somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ভাষা : হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কিস্তি ১

২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ ভোর ৫:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলা ভাষায় লিখিতে গেলে প্রথমত রচনাপ্রণালী লইয়া বড়োই গোল বাধে। একদল, জনমেজয় যেমন সর্প দেখিলেই আহুতি দিতেন, সেইরুপ পারসি কথা দেখিলেই তাহকে তারা আহুতি দেন। আর- একদল আছেন, তাহাঁরা সংস্কৃত কথার প্রতি সেইরুপ সদয়। কেহ ভাষার মধ্যে সংস্কৃত ভিন্ন অন্য ভাষার কথা দেখিলেই চটিয়া উঠেন, প্রবন্ধের মধ্যে হাজার ভালো জিনিস থাকুক, আর পড়েন না। আবার কেহ আছেন যেই দেখিলেন, দুই-পাচঁটি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার হইয়াছে, অমনি সে গ্রন্থ অপাঠ্য বলিয়া দূরে নিক্ষেপ করেন। এখন আমরা গরিব, দাড়াঁই কোথা? আমরা ইংরেজি পড়ি আমাদের অর্ধেক ভাবনা ইংরেজিতে। আমরা কলম ধরিলেই ইংরেজি কথায় ইংরেজি ভাব আইসে। সংস্কৃত আমরা যা পড়ি, তাতে সে ভাব ব্যক্ত হয় না। বাংলার বিদ্যা বিদ্যাসাগরের 'সীতার বনবাস', আর বঙ্কিমবাবুর নবেল কয়খানি। তাতেও তো কুলায় না। নতূন কথা গড়ি এমন ক্ষমতাও নাই। তবে আমাদের কী হইবে। হয় কলম ছাড়িতে হয়, না-হয় যেরূপে পারি মনের ভাব ব্যক্ত করিয়া দিতে হয়। নিজের কথায় নিজের ভাব আমি ব্যক্ত করিব, তাহাতে অন্যের কথা কহার স্বত্ব কতদূর আছে জানি না। কিন্তু পূর্বোক্ত দুই দলের লোক দুই দিক হইতে কুঠার লইয়া তাড়া করেন। সুতরাং এক এক সময়ে বোধ হয় "...তত্র মৌনং হি শোভতে", কিন্তু আবার যখন অঙ্গুলিকন্ডূয়ন উপস্থিত হয়, তখন না লিখিয়াও থাকিতে পারি না। বিশেষ এই যে, যখন কর্তব্যবোধে কোনো কার্যে প্রবৃত্ত হওয়া যায়, তখন পাচঁ জনের কথায় তাহা হইতে নিরস্ত হওয়া নিতান্ত কাপুরুষের কাজ। যেকোনো ভাষাই হউক, যেকোনো রচনাপ্রণালীতেই হউক, যদি দুটা ভালো কথা বলতে পারি, পাচঁ জনের ভয়ে চুপ করিয়া থাকিব কেন?

তবে ভালো কথা বলিতে যদি মন্দ কথা বলি, তাহা হইলে পাচঁ জনের গালাগালি দিবার বাস্তবিক অধিকার আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পূর্বোক্ত দুই শ্রেনীর সমালোচকগণ কথাটা ভালো-কি-মন্দ সেদিকে লক্ষ্যও করেন না। নাই করুন, কথাটা ভালো করিয়া বলা হইয়াছে কিনা, তাহাও দেখেন না। দেখেন কেবল লেখার মধ্যে বড়ো বড়ো সংস্কৃত কথা আছে কি পারসি ও ইংরেজি শব্দ আছে। মারামারি করেন কেবল তাহাই লইয়া। সুতরাং আমার মতো ক্ষুদ্র লেখকবর্গের সেই বিষয়ে দৃষ্টি রাখিয়া চলিতে হয়। তাহাতেও গোলযোগ। দুই দল দুই দিক ধরিয়া টানাটানি করিতেছেন, তখন উভয় দলের মন রক্ষা করা অসম্ভব। অখচ যে দলের মনরক্ষা না হইবে, তিনিই কুঠার উত্তোলন করিয়া লেখকের প্রতি ধাবমান হইবেন। এ অবস্থায় লেখক বেচারা বিষম সমস্যায় পড়িয়া যায়।

এ সমস্যার কি পূরণ হয় না? এ সংকট হইতে কি পরিত্রানের উপায় নাই? বঙ্গীয় লেখককুল কি এই প্রতিকূল বাত্যায় ভগ্নপোত হইয়া অপার সমুদ্রে ভাসিবেন? তাহাঁরা কি কূলে উঠিতে পারিবেন না? সমালোচকদিগের এই বিষম রোগের কি উপশম হইবে না? উপশম নাই হউক, ইংরেজিতে বলে রোগের নির্ণয় অর্ধেক উপশম। এ রোগের কারণ নির্ণয়ের কি কিছুই চেষ্টাও হইবে না।

অনেকগুলি সুচিকিৎসকের সহিত বিশেষ পরামর্শ করিয়া আমরা ইহার কতক কারণ ঠিক করিয়াছি। ঠিক করিয়াছি বলিতে পারি না। কতক অনুভব করিয়াছি। যাহা বুদ্ধিস্থ হইয়াছে, তাহা মুক্তকন্ঠে বলিব। এস্থলে কুঠারের ভয় করিলে চলিবে না। যদি আর-কেহ অন্য হেতু- প্রদর্শন করিতে পারেন, নিরতিশয় আনন্দ সহকারে শ্রবণ করিব।

কথাটি এই যে, যাহাঁরা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারন করিয়াছেন, তাহাঁরা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই। হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন। কতকগুলো অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নতূন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন। নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কি আছে না আছে তাহাতে তাহাঁদের নজরও পড়ে নাই।

এখন তাহাঁদের বই পড়িয়া যাহাঁরা বাংলা শিখিয়াছেন, তাহাদের যথার্থ মাতৃভাষায় জ্ঞান সুদূরপরাহত হইয়াছে। অথচ ইহাঁরাই যখন লেখনী ধারণ করেন, তখন মনে করেন যে, আমার বাংলা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট। তাহাঁর বাংলা তিনি ও তাহাঁর পারিষদবর্গ বুঝিল, আর কেহ বুঝিল না। কেমন করিয়া বুঝিবে! সে তো দেশীয় ভাষা নহে। সে অনুবাদদিগের কপোলকল্পিত ভাষার উচ্ছিষ্ট মাত্র। দেশের অধিকাংশ লোকই উচ্ছিষ্ট ভোজনে জাতিপাতের ভয় করে অথচ লেখকমহাশয়েরা তাহাদিগতক কুসংস্কারাপন্ন মূর্খ বলিয়া উপহাস করেন। এই গেল এক দলের কথা।

আবার যখন অনুবাদদিগের এইরূপ দীর্ঘছন্দ সংস্কৃতের "নিবিড় ঘনঘটাচ্ছন্দের" নদ, নদী, পর্বত, কন্দরের অসম্ভব বাড়াবাড়ি হইয়া উঠিল, যখন সংস্কৃত, ইংরেজি পড়া অপেক্ষা বাংলা পড়ায় অভিধানের অধিক প্রয়োজন হইয়া পড়িল, তখন কতকগুলি লোক চটিয়া বলিলেন, এ বাংলা নয়। বলিয়া তাহাঁরা যত চলিত কথা পাইলেন, তাহাই লইয়া লিখিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাঁদের সংখ্যা অল্প, কিন্তু ইহাঁরা সংস্কৃতের সং পর্যন্ত শুনিলে চটিয়া উঠেন। এমন-কি ইহাঁরা সংস্কৃতমূলক শব্দ ব্যবহার করিতে রাজি নন। অপভ্রংশ শব্দ, ইংরেজি শব্দ, পারসি শব্দ ও দেশীয় শব্দের দ্বারা লিখিতে পারিলে সংস্কৃত শব্দ প্রাণান্তেও ব্যবহার করেন না। এই গেল আর-এক দলের কথা। সুতরাং এই উভয় দল যে পরস্পরবিরোধী হইবেন, এবং বঙ্গীয় লেখকগণকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিবেন, আপত্তি কী?

আমরা যে পূর্বে লিখিয়াছি বাংলাভাষায় যাহাঁরা এ পর্যন্ত লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাহাঁরা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই, ইহা অতি সত্য কথা। আমরা ইতিহাস দ্বারা এইটি সমর্থন করিব।

(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে অক্টোবর, ২০০৯ ভোর ৫:৪৫
৭টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×