এই উপন্যাস শুরু থেকে যারা পড়েননি তারা মজা পাবেন না। বেশিরভাগের ভালো না লাগলে আর সামনে এগুবো না। চাকুরিজীবীদের জীবন নিয়ে একটা উপন্যাস লেখার অপচেষ্টা এটা।
পর্ব-৪.খ
সাইফুল যে বাসে চড়ে যাচ্ছে, সেটার নাম আনন্দ। বাসে চড়ে আনন্দ লাগছে কি না সাইফুলের অতটা খেয়াল আসছে না। তবে ওর সামনের সিটে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে যাচ্ছে। ওদের কথাগুলো ও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে দুজনই ইন্শুরেন্সে চাকরি করে।
ছেলেটা বলছে, 'ভালোই আছি আমরা। বোন চাকরি করে গার্মেন্টসে। ওর বেতন ছয় হাজার টাকা। আমি পাই আট হাজার। এরপর বীমা করাতে পারলে কমিশন তো আছেই। আপনি লেখাপড়া কতদূর করেছেন?
'ইন্টার।'
'তাহলে কোনোভাবে কষ্ট করে বিবিএতে ভর্তি হয়ে যান। আমি এর আগে যে মেসে ছিলাম, সেখানের অনেকেই এমবিএ করে এখন ভালো ভালো পোস্টে চলে গেছে। এমবিএ শুনলেই তাদের জন্য একটা পোস্ট যেন তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু আপনি যত ভালো কাজই করেন, আপনার কোনো মূল্যায়ন নেই।'
সাইফুল মনে মনে হাসলো। প্রত্যেকে যার নিজস্ব গণ্ডীতে চিন্তা করে। এই ছেলে মনে করে কাজই আসল কথা। বড় পোস্টগুলো কাজ করার জন্য না। ওগুলো তো কাজ করিয়ে নেয়ার জন্য। কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগছে যে-ব্যাপারটা তা হলো ছেলেটার সন্তুষ্টি। সাইফুল ছেলেটার চেয়ে অনেক অনেক টাকা বেশি বেতন পেয়েও 'ভালো আছি' বলতে পারে না। মানুষের জীবনে শান্তি আসার সবচেয়ে বড় উপায় কি সন্তুষ্টি? কলেজে পড়ার সময় ওদের প্রিন্সিপাল একদিন বলেছিলেন, তিনি কোনো কাজে সদরঘাট গেছেন। সেখানে পরিচিত এক লোক ঠেলা চালায়। তার সাথে দেখা হওয়ার পর সে চা খাওয়াবেই। ঠেলা চালানো শেষ; সারাদিনের কামাই দেড়শো টাকা হাতে। প্রিন্সিপালকে চা খাওয়ানোতে সে যে কী খুশি! প্রিন্সিপাল স্যার বলেছিলেন, অথচ আমার পকেটে কিন্তু কয়েক হাজার টাকা। আমি ঐ লোকটার মতো মোটেও খুশিতে ছিলাম না।
সাইফুলের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
'কই যাইতাছেন স্যারে?'
পাশের সিটের ভদ্রলোক সাইফুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। এক লবণ কারখানার ম্যানেজার। হাসি টেনে তাকে জবাব দিতে হলো, 'একটু হেড ওফিশে যাচ্ছি। আপনি?'
'আমগো স্যার একটা জীবন? সকালে কক্সবাজার, রাইতে কারখানায়, মাঝখান দিয়া বিল আনতে ব্যাংকে, ফ্যাক্টরির ঝামেলা তো মাথার মধ্যে থাকেই।'
'তার মানে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে?'
'হ, এই সিজনডায় চলবো ভালাই। আবার শাওন মাস আইলে ইট্টু ঝিম মারতে ওইবো। আপনেগো তো আর সিজন নাই। সব সিজনেই ইনকাম সমান।'
'খরচও সমান। আপনার মালিককে এত বললাম ব্যাংক থেকে ইনভেস্টমেন্ট নেন, ব্যবসা বড় করেন! উনি পারলে আমাকে এখন এড়িয়ে চলেন।'
ম্যানেজার মুচকি হেসে ডান হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে বাম হাতের ওপরটা চুলকে নিলো। লবণ কারখানার লোকদের চুলকানি হওয়ার কথা না। হয়তো মশা কামড় দিয়েছিলো। লোকটা বললো, 'আপনে স্যার জানেন কি না, ওনার তিন পুরুষের কেউ ব্যাংকে যায় নাই। ব্যবসা ভালো চালাইতে পারলে ভালো। লস ওইলে আর কতা নাই। আপনেরা ধরেন চাইপ্পা। হেইডও মূল কারণ না। ওনার একটা রাগ আছে ব্যাংকের উপরে।'
'কী রকম?'
'ওনাগো বংশের কে না কি হেই আমলে ব্যাংকে চাকরি নিতে গেছিলো। কিন্তু উন্নত বংশ না দেইখ্যা চাকরি হয় নাই।'
'সেটা তো ব্রিটিশ আমলের কথা। ওরা এখন আর নেই।'
'যাই হউক, ওনাগো ঐ রাগ অহনো যায় নাই। ব্যাংকে খালি ওনার অ্যাকাউন্ট আছে পার্টি নিজের নামে টাকা দিতে চায় না, ফ্যাক্টরির নামে দিতে চায়--এর লাইগা। তাও উনি কিন্তু অ্যাকাউন্ট করার সময় ব্যাংকে যায় নাই। আমিই সবকিছু সামলাই।'