২০১২ । বছরের শুরু থেকেই একটার পর একটা সমস্যা যুক্ত হচ্ছে। বড় সমস্যা গুলোর মধ্যে চাকুরী একটি। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে দুই বছর মেয়াদী একটি জবে যোগদান করি। ২০১১ সালের ডিসেম্বর ছিল তার মেয়াদ শেষের তারিখ। যথাসময়ে মেয়াদ শেষ হলো। প্রতিষ্ঠান কাজ বুঝে নিতে প্রায় দু’মাস সময় লাগবে। তাই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাকে থাকতে হবে। অথচ তখনো তেমন কোনো পছন্দের চাকরীরর সন্ধান পাইনি। যদিও অনেক অফার হাতে ছিল। কিন্তু একটিও মনের মতো হচ্ছে না। এদিকে ‘পারিবারিক ব্যায়’তো আর সে খবর রাখে না। রাখবার কথাও নয়। শুধু ব্যায়ের তালিকা বড় করাই ছিল তার কাজ। মাথা কোনো কিছুতেই কাজ করছে না। পারিবারিক ব্যায় -এর সঙ্গে পাল্লাদিয়ে বাড়ছে মেডিক্যাল ব্যায়ও। কখনো মা, কখনো বাবা কিংবা অন্য কেউ অসুস্থ হচ্ছে। আবার ছোট বোনের পড়ালেখার খরচ। যদিও চাকরীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও আমার কিছু পার্টটাইম জব ছিল। তবুও এতো খরচের সমুদ্রে তা ছিল ক্ষুদ্র জলকণা। আমি নিজেকে ভিষণ অসহায় ভাবতে থাকি। শত সমস্যার মাঝে পরিবারকে তা বুঝতে দেইনি। বুঝতে দেইনি এই জন্যে যে, এগুলো জানলে বাবা আর তার ঔষধের কথা বলবেন না। নেহায়েত প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বাজার করার কথা কেউ বলবে না। তাই নিজেকে খুব সন্তর্পনে গোপন রেখেছি। তবে দুর্বল হইনি এই জন্যে যে আমার হাতে যথেষ্ট কাজের অফার ছিল। শুধু এদের মধ্য থেকে সঠিক স্থান বাছাই করাই ছিল সমস্যা।
এভাবে কেটে গেল দু’ মাস। তারপর অনেক ভেবে দৈনিক সকালের খবরের সিনিয়র সাব এডিটর সন্দিপন বসু মুন্নার রেফারেন্সে পাওয়া চাকুরিটাকেই সঠিক মনে হলো। আমি কনফার্ম করলাম। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে মার্চের এক তারিখ থেকে যোগদান করব। সেলারিও আশাতীত ভালো। মনে অনেক আনন্দবোধ হচ্ছে। আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আর পরিকল্পণা করি নতুন অফিসে কিভাবে নিজেকে যোগ্য করব, কিভাবে নিজের জায়গা তৈরী করব, কিভাবে নতুনদের সঙ্গে পরিচিত হবো।
২৯ ফেব্রুয়ারি। আমার পূর্বের অফিস থেকে বিদায় নেই। এর আগে কোনো স্থান থেকে আমি চাকরী ছেড়ে নতুন অফিসে আসতে আমার এতো খারাপ লাগেনি। আমাদের প্রজেক্ট ছিল একটি মাসিক ম্যাগাজিন। আমি সেখানে সিনিয়র ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সে হিসেবে অফিসের সম্পাদক থেকে শুরু করে পিয়ন পর্যন্ত সকলের সঙ্গে গড়ে ওঠে এক অসাধারণ সম্পর্ক। আর তাই ছেড়ে আসার দিনটি আমার জীবনের কষ্টের দিনগুলোর মধ্যে একটি। আমি এখনো মিস করছি সিফ্রাত ভাই, আবুল ভাই, মিনহাজ ভাই, আতাউর ভাই। মিস করছি আমার খুব কাছে থেকে সবসয় পরামর্শ দিয়েছে এমন একজন মানুষ রফিক ভাইকে। আর মিস করছি পিয়াসকে। ওর সাথে শুধু আমার ঝগড়া লাগত। অনেক আনন্দময় মুহুর্তে কিভাবে যে কেটে গেলো দুটি বছর । বুঝতেই পারিনি।
১ মার্চ ২০১২। যথাসময়ে আমি আমার নতুন অফিসে এসে যোগদান করি। প্রথম দিনের কাজ। প্রচন্ড কাজের চাপ। প্রথম দিনই অফিস থেকে বের হতে হতে রাত প্রায় নয়’টা বেজে যায়। তারপর দ্বিতীয় দিন। একই অবস্থা ছিল। এভাবে তৃতীয় দিন। আমি বুঝতে পারি এ অফিসে কাজ করা আমার পক্ষে আমর পক্ষে সম্ভব নয়। তার প্রথম এবং প্রধান কারণ ছিল এখানে সারা দিন আমি ভিষন একা । এদের বেশির ভাগ কাজই হয় অনলাইনে। যে জন্য অফিসে লোক যাতায়ত ছিল একে বারে কম। পুরো দিনে হয়তো দু’একজন। দীর্ঘ দিন কোলাহলপূর্ণ স্থানে কাজ করে এখানে হঠাৎ একা হয়ে যাওয়ায় আমি ডিফ্রেশনে ভুগতে শুরু করি। কোনো ভাবেই এই অফিসকে নিজের মনে করতে পারছিনা। পারছিনা কোনো কাজ মন দিয়ে করতে। সারা দিন একা একা কাজ করতে করতে আমার অসহ্য হয়ে উঠল। রাতে ঠিক মতো ঘুম হচ্ছে না। কিভাবে কি করবো। এই হ-য-ব-র-ল মুহূর্তে ঘটলো আরেক দুর্ঘটনা। বাবা বাড়িতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করছেন। খুব গুরুতর না হলেও একেবারে কম ব্যাথ পান নি। ঠিক একই সময়ে আবার মার বড় মামা মারা যান। নতুন অফিসের টেনশন, বাবার টেনশন। আমার পাগল হয়ে যাবার অবস্থা।
এরই মধ্যে একদিন গেলাম আমার আরেক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ফরিদুল হাসান -এর কাছে। যাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার প্রতিটি সমস্যায় তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। বর্তমানে তিনি এমএলএম বার্তা ও তারকা কণ্ঠ নামে দু’টি পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তাঁকে আমার সব সমস্যা খুলে বললাম। তিনি আমাকে আস্বস্থ করলেন। পরামর্শ দিলেন আমার সমস্যা গুলো নিয়ে আমার নতুন অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রাতে অনেক পরিকল্পণা করলাম। কিভাবে কি বলব। কারণ মাত্র ছয় দিন হলো চাকরিতে যোগদান করলাম। এরই মাঝে ছেড়ে দিবো! ব্যাপারটি নিজের কাছেই কেমন মনে হলো। ভাবনা তৈরী হলো বসকে বলার পর বস কি বলবেন। অনেক পরিকল্পণার পর ৬ মার্চ আমি আমার সমস্যা নিয়ে বসের সঙ্গে বসি। তিনি আমাকে বলেন যেহেতু অফিসের সঙ্গে তুমি অ্যাডজাস্ট হতে পারছো না। তাহলে আমার কি করার আছে। এটা তোমার ব্যাক্তিগত সমস্যা। তুমি একজন ভালো লোক ঠিক করে দিয়ে চলে যেতে পারো। আমি ভাবতেই পরিনি এতো সহজেই এর সমাধান হবে! আমি ঐ দিনই আমার পরিচিত একজন ভালো ডিজাইনারকে স্যারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেই। কথা-বার্তা ও পাকা হয়ে যায় । আমি একটি দীর্ঘ নিঃস্বাস ছাড়ি। মাথাটা অনেক পাতলা মনে হয়। চাকুরী পেয়ে হয়তো এতো আনন্দিত হইনি যা আজ চাকরি ছেড়ে পাচ্ছি। ৩০ মার্চ এখান থেকে চলে যাবো। নতুন করে সমস্য তৈরী করে ‘আরো প্রায় এক মাস আমাকে থাকতে হবে এখানে! একা একা!
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১২ বিকাল ৪:৩২