তখন পড়ি ক্লাস এইটে। গল্পের বই বিশেষ করে সেবার বই পড়ার তুমুল নেশা। তিন গোয়েন্দা, কিশোর হরর, ক্লাসিক, অনুবাদ, ওয়েস্টার্ন কিছুই বাদ যেতনা। মাসুদ রানা ধরেছি নতুন নতু। তবে তিন গোয়েন্দার প্রতি ছিল ভাললাগা ছিল সীমাহীন। যমুনা পাড়ের যে গ্রামে থাকতাম তা ছিল বেশ অগ্রসরমান জনপদ। তবে বাজারের বইয়ের দোকান গুলোয় হিমু, মিসির আলীদের পাওয়া গেলেও তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানাদের পাওয়া যেতনা। তাই প্রতি বছর বার্ষিক পরীক্ষার ছুটিতে ঢাকায় এসে একগাদা বই কিনে নিয়ে যেতাম। ঢাকায় এসে যে চাচার বাসায় উঠতাম তাঁর বাসায় ছিল অসংখ্য বই, সেগুলো গোগ্রাসে গিলতাম।
একদিন কি একটা বই কেনার জন্য বাজারের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকান 'আদর্শ লাইব্রেরি' তে গেছি। বই কিনে ফিরব এমন সময় হঠাৎ করেই দোকানের পেছন দিকটায় চোখ গেল। আমার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল! যা দেখছি, ঠিক দেখছিতো! দোকানের পেছনে দিকে গাঁদা করে রাখা প্রায় শতিনেক সেবার বই! স্বপ্ন নাকি সত্যি নিশ্চিত হবার জন্য দোকানিকে বলে বই গুলোর কাছে চলে গেলাম। তিন গোয়েন্দা, মাসুদ রানা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর হরর, অনুবাদ... কি নেই সেখানে! ও হ্যাঁ! একগাদা দস্যু বনহূরও আছে! দস্যু বনহুরের প্রতি কোন আকর্ষন নেই বলে ওদিকে ফিরে না তাকিয়ে ঝটপট ৩ টা বই বাছাই করে ফেললাম, দুইটা তিন গোয়েন্দা আর একটা কিশোর হরর। দোকানদার বইয়ের দাম (৮০ টাকার মত হয়েছিল মনে হয়) চাইতেই আমার টনক নড়ল, উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমার পকেট গড়ের মাঠ! কি আর করা, 'কাল নেব' বলেই সাইকেলটা নিয়ে ছুট লাগালাম বাড়ির উদ্দেশ্যে!
বাড়ি ফিরে একটাই চিন্তা আমার, টাকা ম্যানেজ করা যায় কিভাবে! বাড়ির পাশেই স্কুল বলে টিফিন খরচ বাবদ একটা পয়সাও পাওয়া যায়না! আমার বাবা টেক্সটবুকের জন্য হাজার টাকা দিতে রাজি থাকলেও গল্পের বইয়ের জন্য ফুটো পয়সাও দেবেন না! অতএব অনেক চিন্তা ভাবনা করে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করাই স্থির করলাম! রাতে খেয়ে দেয়ে যেই না মা টিভি দেখতে চলে গেল, আমি মায়ের ঘরের খাটের নিচে রাখা মাটির ব্যাংকটা হাপিশ করে দিলাম। মাস খানেক হল লক্ষ্য করছিলাম, বাজার করার পর সব খুচরা পয়সা মা এর মধ্যেই রাখেন। পুরো ব্যাঙ্ক উঠিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এসে ছুড়ি দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে কয়েন গুলোকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিলাম! প্রায় ঘন্টা খানেক পরিশ্রম করে সব কয়েনগুলিকে মুক্ত করার পর গুনতে শুরু করলাম। সবমিলিয়ে মাত্র ৯২ টাকা, ২৫ পয়সা হল! তাই সই! সব টাকা নেয়া ঠিক হবে না মনে করে ২৫ পয়সার কয়েনটা আবার ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে ব্যাংকটা যথাস্থানে রেখে আসলাম! পরদিন স্কুল ছুটি হতেই ছুট লাগালাম আদর্শ লাইব্রেরি বরাবর। সাথে আরেক বই পাগল বন্ধু সুমন। ওর পাশের বাড়িতে একজনের সেবার বইয়ের বিশাল কালেকশন ছিল। কিন্ত বেটা আমাদের পড়তে দিতনা। সুমন নানা ছুতোয় ওই বাড়ি গিয়ে একটা দুইটা করে বই গায়েব করে দিত। ওর বাসায় আউটবই নিষিদ্ধ থাকায় বেচারা পড়ার পর বই গুলা আমাকেই দিয়ে দিত। ওপারের ডাক, হারানো সাম্রাজ্য, সিংহের গর্জন, অভিশপ্ত হীরে, স্যান্ডার্সের রক্ত চাই... কত বইই না পেয়েছিলাম আমি ওর কাছ থেকে! বই গুলো পেয়েই আমি সার্জারী করে এমন চেহারা করে ফেলতাম যে, বইয়ের আসল মালিকও চিনতে পারতোনা! যাহোক সুমন কে সাথে নিয়ে ৪ টা বই কিনে ফেললাম (তিনটা তিন গোয়েন্দা, একটা কিশোর হরর), বাড়তি টাকাটা ওই দিল। তিনটা বই নিয়ে (আরেকটা সুমন নিয়েছিল) খুশি মনে বাড়ি ফিরলাম।সেদিন রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল, মায়ের রান্না করা খিচুরি খেয়ে (উনি তখনও টের পাননি তাঁর ব্যাংক আমি 'হলমার্ক' করে দিয়েছি!), ঘন্টা দুয়েক পাঠ্যবই পড়ার ভান করলাম। তাঁরপর তিন গোয়েন্দার সাথে 'সোনার খোঁজে' চললাম! টিনের চালে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, আর ঘরের ভেতরে আমি কাথা মুড়ি দিয়ে তিন গোয়ন্দার সাথে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছি! এই অনুভূতি বলে বা লিখে বোঝানো যায় না!
এভাবেই আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন। কিন্ত ৪ টা বইয়ে আর ক'দিন যায়। ওদিকে দোকান ভর্তি বই, মন ভর্তি ক্ষুধা আর এদিকে আমার পকেট ভর্তি বাতাস! আবার এদিকে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে গেছে, মা ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যাবস্থা জোরদার করেছেন। ওদিকে সুমনটাও সুবিধা করতে পারতেছেনা, পাশের বাড়ি থেকে তাঁর নামে কমপ্লেইন এসেছে, সে নাকি সময়ে অসময়ে গিয়ে বই ঘাটাঘাটি করে। চুরির কথা তো আর সরাসরি বলা যায়না! একদিন বিকেলে বৃষ্টির জন্য বাইরে খেলতে যেতে পারিনি, পড়ার মত নতুন কোন বইও নেই। মেজাজ ছিল খিচরে। এমন সময় আব্বা ঘরে এসে পাঞ্জাবীটা খুলে খাটের স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে রেখে ওজু করতে চলে গেলেন। পাঞ্জাবীর পকেটের কোনা দিয়ে বেরিয়ে থাকা চকচকে ২ টাকার নোটটা চোখে পরার আগ পর্যন্ত আমার মাথায় কোন দুষ্ট চিন্তা আসেনি! দেখার পরে ভাবলাম, দুই টাকাইতো, বেশিতো আর নেবনা, আর তাছাড়া বই কেনার জন্যই তো নিচ্ছি! জীবনে প্রথমবারের মত বিনানুমতিতে বাবার পকেটে হাত দিলাম! তবে নিজেকে দেয়া কথাটা রাখলাম; ২ টাকার বেশি নিলাম না! বেশি নিলে টের পেয়ে যেতে পারে যে! ব্যাংক ডাকাত থেকে হোলাম পকেটমার! তো এভাবেই শুরু হল। বাবাকে কিছু টের পেতে না দিয়ে এক মাসের মধ্যে আরও দুটি তিন গোয়েন্দা কিনে ফেললাম! কে জানে, হয়তো টের পেয়েছিলেন! তবে এ দুটোই ছিল শেষ। কেন জানি না, নিজের কাছেই খারাপ লাগছিল।
কিন্তু বইতো পড়তে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের গ্রামে ব্র্যাকের সহযোগীতায় 'গনকেন্দ্র পাঠাগার' স্থাপিত হয়েছে। যথারীতি সেখানে সেবার কোন বই নেই। তবে হুমায়ুন আহমেদ, জাফর ইকবাল,সুনীল,সমরেশরা আছেন। আমি গ্রন্থাগারিকের সাথে খাতির করে ফেললাম, সবাইকে একসাথে একটার বেশি বই না দিলেও আমাকে দেন দুইটা! এভাবেই চলছিল, এর মধ্যে একদিন সুমন এসে বলল,'চল, আদর্শ লাইব্রেরিতে যাই'। আমি বললাম,'পকেটে ফুটা পয়সা নাই, দোকানে গিয়ে কি করব!'। শালা ফিচলে হাসি দিয়ে বলল,'আরে, বই ঘাটাঘাটি করতেও তো ভাল লাগে!' 'কথা তো মিথ্যা বলে নাই!' ভাবলাম আমি। কতবার একটা বই কিনতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বই ঘাটাঘাটি করেছি!' হাটা দিলাম দুজনে। যেতে যেতে সুমন নিচু স্বরে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলল। 'আমি একা প্রথমে দোকানে যাব। দোকানের পেছনে কিছুক্ষন বই ঘাটাঘাটি করে কোন বই না কিনেই ফিরে আসব।(প্রসঙ্গত বলে নিই, সেবার বইগুলো দোকানের পেছন দিকে একটা শেলফে সাজিয়ে রাখা থাকত, প্রথম তিন তাক সেবার বই, চার নম্বর তাক দস্যু বনহূর, পাঁচ নম্বর তাক আবার সেবার দখলে। এছাড়া আরও অনেক বই নিচে অগোছালো ভাবে স্তূপ করে রাখা থাকত) তবে দোকান থেকে বের হওয়ার আগে দুইটা বই বেছে নিয়ে আমি শেলফের তিন নম্বর তাকটার কোনায় রাখব। এরপর তুই দোকানে ঢুকবি, একটু ঘাটাঘাটি করে ফিরে আসবি। আর আসার সময় বাম হাত দিয়ে বই দুইটা হাতে বাজিয়ে নিয়ে আসবি! ফুলপ্রুফ প্ল্যান! আমি নিজেই নিয়ে আসতাম, কিন্তু ওই দোকানদার ব্যাটা আমারে মনে হয় সন্দেহ করে, চোখে চোখে রাখে!' ওর ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা শুনে আমি রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়লাম।'
সেদিন যে কেন আমি রাজি হয়েছিলাম আমি নিজেও জানি না। যতই বই পড়ার নেশা থাক, বাজারের মধ্যে একটা দোকান থেকে বই চুরি করার মত ঝুকিপূর্ন কাজ আমার দ্বারা সম্ভব ছিলনা, যেখানে আমার বাবা গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষদের একজন'। যাই হোক, সুমনের ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা অনুযায়ী সে চলে গেল দোকানে আর আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম সিনেমা হলের সামনে। ১৫ মিনিট পরেই ও ফিরে এল,'কাজ শেষ, দুইটা তিন গোয়েন্দা সাইজ করে রেখে এসেছি। তুই বের হওয়ার সময় কোনদিক না তাকিয়ে বই দুইটা হাতে নিয়া হাটা দিবি! আমি স্কুলের সামনে ওয়েট করতেছি।' সুমন চলে গেল স্কুলের দিকে আর আমি চললাম দোকানের দিকে। যথারীতি দোকানে ঢুকে পেছন দিকে চলে এলাম। কিছুক্ষন এমনি এমনি কিছু বই ঘাটাঘাটি করলাম। কিন্তু আজ সবকিছু এমন লাগছে কেন! দোকানি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে কেন! দোকানির চ্যালাটাই বা একটু পরপর পেছনে আসছে কেন! ইতোমধ্যে সুমনের সাইজ করে যাওয়া বই দুইটা দেখে ফেলেছি, উপরেরটা 'মায়া নেকড়ে' নিচের টা বুঝতে পারছিনা।... অনেকক্ষন চেষ্টা করার পরেও যখন সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম না তখন ভাবলাম; জাহান্নামে যাক। আমার দ্বারা হবে না। 'নেয়ার মত কোন বই নাই।' বলে দোকান থেকে বের হলাম। মানুষ ঝুঁকিপূর্ন কাজ গুলো হঠাৎ করেই করে থাকে, কোন পূর্ব চিন্তা ছাড়াই! আমিও বের হতে হতে আরচোখে দেখলাম দোকানি আর তাঁর এসিস্টেন্ট কাস্টোমার সামলাতে ব্যাস্ত, কিভাবে ঠিক জানি না সাথে সাথে আমার বাম হাত আপনা আপনি চলে গেল শেলফে রাখা বই দুটোর দিকে! আর হাত দিয়েই আমার হৃৎপিণ্ড ধরাস করে উঠল! বই দূটো সেখানে নেই!! বুঝলাম ভূল তাকে হাত দিয়ে ফেলেছি! এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হল, ওই বই খোঁজাখুঁজি না করে চুপচাপ হাঁটা দেয়া। সেদিন আমার কি হয়েছিল জানি না, রীতিমত পাগলামি ভর করেছিল! একটা বই না নিয়ে আমি যাব না! আরচোখে দোকানিদের দেখে নিয়েই শেলফ থেকে একটা বই তুলে নিলাম, বইয়ের মলাট না দেখেই! মূহুর্তে চালান করে দিলাম শার্টের নীচে! তাঁরপর হাঁটা ধরলাম বাড়ির দিকে, কোনদিকে না তাকিয়ে! 'এই ছেলে শোন!' পেছন থেকে দোকানির ডাক শুনে আমার বুক এত জোরে ধরাস করে উঠল যে মনে হল আমি অজ্ঞান হয়ে যাব। দোকানদার আমাকে ডাকবে কেন? কোনদিন তো ডাকে নাই! দৌড় দেয়ার চিন্তা মাথায় এসেছিল কিন্তু লাভ কি, এই গ্রামের সবাই আমারে চেনে'। যা হবার হবে ভেবে ফিরলাম দোকানিরর দিকে। দোকানি মুখ কালো করে বলল,'তোমরা যে এত বই ঘাটাঘাটি কর, যাওয়ার আগে একটু গুছায়া রাইখা যাইতে পার না?'। আমি চুপ। মানুষ অধিক শোকে পাথর হয় আবার অধিক আনন্দেও পাথর হয়! 'কি হইল, কথা কও না কেন?' দোকানদার আবার জিগায়। 'পরের বার থেকে গুছিয়ে দিয়ে যাব'। চিঁচিঁ করে কোনমতে কথাটা বলেই হাঁটা ধরলাম। পকেটমার থেকে আমি হলাম ছিচকে চোর!
সোজা বাড়িতে চলে এলাম। স্কুলের দিকে যাওয়ার টাইম নাই! বাড়িতে এসে নিজের ঘরে ঢুকেই বইটা চালান করে দিলাম তোশকের নিচে! বইটার কাভারও দেখলামনা! কোন প্রয়োজন ছিলনা, চোরের মন পুলিশ পুলিশ বলেই হয়তো! রাতে খেয়েদেয়ে আয়েশ করে শুয়ে পড়লাম, তোশকের নিচে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম চুরির মাল! কিন্তু বইটা চোখের সামনে ধরা মাত্রই আমার আনন্দ উবে গেল। আহাম্মক হয়ে হাতে ধরা বইটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। 'অজানা সাগরে দস্যু বনহূর' বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে হিন্দি সিনেমার নাম না জানা কোন এক নায়িকা! এত ঝুঁকি নেয়ার এই তাহলে ফল!!! দস্যু বনহূর! মাসুদ রানা হলে না হয় একটা কথা ছিল!!! কিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে থেকে অবশেষে বনহূরই পড়া শুরু করলাম। আমার জীবনে পড়া প্রথম এবং শেষ বনহূর সিরিজের বই ছিল সেটা। খুব যে খারাপ ছিল সেটা বলবনা, কিন্ত যে মাসুদ রানা পড়েছে তাঁর কাছে বনহূর পাত্তা পাবেনা এটাই স্বাভাবিক।
তারপর কেটে গেছে অনেক দিন, তিন গোয়েন্দা পড়া ছেড়েছি অনেকদিন, মাসুদ রানাও আর আগের মত পড়া হয় না। তবে আমার মনে তিন গোয়েন্দার স্থান স্থায়ী হয়ে আছে, থাকবে চিরদিন!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ১:১১