ থেকে (অল্প কিছু লেখকের সাথে স্বল্প পরিচয় আছে আমার)। নিজে জানলাম, বিভিন্ন তিন গোয়েন্দা ভক্তদের জানিয়েছিও মাঝে মধ্যেই, আধাছেড়া ভাবে। ফেসবুকে সেবা প্রকাশনীকে নিয়ে একটি ছোটখাট পেজের আমি তারচেয়ে ছোটখাট এডমিন। সেখানে তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে প্রায়ই আমি পোষ্ট দেই। কাজটা আমি নিজের আনন্দের জন্যই করি, কিন্তু তিন গোয়েন্দা ভক্তরা তাতে সারা দেন তিন গোয়েন্দার প্রতি গভীর ভালোবাসায়। আজ আমি যা জানাবো তার বেশির ভাগই বিচ্ছিন্ন ভাবে আগেই জানিয়েছি, নতুন কিছু তথ্য থাকলেও থাকতে পারে যেটা অনেক নতুন তিন গোয়েন্দা ভক্তই হয়তো জানেন না। তাতে সমস্যা নেই, টুকটাক লেখালেখি আমি নিজের আনন্দের জন্যই করি, কিছু জানা বা কাউকে জানানোর জন্যে নয়। লেখাটি যে জন্য শুরু করেছিলাম, সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আমার মনটা ভাল হয়ে গেছে। তিন গোয়েন্দা! আজও মন ভাল করে দেয়! অনেক বছর আগে আমাকে ছেড়ে চলে যাবার পরও! কে জানে, হয়তো চলে যায়নি! হৃদয়ের কোন গোপন অলিন্দে লুকিয়ে আছে, আবারও প্রস্ফুটিত হবার অপেক্ষায়!
লম্বা ভূমিকা শেষ, এবার মূল বিষয়ে আসি (বাঁশের চেয়ে কঞ্চি লম্বা হয়ে গেল! দূঃখিত) -
তিন গোয়েন্দা সিরিজ যে মৌলিক গল্প নয়, বরং বিভিন্ন বিদেশী গল্প অবলম্বনে রচিত হয় একথা এখন প্রায় সবাই জানেন। পরবর্তীতে বিদেশী বিভিন্ন সিরিজ থেকে গল্প ধার করা হলেও রকিব হাসান 'তিন গোয়েন্দা' শুরু করেছিলেন আমেরিকান লেখক Robert Arthur, Jr. এর The Three Investigators সিরিজ অবলম্বনে। এই সিরিজ আমেরিকায় এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সিরিজ অবলম্বনে ধারাবাহিক ভাবে বই প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশে যেমন 'তিন গোয়েন্দা' তেমনই জার্মানী, পোল্যান্ড, স্পেন, ভারত, পাকিস্তানে ভিন্ন ভিন্ন নামে সিরিজটি প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রধান চরিত্রগুলোর নামেও আসে পরিবর্তন।
The Three Investigators সিরিজে প্রধান তিনটি চরিত্রের নাম ছিল -
Jupiter "Jupe" Jones - First Investigator,
Peter "Pete" Crenshaw - Second Investigator,
Robert "Bob" Andrews, Records and Research.
যারা 'তিন গোয়েন্দা' সিরিজে যথাক্রমে 'কিশোর পাশা', মুসা আমান' এবং রবিন মিলফোর্ড নামে পরিচিত হয়েছে। ভারতে সিরিজটি প্রকাশিত হয় "Bal Secret Agent 555 Ranga, Ganga & Shirazi" শিরোনামে, যেখানে প্রধান তিনটি চরিত্রের নাম ছিল যথাক্রমে - রাঙ্গা, গঙ্গা এবং সিরাজি। পাকিস্তানে সিরিজটি প্রকাশিত হয়েছিল "Teen nanhay suraghrasaan"শিরোনামে। চরিত্র তিনটির নাম ছিলযথাক্রমে - উমর, নাসিম এবং আকিব। এই সিরিজের বই যখন শেষের দিকে তখন রকিব হাসান হাত দেন ব্রিটিশ লেখিকা Enid Blyton এর জনপ্রিয় সিরিজ 'The Famous Five' থেকে রুপান্তর করার কাজে।' তিন বন্ধু' সিরিজের বইগুলো লেখা হয়েছে এই সিরিজ অবলম্বনেই। এই সিরিজের চরিত্রগুলোর বয়স অপেক্ষাকৃত কম আর পটভূমি গ্রামের হওয়ায় রকিব হাসান সিরিজটাকে তিন গোয়েন্দার ছোট বয়সের কাহিনী হিসেবে চালিয়ে দেন। আর প্রধান চরিত্র তিনটির জায়গায় পাঁচটি থাকায় ঢুকে পড়ল ফারিহা এবং টিটু, মাঝেমধ্যে জিনা আর রাফি। ঠিক এর উল্টোটা ঘটল Edward Stratemeyer এর The Hardy Boys সিরিজ অবলম্বনে (এই সিরিজ থেকে রকিব হাসান 'জাফর চৌধুরি' ছদ্মনামে রোমহর্ষক সিরিজেরও বেশ কিছু বই লিখেছেন) বই লেখার ক্ষেত্রে। কারন এই সিরিজের চরিত্রগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়। কাজেই তিন গোয়েন্দা সাইকেল ছেড়ে গাড়িতে উঠল, প্লেন চালানো শুরু করল, রবিন লাইব্রেরি ছেড়ে ঢুকল মিউজিকের ভূবনে! সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল যে, এই সিরিজের মূল চরিত্র ছিল দুটি, দুই ভাই ফ্র্যাঙ্ক এবং জো (রোমহর্ষক সিরিজের রেজা এবং সুজা)। কিন্তু তিন গোয়েন্দা সিরিজের চরিত্র তো তিনজন! কি করা যায়! রকিব হাসানের মুন্সিয়ানা এখানেই, মুসাকে তাঁর মা লাগিয়ে দিলেন বাগান পরিস্কার করার কাজে, অথবা রবিন বসে গেল সাংবাদিক বাবাকে সাহায্য করার জন্য কিংবা মেরি চাচি কিশোরকে লাগিয়ে দিলেন ইয়ার্ডের জঞ্জাল সাফ করার কাজে। মোটকথা, তিনজনকে একসাথে পাওয়া যেতে লাগল খুবই কম। রকিব হাসানের অনুবাদের মুন্সিয়ানায় তা প্রায় ধরাই গেল না, যদিও মাঝে মধ্যে আলোচনা বিভাগে চিঠি আসত এই অভিযোগ করে যে, 'অমুক বইয়ে মুসার ভূমিকা ছিল কম, তমুক বইয়ে রবিনের কিংবা তিন গোয়েন্দা বড় হয়ে গেছে! ইত্যাদি ইত্যাদি! তাঁরপরও সিরিজটায় জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়লনা এতটুকুও, কারন The Hardy Boys এর কাহিনী গুলো ছিল যথেষ্ট মানসম্মত এবং রকিব হাসান রূপান্তরে ছিলেন তারচেয়ে বেশি সাবলীল। ইতিমধ্যেই উইলার্ড প্রাইসের অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ অবলম্বনে 'জলদস্যুর দ্বীপ' কিংবা 'ভীষন্য অরন্য'র মত বেশ কিছু বই লেখা হয়ে গেছে। ওমর শরীফের সব বই নেয়া হয়েছে 'বিগলস' সিরিজ থেকে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয়ে গেল তখনই যখন এই সিরিজেরও সব বই রুপান্তর করা শেষ হয়ে গেল। আর মানসম্মত এবং সঙ্গতিপূর্ন বিদেশী সিরিজের খোঁজ পাওয়া গেলনা। তিন গোয়েন্দা সিরিজের মানেরও পতন শুরু হল। সিরিজটাকে চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে (মূলত ব্যাবসায়িক স্বার্থে, কারন তিন গোয়েন্দা সিরিজ ছিল সেবা প্রকাশনীর সবচেয়ে লাভজনক সিরিজ, এমনকি মাসুদ রানার চেয়েও) অসঙ্গতিপূর্ন বিভিন্ন সিরিজ থেকে অনূবাদ করে সিরিজটি চালানো শুরু হল (এখনও হচ্ছে), ঠিক এই পর্যায়ে তিন গোয়েন্দায় আগমন ঘটল ভূত প্রেত, দৈত্য দানব, ডাইনি-জাদুকর সহ নানান গাজাখুরি বিষয়ের। বইয়ের মান পড়ে যাওয়ায় বিক্রিও গেল পড়ে। এমনকি রকিব হাসানের লেখা শেষ কয়েকটি বইও যথেষ্ট মানসম্মত ছিলনা। এরই এক পর্যায়ে সেবা প্রকাশনীর সাথে দীর্ঘ দিনের সুসম্পর্কের অবনতি ঘটল রকিব হাসানের(সম্ভবত রয়্যালিটি সংক্রান্ত সৃষ্ট জটিলতার এবং রকিব হাসানের সেবার বাইরে থেকেও তিন গোয়েন্দা লেখার আগ্রহের কারনে), ছাড়লেন নিজের প্রতিষ্ঠা করা সিরিজ 'তিন গোয়েন্দা'। এমনকি শেষ চার কি পাঁচটা বই রকিব হাসানের নামে বের হলেও ওই বইগুলো্র লেখক ছিল অন্যরা। এরপর তিন গোয়েন্দা পরল 'Ghost Writer' দের (যারা নিজেদের নাম গোপন করে অন্যের নামে বই লেখার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন) হাতে। চুক্তিবদ্ধ লেখকরা বই লেখেন (বলা ভাল, অনুবাদ করেন) আর তা প্রকাশিত হতে লাগল শামসুদ্দিন নওয়াবের(কাজী আনোয়ার হোসেনের একটি ছদ্মনাম) নামে, এখনও এই ধারা অব্যাহত আছে। রকিব হাসানের পর সিরিজটি কেবলমাত্র একজন লেখকের নামে প্রকাশ করার জন্য এই ব্যাবস্থা নেয়া হয় (এটি নতুন কোন বিষয় নয়, পৃথিবীতে বহু সিরিজ এভাবে লেখা হত, এখনও হয়। তিন গোয়েন্দার মূল সিরিজ এবং দি হার্ডি বয়েজ দুটিরই অনেক কাহিনী গোস্ট রাইটাররা লিখেছেন) । এরপর সেবার অন্যান্য সিরিজ যেমন, রোমহর্ষক, গোয়েন্দা রাজু, নীল ও ছোটমামা (কিশোর ও হীরু চাচা), কিশোর হরর থেকেও সব বই তিন গোয়েন্দায় রুপান্তর করা হল।
এত কিছুর পরেও যখন নিম্নমানের একক বইগুলো তেমন বিক্রি হচ্ছিলনা তখন কাজী শাহনূর হোসেনের পরামর্শে তিনটি নতুন কাহিনী একসাথে করে নতুন ভলিউম প্রকাশ শুরু হল (আগের ভলিউম গুলো হত পুরানো তিনটি করে বই নিয়ে)। এভাবেই চলছে এখনও। রকিব হাসান আবার অনিয়মিত ভাবে তিন গোয়েন্দা লেখা শুরু করেছেন, কিন্তু মানসম্মত বিদেশী কাহিনির অভাবে সেই আগের মজা আর পাওয়া যাচ্ছেনা। বর্তমানে অ্যাডাপশন করা হচ্ছে 'ম্যাজিক ট্রি হাউস' এবং 'গুজবাম্পস' সিরিজ থেকে যা নিতান্তই বাচ্চাদের উপযোগী।
কিন্তু সেই পুরনো তিন গোয়েন্দা কি আর ফিরে আসবেনা! উত্তর ভবিষ্যতের হাতে। অন্যান্য সিরিজগুলো লেখকের মৃত্যু এবং নানা কারনে বন্ধ হয়ে গেছে। আর তিন গোয়েন্দার মূল যে সিরিজ Robert Arthur, Jr. এর The Three Investigators, (এটি পরবর্তীতে শুধু গোস্ট রাইটাররাই লিখতেন, তবে তা ছিল মানসম্মত) লেখকের মৃত্যুর পর সেই সিরিজ আটকে আছে লেখকের বংশধর এবং প্রকাশকদের মধ্যে সৃষ্ট আইনি জটিলতার কারনে। এই জটিলতা মিটে সিরিজটা আবার নতুন করে শুরু হবে (যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম) সেই আশা করা ছাড়া আমাদের আর তেমন কিছুই করার নেই, মাঝে মাঝে পুরনো তিন গোয়েন্দা গুলো হাতে নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগা ছাড়া!
পূনশ্চঃ আচ্ছা, জটিল কোন সমস্যার মুখোমুখি হলে কিশোর পাশা কি আগের মত এখনও নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটে? কারও জানা আছে কি!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৪