রাহুল রায় : "খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি"- বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ বাক্যটির নিরেট প্রমাণ মিলেছে যশোর স্কুল হেলথ কিনিকের ক্ষেত্রে । ৩০ হাজার টাকার ওষুধ বন্টন করতে সেখানে প্রতি বছর সরকারের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৩ লাখ টাকা । অবাক হওয়ার মতো এ রকম কান্ড ঘটছে অনেকটা সচেতন মহলের অজান্তে। সেখানে কর্মরত ১১ জন কর্মকর্তা কর্মচারী বেতন ভাতা বাবদ ওই টাকা নিলেও যাদের জন্য এ আয়োজন, সেই শিক্ষার্থীরা যথাযথ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না । আর পাবেই বা কিভাবে ? প্রচার প্রচারনার অভাবে অধিকাংশ শিক্ষার্থী জানেই না তাদের চিকিৎসার জন্য একটি হেলথ কিনিক আছে ।
স্কুল চলাকালীন যশোর পৌরসভাধীন সরকারি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য জিলা স্কুলে একটি হেলথ কিনিক রয়েছে । বার্ষিক ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ আসে এ কিনিকের জন্য । কর্তৃপক্ষ জানান, এর মধ্যে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করা হয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়সহ আনুসঙ্গিক কাজে । বাকি ৩০ হাজার টাকার কেনা হয় ওষুধ । আর এ ওষুধ বিতরণ করতে দায়িত্বরত ১১ জন কর্মকর্তা কর্মচারির জন্য সরকারকে দিত হয় ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৮ শ' টাকা । তাদের মধ্যে একজন মেডিকেল অফিসার নেন এক লাখ ৯৪ হাজার, এক জন ফার্মাসিস্ট এক লাখ ১৫ হাজার ৮ শ', দুই জন ডেপুটেশন কর্মচারি দুই লাখ ৩১ হাজার ৬ শ', এক জন সিনিয়র নার্স এক লাখ ১৫ হাজার ৮ শ', দুই জন নার্স দুই লাখ ৩১ হাজার ৬ শ',আয়া, নৈশ প্রহরী ও সুইপার প্রত্যেকে ৯৪ হাজার ৬ শ' টাকা করে বেতন ভাতা ভোগ করেন । এছাড়া দীর্ঘ দুই যুগ ধরে পিয়নের ( এমএলএসএস ) পদ শূন্য রয়েছে । সেখানে মাস্টার রোলে এক জন কাজ করেন । তাকে আনুসঙ্গিক খরচের খাত থেকে প্রতি মাসে দুইশ' করে বছরে দুই হাজার চার শ' টাকা দেয়া হয় । একজন মেডিকেল অফিসারের পদ প্রায় তিন বছর শূন্য রয়েছে ।
জেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানায়, পৌরসভার আওতাধীন এলাকায় ২৯ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৭ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে । এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২২ হাজার ছাত্র ছাত্রী অধ্যয়নরত । আর তাদের সারা বছরের ওধুষ কেনার জন্য হেলথ কিনিকের বরাদ্দ ৩০ হাজার টাকা । অর্থাৎ মাথাপিছু ভাগে পড়ে ১ টাকা ৩৬ পয়সা । সচেতন মহলের অনেকে স্বাস্থ্য সেবার নামে সরকারের এ বরাদ্দকে প্রহসন বলে মন্তব্য করেছেন ।
কিনিক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত অফিস খোলা থাকে । শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় দুপুর ১ টা পর্যন্ত । বাকি দেড় ঘন্টা চলে অফিসের অন্যান্য কাজ । তবে এ সময় কোন রোগী এলে মানবিক কারণে সেবা দেয়া হয় । অথচ স্কুলের কার্যক্রম চলে সকাল সাড়ে আটটা থেকে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত ।
কর্তৃপ আরো জানান, চলতি বছরের পহেলা জানুয়ারি থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত ১ শ' ৪৫ জন রোগিকে তারা সেবা দিয়েছেন । তার মধ্যে জানুয়ারিতে নয় জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৩ জন, মার্চে ৩৩ জন, এপ্রিলে ৪০ জন, মে মাসে ২৮ জন এবং জুন মাসে আট জন সেবা নিয়েছে । খোজ নিয়ে জানা গেছে,যশোর স্কুল হেলথ কিনিকের সংগ্রহে ওষুধ রয়েছে ১১ প্রকারের । এগুলো হচ্ছে, এন্টাসিড, মেট্রো, প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন, কট্রিম, টেট্রা সাইকিন, এমোক্সসিলিন, রেনিটিডিন, বোটাপেন, ভিটামিন 'বি' কমপ্লেক্স∙ ও খাবার স্যালাইন । এসব ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা দিতে হয় তাদের ।
তাছাড়া প্রয়োজনীয় প্রচার প্রচারণার অভাবে অধিকাংশ স্কুলের শিক ও শিক্ষার্থীরা হেলথ কিনিকের কথা জানেনা । শহরের সম্মিলনি ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র শেখ রাব্বি, হাজ্বী মোহাম্মদ মহসীন উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র সোহান কাজী এবং মজিদ মহল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিকিক্ষা মাহিনুর নিগার বলেন, স্কুল হেলথ কিনিকের কথা তাদের জানা নেই।
খোদ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল চন্দ্র হালদারও এ বিষয়ে অবগত নন । তিনি বলেন, কৈ না তো, শহরে শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে তা কখনও শুনিনি ।
অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বরত মেডিকেল অফিসার ডাঃ এ.টি. এম জাহিদুল ইসলাম নিয়মিত অফিসে আসেন না । তিনি দিনের কোন এক ফাকে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে যান । কোন কোন দিন ক্লিনিক মুখো হনই না । অফিসে একাধিকবার গিয়েও তার সাক্ষাৎ পাওয়ার সৈৗভাগ্য হয়নি এ প্রতিবেদকের । কর্তব্যরতরা প্রতিনিয়ত তার শিখিয়ে দেয়া বুলিই আওড়ান, স্যার কিছুণ আগে বাইরে গেছেন । তার দায়িত্ব পালন করেন মেডিকেল অ্যাসিস্টান্ট ও ফার্মাসিষ্ট । যারা চিকিৎসা নিতে আসে তারা এ দু' জনকে ডাক্তার হিসেবে জানে ।
এ ব্যাপারে সিভিল সার্জন ডাঃ সালাহ উদ্দিন খান বলেন, দায়িত্বরতদের রুটিন মাফিক কাজ করার পাশাপাশি নির্ধারিত স্কুলগুলোতে গিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেয়াসহ যথাযথ সেবা প্রদানের কথা প্রায়ই বলা হয় । তারপরও শতভাগ দায়িত্ব তারা পালন করছে না এ কথা সত্য । তবে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে ।