সরকার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকায় নির্ধারণের পরও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক বিক্ষোভ, ভাংচুর ও লুটপাটকে এই শিল্পের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন মালিকরা। একই সঙ্গে পোশাক শিল্প ধ্বংসে নেপথ্যের কারণ হিসেবে ৭টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন তারা।
এগুলো হচ্ছে সম্প্রতি বিদেশি বায়ারদের (ক্রেতা) বাংলাদেশমুখী হওয়া, বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করতে বহিরাগত কোনো শক্তির ইন্ধন, উস্কানিদাতা শ্রমিকদের গ্রেপ্তার না করা, পোশাক কারখানায় বহিরাগত সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ, ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা, ঝুট সেক্টর দখল নিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের মতবিরোধ ও শ্রমিক নেতাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
এসবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন গার্মেন্ট মালিক জানান, গত কয়েক মাস ধরে নারায়ণগঞ্জের শিল্পাঞ্চলগুলো বিদেশি ক্রেতারা এসে পরিদর্শন করছেন। মন্দা কিছুটা কমে আসায় অনেক দেশ থেকে অর্ডার আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এশিয়ার দুটি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বলে বায়ারদের প্রলোভন দেখাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের গুণগত মান ভালো থাকায় অনেক বিদেশি কোম্পানিই বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী। এ কারণেই বেশ কয়েকটি দেশ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে দেশের কিছু শ্রমিক সংগঠন ও নেতাদের দিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের উস্কানি দিচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি নিট গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে নারায়ণগঞ্জে। যার অধিকাংশ ফতুল্লা ও বিসিক এলাকায়। সংখ্যার হিসাবে সহস্রাধিক। ২০০৩ সালের নভেম্বরে বিসিকে দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। ওইদিন থেকেই মূলত শ্রমিক নেতা হিসেবে নজরে আসেন জেলা বাসদ নেতা মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, কমিউনিস্ট পার্টি নেতা মন্টু ঘোষ ও হাফিজুর রহমান প্রমুখ। পরবর্তীতে শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে কোনো ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক নিয়ে কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা দেখা দিলেই এসব নেতা সেখানে উপস্থিত হয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। এতে করে অল্প দিনেই তারা আলোচনায় উঠে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, অনেক শিল্প মালিকই এসব নেতাদের নিয়মিত মাসোহারা দিতেন। গত বছরের ২৭, ২৮ ও ২৯ জুন আশুলিয়া শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ২ শ্রমিক নিহত ও শতাধিক গার্মেন্টে ভাংচুর ও আগুন দেয়া হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মন্টু চন্দ্র ঘোষ ও মাহবুবুর রহমান ইসমাইলকে আসামি করা হয়।
বিগত দিনে নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক ইস্যুটি ছিল বাংলাদেশ টেক্সটাইল গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শ্রমিক নেতা মাহবুবুর রহমান ইসমাইলের দখলে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে গার্মেন্ট সেক্টরে আবির্ভাব ঘটেছে পাগলার শ্রমিক লীগ কাউসার আহমেদ পলাশের। পলাশের কর্মকা- প্রসঙ্গে ইসমাঈলের অভিযোগ, ট্রাক চালকদের নেতা হয়েও গার্মেন্ট মালিকদের কাছ থেকে আর্থিক ফায়দা লুটতেই কয়েক মাস ধরে পলাশ গার্মেন্ট সেক্টরে বিচরণ করছেন। বিগত দিনে ফতুল্লার বালু, পাথর, সিমেন্ট, বিভিন্ন ঘাট থেকে পলাশ চাঁদা আদায় করেছেন বলেও অভিযোগ করেন ইসমাইল। অভিযোগ প্রসঙ্গে পলাশ বলেন, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল বিভিন্ন গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করেন। এর প্রতিবাদ করায় আমি তার প্রতিপক্ষ বনে গেছি। শ্রমিকদের উস্কে দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার।
অনেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানে নিছক সাধারণ শ্রমিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরাও কাজ করে। তারা মূলত তৃতীয় ও চতুর্থ সারির সন্ত্রাসী কিংবা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনুসারী। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, ক্ষমতার পালাবদলের পর নেতারা বেকায়দায় পড়লে ওই সব সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় গিয়ে চাকরি নেয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে ছোটখাট কোনো সমস্যা দেখা দিলেই তারা উত্তেজিত হয়ে ভাংচুর চালায়।
শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্য কারণ হিসেবে ঝুট সেক্টর দখল নিয়ে রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের মতবিরোধকেও দেখছেন গার্মেন্ট মালিকরা। তারা জানান, দশ বছর আগেও গার্মেন্টের পরিত্যক্ত (ঝুট) কাপড় পুড়িয়ে ফেলা হতো। কিন্তু দশ বছর ধরে এসব ঝুট লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের সন্ত্রাসীরাই এ সেক্টর দখল করে। এ নিয়ে প্রায়ই ছোট-বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গত কয়েক বছরে ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের অনেক প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক অসন্তোষের সময় পুলিশের পাশাপাশি এসব সন্ত্রাসীদেরও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে। তাছাড়া ঝুট দখল নিয়ে সন্ত্রাসীদের দুই গ্রুপের কোনো দ্বন্দ্ব থাকলেও এক পক্ষ শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে।
গার্মেন্ট মালিকদের বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি সেলিম ওসমান জানান, শনিবার শ্রমিক অসন্তোষের খবরে তাৎক্ষণাৎ আমি ঘটনাস্থলে ছুটে যাই এবং উত্তেজিত শ্রমিকদের শান্ত করার চেষ্টা করি। প্রকৃত শ্রমিকরা কখনই তাদের প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করতে পারে না। বিকেএমইএ শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে। নতুন মজুরি কাঠমো সব শ্রমিক মেনে নিলেও বেশ কিছু স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।
গার্মেন্ট মালিকরা জানান, ফ্যাক্টরিতে এসে শ্রমিকদের প্রায় বেশিরভাগই তাদের কর্মক্ষেত্রকে সম্মান জানায়। একজন শ্রমিক যখন তার প্রতিষ্ঠানের কাজকে সম্মান দেয় এবং বুঝতে পারে ওই প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তার রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে তখন কোন শ্রমিকই প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর করতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১০ রাত ২:০৩