ছবির নাম মেশিনম্যান। বেশ কয়েক বছর আগে দেখছিলাম ছবিটা, কাহিনি পুরাপুরি মনে নাই। শ্রেষ্ঠাংশে মান্না, মৌসুমি, অপু বিশ্বাস, কাজী হায়াত। আর নিকৃষ্টাংশে মিজু আহমেদ, গ্রামের দর্শকদের ভাষায় যাকে বলে 'হারামী'। রাতের বেলা আজাইরা ঘুরতেছিলাম গ্রামের বাজারে, সাথে দুই বন্ধু। গ্রামে গেলে অন্তত একটা করে নাইট শো দেখা ছিল মোটামুটি কমপালসরি। রজনীগন্ধা, সোহাগ, সাগরিকা ঘুরে এসে থামলাম জলসা সিনেমার সামনে। ছবির পোস্টার দেখে পছন্দ হল আমাদের তিনজনেরই। হলিউডের টার্মিনেটর টু’র আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের বডির উপর আমাদের ঢালিউডের মান্নার মাথা বসানো। মান্নার দুইটা চোখের মধ্যে একটা ঠিকাছে, আরেকটা চোখ যন্ত্রপাতি দিয়া বানানো। এতদিনে হলিউডি টার্মিনেটর দেখছি, ঢালিউডি টারমিনেটর দেখার সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। কাজেই তিন বন্ধু মিলে টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম হলের ভেতর।
গ্রামের দিকের সিনেমা হল গুলোর কিছু চমৎকার বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো শহরের হল গুলোয় নাই। যেমন হলের ভেতর চাইলেই বিড়ি সিগারেট ধরানো যায়, শব্দ করে আশে পাশে থুথু ফেলা যায়, যতবার খুশি বাইরে যাওয়া আসা করা যায়। চাই কি সামনের সারির খালি সিটে পা তুলে দেয়াও যায়! সবচেয়ে বড় সুবিধা হল কারও ভ্রুকুটির সৃষ্টি না করেই লুঙ্গি পড়ে হলে ঢোকা যায়। বোনাস হিসেবে পাওয়া যায় গ্রামের দর্শকদের দারুণ সব রিঅ্যাকশন, নায়ক যখন অ্যাকশনে তখন তাঁদের চিৎকার, নায়ক যখন নায়িকার সাথে প্রেম করে তখন উচ্চশব্দে শিস। অসুবিধার মধ্যে কাঠের তৈরি অপরিসর সীট, কানফাটা সাউন্ড, ভ্যাপসা গরম, বিড়ি সিগারেটের গন্ধ। বোনাস হিসেবে ছাড়পোকার কামড়। তবে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে সামনের সারির দর্শকদের মাথার জন্য স্ক্রিনটা পুরোপুরি দেখা যায় না। সবসময় মাথা কিছুটা নিচু করে থাকতে হয়। মাথা একটু উঁচু হলেই পেছন থেকে আওয়াজ আসে, ‘বাই, মাতাডা অ্যাল্লা নামান ছে।’ আমরা মাথাগুলা ‘অ্যাল্লা’ নিচে নামিয়েই বসলাম।
ছবি শুরু হল। মান্না একজন পুলিশ অফিসার। বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের সব সিনেমার নায়ক পুলিশের মতই সৎ এবং ঈমানদার পুলিশ অফিসার । দুস্টের দমন শিস্টের পালন তার জীবনের ব্রত। হাইপার একটিভ পুলিশ অফিসার মান্না যখন তখন ঝটিকা আক্রমন চালিয়ে তছনছ করে দেয় শহরের তাবত দুষ্টু লোক তথা হারামীদের দুষ্টু দুষ্টু পরিকল্পনা। মান্নার ভয়ে রাতের বেলাতেও রাস্তায় বের হতে ভয় পায় শহরের মাফিয়া ডনেরা। এরকমই একটা অভিযানে শহরের ডন হারামীকুল শিরোমনী মিজু আহমেদের গোপন আস্তানায় মজুতকৃত প্লাইউডের তৈরি প্রচুর সংখ্যক প্যাকিং বক্স এবং খালি ড্রামের বিপুল ক্ষতি সাধন করে মান্না। তারপর ‘অপারেশন সাকসেসফুল’ হওয়ার খুশিতে ফেমিলি নিয়ে কক্সবাজারের সী বীচে চলে যায়। উদ্দেশ্য সী বীচে স্ত্রী মৌসুমি এবং আন্ডাবাচ্চাদের নিয়ে পিকনিক করা, সেই সাথে ‘পারিবারিক সংগীত’ করা।
এদিকে প্রতিশোধের আগুনে ধিকিধিকি জলতে থাকা হারামীকুল শিরোমনি মিজু আহমেদ শহরের বাকি হারামীগুলোকে নিয়ে সংলাপে বসে। সফল সংলাপ শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যে কোন মূল্যে মান্নার সানডে মানডে কোলজ করে দিতে হবে। কিভাবে কি করা হবে সেটাও ঠিক করা হয়।
ওদিকে মান্না বৌ বাচ্চা নিয়ে বেলুন টেলুন ফুলিয়ে সফল ভাবে পারিবারিক সংগীত গাওয়া শেষ করে।কিন্তু পারিবারিক সংগীত শেষ হবার সাথেসাথেই নেমে আসে গজব! বীচের দুই পাশ থেকে অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে ছুটে আসে মিজু বাহিনীর গুন্ডারা। পিকনিক করবে বলে পিস্তলের বদলে এক কাদি কলা নিয়ে আসায় দুই মিনিটেই সানডে মানডে কোলজ হয়ে যায় মান্নার ফুল ফেমিলির। সবাইকে পানিতে ভাসাই দিয়ে হাসতে চলে যায় হারামীরা।
আমরা একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, ছবি শুরু হওয়ার আগেই ছবি শেষ গেল! কেম্নে কি! কিন্তু না, মান্নার সানডে কোলজ হলেও মানডে পুরাপুরি কোলজ হয় নাই। পানিতে ভাসতে ভাসতে মান্নার (প্রায়) ডেডবডি দূরের কোন বীচে গিয়ে ঠেকল। কাকতালীয় ভাবে সেদিন সেখানে একা একা নাচানাচি করতে আর গান গাইতে এসেছিল অপু বিশ্বাস। নাচগান শেষে বীচে পরে থাকা মান্নার (প্রায়) ডেডবডিটা দেখতে পায় সে। অপু নায়িকা মানুষ, কাজেই সে মান্নার বডি টেনে হিচরে গাড়িতে তুলে বাসার পথ ধরে।
অপু বিশ্বাসের বাবা কাজী হায়াত একজন বিশিস্ট বিজ্ঞানী। একজন আদর্শ বিজ্ঞানীকে যেমন দেখতে হওয়া উচিত, তিনি ঠিক তেমনই। চোখে মুনমুন/ময়ূরীর মত ‘মোটা’ কাঁচের চশমা, মাথায় লম্বা উশকোখুশকো পরচুলা, গায়ে ডাক্তারদের মত সাদা ইউনিফর্ম। বিজ্ঞানীদের এক জন এসিস্টেন্ট থাকা আবশ্যক, বিজ্ঞানী কাজী হায়াতেরও এসিস্টেন্ট আছে। বাসার কাজের বুয়াটাই কিচেনে আলু পটল কাটা, কাপর ধোয়া এবং টিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখার ফাকেফাকে বিজ্ঞানীকে নানা বিষয়ে এসিস্ট করে। তো এহেন বিজ্ঞানী বাবার কাছে মান্নার প্রায় ডেডবডি নিয়ে আসার সাথে সাথে ডাক্তার সাহেব... মানে বিজ্ঞানী সাহেব দ্রুত মূমুর্ষ মান্নাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একটা স্ক্যানার(!) দিয়ে পেশেন্টের পুরো শরীর স্ক্যান করার পর জানান,
‘বাঁচার কুনোই আশা নাই রে মা! হাড্ডি গুড্ডি সব গুরাগুরা হয়া গেছে।’
এই কথা শুনে অপু বিশ্বাস চিৎকার করে উঠে,
'এ হতে পারে না বাবা! তুমি না অ্যাত্তো বড় ডাক্তার... মানে বিজ্ঞানী! তুমি কিছু কত্তে পারনা! গুড়া হাড্ডি জুড়া দিতে পার না!'
অপুর চোখের গ্লিসারিন ততক্ষনে তার কাজ করা শুরু করে দিয়েছে। কন্যার চোখে জল দেখে পিতার মাথার কল কাজ করা শুরু করে। কাকতালীয়ভাবে বিজ্ঞানী কাজী হায়াত তখন ‘ঘরে বসে রোবট বানান’ প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছিলেন। তখন তিনি এই এলেম মান্নার উপর খাটানোর প্ল্যান করেন। দিনরাত অবৈজ্ঞানিক পরিশ্রম করে মান্নার দেহের বিভিন্ন পার্টস রিপ্লেস করা শুরু করেন কাজী হায়াত। এই কাজে তাঁকে সার্বক্ষিনক সহায়তা করে এসিস্টেন্ট কাজের বুয়া। কাজী হায়াত গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে ‘ব্লেড’, বুয়া চকচকে একটা লোহা কাটা কড়াত এগিয়ে দেয়, কাজী হায়াত সেই কড়াত হাতে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে করাত করাত শব্দ করে হাড্ডি গুড্ডি কাটতে থাকেন। তারপর গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেন ‘হাত’, বুয়া সাথে সাথে দৌড় দিয়ে ফ্রিজ খুলে একটা যান্ত্রিক হাত বের করে নিয়ে এসে সার্জন... মানে বিজ্ঞানী কাজী হায়াতের হাতে তুলে দেয়। কাজী হায়াত সেটা জায়গা মত সেট করে দেন। এভাবেই পার্টস বাই পার্টস মান্নার শরীরে পার্টস গুলা রিপ্লেস করে দেয়। সবার শেষে একটা চোখ পাল্টে একটা মরিচ বাতি লাগিয়ে দিতেই কাজ কমপ্লিট হয়ে যায়।
কিছুক্ষন পর মান্নার মরিচ বাতি... মানে যান্ত্রিক চোখ টিমটিম করে জ্বলে উঠতেই উল্লাসে চিৎকার করে উঠেন বিজ্ঞানী সাহেব।
‘আমি সাকসেস হয়েছি! আমি সাকসেস হয়েছি মা!’ অপু বিশ্বাস ছুটে এসে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে দায়িত্ব পালন করে। কাজী হায়াত তখন কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলেন, ‘আমি এর নাম দিলাম, ‘মেশিন ম্যান!’ সাথে সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে তুমুল শব্দে বেজে উঠল,
‘মেশিনম্যান! মেশিনম্যান!! মেশিনম্যান!!’
হিউম্যান থেকে মেশিনম্যানে রূপান্তরিত হওয়ার ফলে মান্নার শক্তিমত্তা অনেক বেড়ে গেছে বলে জানালেন বিজ্ঞানী।
কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়ে মেশিনম্যান মান্না বলে উঠল, ‘আমি কে? আমি কোথায়? তোমরা কারা?’
অডিয়েন্স নড়েচড়ে বসল, আমরা আরেক দফা বিড়ি ধরালাম। কাহিনিতে ট্যুয়িস্ট চলে এসেছে!
অপু আর তার বাপ বুঝতে পারল কেস খারাপ। সামথিং ইজ ভেরি রং! মেশিনমেনের হার্ডডিস্ক ক্র্যাশ করছে। তবে কপাল ভাল, র্যা মটা কাজ করতেছে ঠিকঠাক। তখন সাইকিয়াট্রিস্ট...মানে ডাক্তার... মানে বিজ্ঞানী কাজী হায়াত বয়ান করলেন ‘দুটো দিন বিশ্রাম নিলে আর দুধ কলা খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই কিচ্ছু ভাবিস না মা।’
দিন যায়, মান্না শুয়ে বসে দুধ কলা খায়। কিন্তু মেশিনম্যানের স্মৃতি আর ফেরেনা। এমনকি মেশিনম্যান হিসেবে তার যে দায়িত্ব পালন করা উচিত সেটাও সে করেনা। মেশিনম্যানকে নিয়ে অপু বিশ্বাস বেড়াতে বের হলে বদমাইশ পুলাপানেরা অপুরে নানা রকম টিজ করে কিন্তু মেশিনম্যান কিছু না করে বেকুবের মত দাঁড়ায়া থাকে। এদিকে আবার সবল মেশিনমেনের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছে অপু। অচলাবস্থা নিরসনে ছবির পরিচালক তার বুদ্ধির ঢেকি থেকে কিছু ঢেকিছাটা বুদ্ধি ধার দেন অপু বিশ্বাসকে। সেই অনুযায়ী অপু মেশিনম্যানকে সেই বীচে নিয়ে যায় যেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছিল। তারপর গান গাইতে শুরু করে। গান শুনতে শুনতে এবং হাঁটতে হাটতে মেশিনম্যান সেই জায়গাটায় চলে আসে যেখানে তার ফেমিলিকে সানডে মানডে কোলজ করে দেয়া হয়েছিল। অপুর গান শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হার্ডডিস্কের ইরেজ হওয়া ডাটা রিকভারি হয় মেশিনম্যানের। চিৎকার দিয়ে ওঠে সে, ‘মিজু আহাম্মেদ! (ছবির নামটা ভুলে গেছি)।’ হাসি ফোটে অপুর মুখে, বাবার মত সেও ‘সাকসেস’ হয়েছে!
এরপর আর কাহিনি তেমন নাই, স্মৃতিশক্তি ফেরত আসার পর ধুমাধুম মারপিট করে মিজু আহমেদ এন্ড গং এর র সানডে মানডে ট্যুইসডে কোলজ করে দেয় সে।
তারপর অপু বিশ্বাস বলে ‘আমি তুমাকে ভালোবাসি।’
মান্না বলে, ‘কেন্তু আমি তো মেশিন ম্যান। কেম্নে কি!’
জবাবে অপু বলে ‘আমি মেশিনের আড়ালে থাকা হৃদয়টাকেই বালুবেসে ফেলেছি।’
মান্না বলে ‘উকে!’
ফিরে আসে সেই পারিবারিক সঙ্গীত আবার,
সাথে সাথেই বেজে উঠে ছবি শেষ হওয়ার কর্কশ সাইরেন
ফুরায় হলমালিকের সাথে আমাদের সকল লেনদেন।
আমাদের তিনঘণ্টা টর্চার করেছে ঢালিউডের মেশিন মেন।
[বিশেষ দ্রস্টব্যঃ মেলা বছর আগের দেখা ছবি। কাহিনি বিন্যাস পুরাপুরি ঠিক নাও হতে পারে।]