একযুগ পার করলো বাংলার এমএলএম ব্যবসা। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে যখন এটি মহিরুহ আকার ধারণ করেছে। তার সুশীতল ছায়ায় যখন দলে দলে বেকার জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনীতিতে একটি সত্যিকারের ভীত যখন রচিত হচ্ছে তখনই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে একটি মহল এর পেছনে উঠে পড়ে লেগেছে। কিছু কিছু মিডিয়ার অপপ্রচার আর কিছু অসাধু এমএলএম নামধারী প্রতিষ্ঠানের মুনাফালোভী ব্যবসার ফাঁদে এমএলএম এর আজ ক্রান্তিকাল। লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ হতাশায় ভুগছে। দিনাতিপাত করছে যন্ত্রণাদায়ক অস্থিরতার মধ্যে। বেকারত্বকে আর অভাব-অনটনকে জয় করে যে স্বপ্ন নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে, হঠাৎ এক অআহুত কালবৈশাখী ঝড়ে কি তা ভেঙ্গে যাবে? হৃদয়ের গহীনে তিল তিল করে জমানো সুন্দর এই স্বপ্নগুলো কেন আজ হতাশায় ছটফট করবে? একি শুধু এমএলএম করার জন্য? আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞানসম্মত এই ব্যবসা পদ্ধতি যদি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লক্ষ যুবকের বেকারত্বকে জয় করে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এনে দিতে পারে তাহলে আমাদের দেশে কেন তা হবে না। এ প্রশ্নের জবাব কি সংশ্লিষ্ট মহল ভেবে দেখেছে?
প্রায় শ’খানেক এমএলএম কোম্পানি কাজ করছে আমাদের এই ছোট্ট ভূ-খ-ে। এদের মধ্যে যারা এমএলএম এর সঠিক প্রয়োগ ঘটিয়ে কাজ করছে তারাতো করছেই। আর যারা নামধারী এমএলএম কোম্পানি তারাও সরকারের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে ব্যবসা করে যাচ্ছে। সরকারী আমলা, মন্ত্রী, এমপিসহ উর্দ্ধতন সরকারী কর্মকর্তাÑ কে যাচ্ছে না এসব কোম্পানির কোনো সেলিব্রেশন কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে? যদি তারা বুঝে শুনে গিয়ে থাকেন তা হলে সাধারণ মানুষ তাদের দেখে ঐ কোম্পানির সাথে এমএলএম বিজনেস করলে দোষ কোথায়? আর যদি তারা শুধু দাওয়াতের জন্য গিয়ে থাকেন তাহলে এটা তাদের নৈতিকা বর্জিত কাজ এবং আজকে এমএলএম নিয়ে এই টানা-ফোঁড়নের দিনে সরকার শুধু এমএলএম কোম্পানিগুলোকে দোষ না দিয়ে তথা কথিত প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির পদ অলংকৃতদের ব্যপারেও চিন্তা করা উচিত।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে খুব সহজে নিষ্কৃতি পাইনি আমরা, ব্রিটিশ থেকে শুরু করে পাকিস্থানি শাসন। এর পর স্বাধীনতার যুদ্ধ। আমাদের কাছে স্বাধীনতা মানে অত্যাচারীর হাত থেকে রা পাওয়া, জুলুমবাজদের হাত থেকে বেঁচে থাকা। অথচ আমাদের জীবনের নিরাপত্তা, অর্থের নিরাপত্তা আজও অর্জিত হয়নি। সম্প্রতি কিছু মিডিয়ায় ও সরকারের তরফ থেকে শোনা যাচ্ছেÑ এই স্বাধীন ভূখন্ডে এমএলএম কোম্পানিগুলো ওঁৎপেতে থাকে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে পান করার জন্য। বারবার এসব রক্তচোষার হাতে নিজেদের সর্বস্ব হারিয়েছে সাধারণ মানুষ, তবুও আশায় বুক বেঁধে নামেন কিন্তু আবারও প্রতারিত হয় মানুষ। যদি এই হয় এমএলএম কোম্পানিগুলোর অবস্থা তাহলে এক যুগ পরে কেন তার ব্যপারে খতিয়ে দেখার প্রশ্ন আসবে। এক হাজার দু’হাজার নয় লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের একমাত্র উপলক্ষ যখন এমএলএম তখন তার বিরুদ্ধে এতো অভিযোগ কেন? অঙ্কুরেই কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না? সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যাদের ব্যাপারে রয়েছে তারা কেন সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করবে। কেন শুরুতেই তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে তথ্য প্রমানের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই বের হবে আসল সত্য। আর তা হলো প্রতিহিংসাপরায়ণতা।
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানেন কিন্তু প্রকৃতপে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কি ও কিভাবে এটি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় সফল ভূমিকা রাখে তা অনেকেরই জানা নেই। স্বয়ং আমাদের অর্থমন্ত্রীও তার বক্তব্যে প্রকাশ করেছেন এমএলএম এর ব্যাপারে তিনি অবগত নন।
সেই শুরু (১৯৯৮-৯৯) থেকে অদ্যাবধি শত শত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির জন্ম হয়েছে এবং এসবের বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে; কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই সঠিক এমএলএম শর্ত পূরণ করে না। অবৈধ অর্থ আয়ের কৌশল হিসেবে এমএলএম পদ্ধতিকে বেছে নিয়েছে অনেকে আবার কেউবা ব্যবসার মূলধন সংগ্রহের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে মাল্টিলেভেল বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং পদ্ধতি। প্রকৃতপে কোনটিই সম্ভব নয়, যদি সঠিক আইন ও আইনের প্রয়োগ থাকে। এখানেই সমস্যা আমাদের, আমরা সর্বনাশ হওয়ার পর সমাধানের পথ খুঁজে বেড়াই। নদীতে লঞ্চ ডুবার পরে আমাদের দেশে তদন্ত কমিটি ঘটিত হয়। তাতে কি ডুবে মরা এতগুলো মানুষের প্রাণ আমরা ফিরে পাই? তবুও তদন্ত কমিটি একটি রিপোর্ট তৈরী করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডুবে যাওয়া লঞ্চটির কোনো রুট পার্মিট ছিলো না নয়তো চালকের লইসেন্স নেই। যদি আগে থেকে এই সমস্যাটি দুর করা যেতো তা হলে হয়তো এতোগুলো মানুষকে অকালে প্রাণ হারাতে হতো না।
পণ্যনির্ভর অনেক মাল্টিলেভেল মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানই এখন প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করছে। মাল্টিলেভেল নামধারী প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত বিজ্ঞান সম্মত এই বিজনেস কনসেপ্টটি আজ হুমকির সম্মুখীন। দেশে সুষ্ঠু এমএলএম বা ডিরেক্ট সেলস আইন প্রণয়ণ অতীব জরুরি হলেও কেন তা হচ্ছে না, এ ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকে এগিয়ে আসতে হবে। এ মুহূর্তে আমাদের প্রাণের দাবি ডিরেক্ট সেলস্ আইন প্রণয়ণ ও মাল্টিলেভেল মার্কেটিংকে রা করা। তবে সত্য উন্মোচন হতে শুরু করেছে। এমএলএম এর এই ক্রান্তিকালে প্রতারক এমএলএম কোম্পানিগুলো বন্ধ হবে। যারা সঠিকভাবে বিজনেস করছে তারাও তাদের খুটিনাটি ভুলগুলো শুধরে নেবে। আজকের এই অবস্থা থেকে শিক্ষা নেবে। আমরা সেই শুদ্ধতার অপেক্ষায়। যখন এমএলএম শুধুমাত্র একটি বিজনেস কনসেপ্টই নয়, হবে একটি শিল্প। আমরা আমাদের নৈতিকতা দিয়ে বিশ্লেষণ করবো এবং সত্যের সঙ্গে থাকবো।।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১:২২