এমন একটা সময় ছিল যখন সামান্য ইন্টার্ভিউ তে উপস্থিত হওয়াটাই ঠিকমত এফোর্ড করতে পারতাম না। ভালো ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট ছিল না। সেলুনে যেয়ে চুল-দাড়ি কাটানোর জন্য যে টাকা লাগতো ঐটা দিয়ে আমার মিনিমাম ৪ দিনের নাস্তা করা যেত। এর পর ইন্টার্ভিউ এর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্রের ফটোকপি করা, জুতা পালিশ করা অনেক কিছু। দেখা যেত একটা ইন্টার্ভিউ এর জন্য রেডি হইতে মিনিমাম ৫০০ টাকা চলে যেত।
ইন্টার্ভিউ দিয়ে আশায় দিন গুনতাম। যে কোন সময় কল আসতে পারে। ফোন কানের কাছে রাখতাম। যদি ডাক আসে, কোনভাবেই মিস করা যাবে না। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় কল আর আসে না।
আমার যতদুর মনে পড়ে আমি মোটামুটি ৪০০+ এর বেশি যায়গায় সিভি মেইল করেছি। সেখান থেকে ইন্টার্ভিউ তে ডাক পেয়েছি খুব বেশি হলে ১০ জায়গায়। এখন প্রশ্ন হইল এত কম কেন। আমি যদি পুরোপুরি সৎ হই তাহলে আমি বলব আমি আমার নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যই এত কম জায়গা থেকে ইন্টার্ভিউ এর জন্য কল পাইছি।
যেমন আমি পড়েছি ইঞ্জিনিয়ারিং। আমি এপ্লাই করে বসে আছি কোন এক এড এজেন্সির কপিরাইটার এর জন্য। এটা তো হইল নাহ!
কারন আমার কপিরাইটিং জিনিসটা কি সেটা নিয়ে আইডিয়া থাকলেও কোন অভিজ্ঞতা নাই। কপিরাইটিং জিনিস টা আসে অনেক পড়াশোনা এবং চর্চার মাধ্যমে। আমি বলদের মত কেন এপ্লাই করে বসে আছি সেটা আমি নিজেই জানি না। তখন আমার ব্রেইনে কি চলতেছিল এটা বলতে পারব না। হয়ত বেকার থাকার জন্য অনেক ডেসপ্যারেট ছিলাম, একটা দিক নির্দেশনার অভাব ছিল।
একটা ভালো সিভি/রেজ্যুমে কিভাবে লিখতে হয় আমার একদম ই জানা ছিল না। যেটা করতাম সেটা হল ভার্সিটির বড়ভাই এর সিভি কপি করতাম। এক সিভি অনেক জায়গায় দিতাম। এটা আসলে তেমন কোন বুদ্ধিমানের কাজ না।
একটা জিনিস টা বলে রাখি, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি ঠিকই কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি ভালোবাসা টা একদম ই ছিল না শেষের দিকে। তারপরেও ৪ বছর কষ্ট করে পড়েছি দেখে ইঞ্জিনিয়ারিং জবের জন্য এপ্লাই করছিলাম, পাশাপাশি অন্য সেকটরেও দেখছিলাম কি করা যায়। আমার পছন্দের সেকটর ছিল এড এজেন্সি, ভালো এনজিও, স্টার্টআপ এইগুলাই।
কয়েকটা ইঞ্জিনিয়ারিং রিলেটেড জবের ইন্টার্ভিউ এর পর যখন কপাল খুলল না, রাগ করে সিদ্ধান্ত নিলাম, করব না এই জব। তখন এমবিএ র জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম। ইন্টারনেট ঘেটে কয়েকমাস পড়ে জাহাঙ্গীরনগরের আইবিএ এর উইকেন্ড এমবিএ তে পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলাম। তারপর অইটাকে সিভি তে নিয়ে একটা স্টার্টআপ এ ইন্টার্নশিপ শুরু করলাম। আমার কাজ ছিল সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট করা। মজার কাজ। অনেক টা ফেসবুক চালিয়ে টাকা কামানো আর কি। ইন্টার্নশিপ শেষে আবারও কাজ নাই, তখন হঠাৎ একটা কাজ আসল একটা গ্যালারির সোশ্যাল মিডিয়া ও ওয়েবসাইট ম্যানেজ করতে হবে। বেতন অনেক বাজে। আমি ভাবছি যতখুশি এক্সপেরিমেন্ট করব এরপর এই অভিজ্ঞতা নিয়ে বেটার কোম্পানি তে যাব। একবছর কাজ করে সিভি টা কে একটু মানুষ করার ট্রাই করলাম।
ইউটিউব থেকে কয়েকটা ভালো ভালো ভিডিও দেখলাম সিভি/রেজ্যুমে কিভাবে বানাতে হয়। যেমন বিজনেস ইনসাইডার এর রেজ্যুমে র উপর ভালো কয়েকটা ভিডিও আছে। যেখানে ভালো রেজ্যুমে কেমন, খারাপ রেজ্যুমে কেমন উদাহরণ সহ দেখিয়েছে এবং আরো অনেক কিছু। ভিডিও সিরিজ গুলা অনেক সাহায্য করেছে আমাকে।
প্রায় সাত দিন ধরে নিজের একটা রেজ্যুমে বানানোর পর নিজের মধ্যেই একটা কনফিডেন্ট ভাব চলে এল। অনেক কিছুই রেজ্যুমে তে লিখেছি একটু অন্য স্টাইলে। যেমন গ্যালারিতে সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজ করার পাশাপাশি ছবি বেচতাম সব ধরনের মানুষের কাছে। কিন্তু আমি রেজ্যুমে তে এটা লিখছি যে নিয়মিত কর্পোরেট ক্লায়েন্ট ম্যানেজ করতাম। ফোনে অর্ডার নিতাম। রেজ্যুমে তে লিখেছি কর্পোরেট ডিল ম্যানেজ করছি। এইসব লেখার জন্যই স্বাভাবিক ভাবে ইন্টার্ভিউ এর জন্য ডাক আসার কথা। আসতও তাই। তবে যে সব কোম্পানি / অর্গানাইজেশনে রেজ্যুমে পাঠাইতাম তাদের জব ডেস্ক্রিপশনের সাথে মিল করে কাস্টমাইজ করতাম। সুবিধা হইত।
শেষ পর্যন্ত জব হইছে ক্রিয়েটিভ এক্সেকিউটিভ হিসেবে। স্যালারি স্টার্টিং হিসেবে মোটামুটি। অভিজ্ঞতা যোগ হয়েছে ৩ বছরের। আমার ক্যারিয়ার শুরু হয় ২৫ বছর বয়সে। এখন ২৮। ক্যারিয়ার টা একটু দেরিতে শুরু করেছি ঠিকই তবে আমার কাজ নিয়ে অনেক সুখে আছি। যে বেতন পাই ওইটা দিয়ে সেভিংস হয় না ঠিকই তবে জীবনের কিছু চাহিদা পুরন করতে পারছি।
সেদিন একটা জব ফেয়ার হয়েছিল একটা ইউনিভার্সিটি তে। আমার অর্গানাইজেশনের হয়ে আমি ও আমার এক কলিগ গিয়েছিলাম। মোটামুটি ৫০০+ রেজ্যুমে পেয়েছি। পরে অফিসে এসে যখন সর্ট আউট করা শুরু করলাম তখন অনেক সিভির মাঝে সেই আমাকেই খুজে পেয়েছি। কিছু কিছু সিভিতে এপ্লিকেন্ট বিয়ে বাড়িতে তোলা ছবি দিয়েছেন, কিছু সিভিতে ছবি চ্যাপ্টা হয়ে গেছে, বানান ভুল, এলাইন্মেন্ট ঠিক নাই, কিছু সিভিতে ছবির কালার নেগেটিভ এর মত হয়ে গেছে এবং আরো অনেক ইস্যু।
শেষ পর্যন্ত অনেক সিভিই বাদ পড়বে সেখান থেকে। যেটা অনেক দুঃখজনক আমার কাছে। আমিও একসময় ওদের পজিশনে ছিলাম। কত আশা ও স্বপ্ন নিয়ে তারা সিভি জমা দিয়েছে। অনেকের স্বপ্ন পূরণ হবে অনেকের হবে না। অনেকেই ফোনের পাশে অপেক্ষা করে থাকবে একটা কলের জন্য। ভাবতেই চোখে পানি আসে। আমার যদি সক্ষমতা থাকত আমি প্রত্যেককেই চাকরির ব্যবস্থা করতাম। কত ভালো হত।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২২ রাত ১:০৫